অন্তর্ঘাত

(রাজনৈতিক উপন্যাস)

আবুল হোসেন খোকন 

[ সত্তর দশক বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পটভূমিকে ভিত্তি করে এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির অবতারণা অপ্রকাশিত এ পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনায় তুলে ধরা হলো লেখক

পার্ট -

সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিল মিতুলঠান্ডা, গাঢ় এক রকম মিষ্টি বাতাস চারদিকে খোলা অবারিত সবুজ বনভূমির মাঝে একটা মাঠের মতোফাঁকা বাতাসের দোলায় লতা-পাতা দুলছেতারই মধ্যে মিতুল এবং একটা ছেলেহাত ধরে হাঁটছে দুজনহিমেল বাতাস ওদের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে ছেলেটিকে কোনদিন দেখেনি মিতুলতবুও পরম বিশ্বাসে হাতে হাত রেখেছেএতো ভাল লাগছে মিতুলের, যা কোনদিন হয়নিমনে হচ্ছে ছেলেটা কোন রাজপুত্র, আর মিতুল রাজকন্যা পৃথিবীতে ওরা দুজন ছাড়া যেন আর কেও নেইওরা যেন অপ্রতিরোধ্য, দূরন্ত দুর্বারদুজন ইচ্ছে করলে বাতাসে উড়তে পারছেছোট ছোট গাছ-পালার ওপর দিয়ে ঠিক পাখির মতো ভাসতে পারছেএকটু লজ্জা লজ্জা করছে মিতুলেরতবু শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে ও, যেন ছুটে না যায়ছুটে গেলেই যেন সব হারিয়ে যাবেএতো সুন্দর ঘটনা হারাতে চায় না ছেলেটার মুখ ভাল করে দেখা হয়নিএকটা ছোট্ট টিলার পাশ দিয়ে যাবার সময় মুখের দিকে তাকালো মিতুলছেলেটি হাসলোশিহরিত হলো মিতুলমনে হলো কতো আপনার এই রাজপুত্রএ রাজপুত্র শুধুমাত্র মিতুলে জন্যই

হঠা কি হতেই হাত ছুটে গেলভয় পেয়ে তাকাতেই দেখতে পেল, ছেলেটা পিছিয়ে যাচ্ছেঅদৃশ্য কোন শক্তির টানে যেন এগুতে পারছে নাওকে ধরার জন্য দৌঁড়ানোর চেষ্টা করলো মিতুলকিন্তু পা দুটো যেন অবশ হয়ে গেছে কিছুতেই দৌঁড়াতে পারলো নাতারপর সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করলোএকটু নড়াতে পারলোকিন্তু এগুতে পারছে নাপা এতো ভারী হলো কেন! ওদিকে রাজপুত্র ছেলেটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে!  উঠে দাঁড়াচ্ছে টলতে টলতে মিতুলের দিকে হাত বাড়ালোএগিয়ে আসতে চাইলোমিতুলও হাত বাড়ালোএগিয়ে আসতে চাইলোহাত বাড়িয়ে মিতুলও সামনে যেতে চাইলোকিন্তু পারলো নাএবার যেন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে সবকিছু প্রাণপণে মিতুল দৌঁড়ে যাওয়ার চেষ্টা  করলোদেখতে পেলো সামনে বিরাট একটা কূপ রাজপুত্র না দেখে এগিয়ে আসছেচিকার করতে চাইলো মিতুলকিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরুলো না আতঙ্কিত চোখে শুধু দেখলো, ছেলেটি কূপের ভিতর পড়ে গেলমিতুল দেখলো পানিতে ডুবে যাচ্ছে রাজপুত্র ছেলেটি লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিকার করে উঠলো মিতুলতখনই ঘুম ভেঙে গেল হকচকিয়ে উঠে বসলো এবং খেয়াল করলো হাঁপাচ্ছে ও

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর গ্রামে এসেছে মিতুলএটা ওর দাদুর বাড়িবেড়ানো শেষ হলে আবার শহরে ফিরতে হবেতখন পরীক্ষার ফলাফলের জন্য টেনশনে থাকতে হবেতারপর একদিন ফল বেরুবেপাশও করবে ওকারণ ভাল পরীক্ষা দিয়েছেযাইহোক, সামনে নানান ঝামেলাভর্তি হওয়ার ঝামেলা, ভর্তির প্রস্তুতি নেয়ার ঝামেলা, আরও কতো কিসুতরাং সব ঝামেলার আগে মনের আনন্দে নেচে-গেয়ে খোলা প্রান্তরে ঘুরে বেরানোর স্বাদটাকে পেতে চায় ওতাই টুটুলকে নিয়ে চলে এসেছে দাদুর বাড়ি

দাদুর বাড়িটা বিশালতাঁর পূর্ব পুরুষ জমিদার ছিলেনএখনও তাই রয়ে গেছে বিশাল সম্পত্তিআম, কাঠাল, লিচু, নারিকেল, তাল, খেজুরসহ  হরেক রকম ফল-মূলের বাগানে ভর্তি বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে বাড়িএ বাড়িতে দাদু-দিদা আর এক চাচা ছাড়া কেও নেই সুবিশাল এই বাগান বাড়ি অদ্ভুত ফাঁকা ফাঁকা বাগানগুলো জোংলা গাছে পরিপূর্ণগাছে গাছে পাকা ফল থক থক করেসবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই বাগানের ভেতর দিয়ে যখন বেড়ানো হয়, তখন মনে হয় এটা কোন বনকারণ গাছে গাছে কিচির মিচির করে পাখিডাকে ঘুঘু, কোকিলবাগানে আরেকটা মজার জায়গা আছে বেশ দূরে, একেবারে শেষ প্রান্তেএই জায়গাটা গেছো ফুলে ভর্তিঅনেক জাতের ফুলগাছের মধ্যে বকুল ফুল মিতুলে খুব প্রিয় প্রতিদিন খুব ভোরে যখন শিশির ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ও আসে, তখন সাদা চাদরের মতো জমিনে ওপর ছড়িয়ে থাকা বকুল ফুলের মৌ মৌ গন্ধে প্রাণ ভড়ে যায়ভেজা ভেজা ফুলগুলো দুহাতে তুলে ডালি বোঝাই করতে অদ্ভু মজা

মিতুলের পাশের খাটে ঘুমিয়েছে টুটুল মিতুল-টুটুল পিঠেপিঠি ভাই-বোনতাই সব সময় ওদের খুনশুটি লেগেই থাকেদাদুর বাড়িতে ওদের হয়েছে দারুণ মজা সারাদিন হইচই আনন্দ-ফুর্তিযে ঘরটাতে মিতুলরা রয়েছে, সেটা অনেক বড়ওরা দুজন ছাড়া আর কেও নেই এ ঘরেপাশের একটি ঘরে দাদু আছেন এবং বিপরীত দিকের আরেকটি ঘরে চাচা-চাচী আর তাদের দুই পিচ্চি সন্তানেরা থাকেএই গ্রামটা খুব ভালকোন চুরি-ডাকাতি নেইতাই বিশাল জানালাগুলো খুলেই ঘুমিয়েছিল মিতুল আর টুটুলজানালা দিয়ে হিমেল বাতাস ঢুকছে হু হু করেজ্যোসনায় ভাসিয়ে রেখেছে ওদের খাট

কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকার পর স্বপ্নের রেশটা কেটে গেল মিতুলের বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে ঘড়িটা বের করে আনলোসাড়ে চারটা তারমানে আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই ভোর হয়ে যাবেআবার ঘুমুতে ইচ্ছে করছে নাএইটুকু সময় বরং বসেই কাটিয়ে দেয়া যাকবসে বসে কল্পনা করতে বড্ড ভাল লাগেতার ওপর জোয়ারের মতো বাতাস যেভাবে সব উড়িয়ে নিতে চাইছে, তাতে ভাল লাগার মাত্রাটা অনেকগুণ বেড়ে গেছেঠান্ডা বাতাস মিতুলের চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে বারবারহাঁটু গুটিয়ে থুঁতনী ঠেকালো ওহাত দুটো জড়িয়ে থাকলো পাএভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে জ্যোসনায় প্রকৃতি দেখতে থাকলোজ্যোসনা মাঝে মাঝে হালকা মেঘের আবরণে ঢেকে যাচ্ছেতখন আরও অদ্ভু মনে হচ্ছে প্রকৃতিকে

জ্যোসনার আবেশটা ক্রমেই থিতিয়ে আসতে লাগলোভোর হচ্ছেগায়ের চাদরটা নামিয়ে খাট থেকে নামলো মিতুলমেঝেয় খানিক পাঁয়চারি করলো টুটুলটা এখনও ঘুমাচ্ছে চাদর-টাদর ফেলে দিয়ে একেবারে এলোমেলো হয়ে আছেওর অভ্যাসটাই ওরকমগুছিয়ে শুতে পারে না

টুটুলের কাছে বসলো মিতুলভাল করে তাকালো ওর দিকেখালি গায়ে লুঙ্গি পরে বেশ আয়েশ করে ঘুমুচ্ছে বেচারাডাকতে ইচ্ছে করছে নাঅথচ ভোর হতে যাচ্ছে, বাইরে বের হতে হবেশিশির ভেঁজা ঘাঁসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হবেযা স্বাস্থ্যের জন্য বড়ই উপকারীঅবশ্য মিতুল বা টুটুলের স্বাস্থ্য খারাপ নয়বরং ওদের সুন্দর দৈহিক গরণ, বিশেষ করে অদ্ভু সুন্দর চেহারা দেখে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও হতভম্ব হয়ে পড়বেন

টুটুল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসছেমনে হয় স্বপ্ন দেখছেমিতুল আস্তে করে টুটুলের বাহুতে হাত রাখলোখুব নরম করে নাড়া দিলোঘুমন্ত মানুষকে কখনও জোরে করে ধাক্কা দিতে নেইআদর করে ঘুম ভাঙাতে হয়তাহলে নার্ভের স্বাভাবিকতা থাকেএই দর্শন কোন এক অভিজ্ঞ মানুষেরএটাকে সাংঘাতিকভাবে মেনে চলে মিতুল

টুটুলের বাহুতে মিতুলের স্পর্শ পড়তেই স্বপ্নিল হাসিটা নিভে গেলএকটু যেন কেঁপেও উঠলোকিন্তু ঘুম ভাঙলো নাহাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে নাড়া দিলো মিতুলডাকলো, ‘টুল, এই  টুলওঠটুটুল কাঁ হয়ে ছিলকোন শব্দ না করে চি হলোটুল, এই টুল, ওঠ, উঠবি না?’ আবার ডাকলো মিতুলকোন জবাব দিলো না ছেলেটা

ওর বুকে হাত রাখলো মিতুলবড় আদরের ভাই এটা মিতুলের মনে হয় এটা ওর জান-প্রাণযখন ছোট ছিল, তখন একেবারে বুকে করে রাখতো ওকেএই তো কিছুদিন আগেও মিতুল আর টুটুল এক বিছানায় ঘুমাতো।। কিন্তু ও এখন বড় হয়ে যাচ্ছেতাই আলাদা হয়েছেযখন আরও বড় হবে, তখন? তখন কি আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে দু ভাই-বোন? প্রকৃতির অদ্ভু নিয়মওটাই স্বাভাবিকএই তো সেই ছোট্ট টুটুলের দেহে এখন ক্রমেই এক রকম রোশনাই দেখা দিয়েছে পেশীগুলো মজবুত হচ্ছেশরীরটা কী দারুণ আকর্ষণীয় হয়ে উঠছেমুখে গোঁফের রেখাও ফুটছেএকদিন এমন হবে যখন টুটুল আর এ টুটুল থাকবে না দাড়ি-গোঁফে পরিপূর্ণ এক যুবক হয়ে উঠবেতখন কি মিতুলের পক্ষে ঘনিষ্ট হওয়া সম্ভব হবে? হবে নামিতুলও আরও বড় হবেতখন হয়তো টুটুলের চাইতে বেশি আকর্ষণ ঘটাবে কোন অপরিচিত যুবকেরসে-ই তখন মন-প্রাণ জুড়ে বসবেএকদিন ঘরও বাঁধবেআজকের দুভাই-বোন কতো দূরে না চলে যাবেটুটুলও বিয়ে করে সংসারী হবেকতো পরিবর্তন ঘটবে পরিবর্তনটাই স্বাভাবিক নিয়মযতো বড় হওয়া যায়, ততো পরিবর্তন ঘটেযে বাবা-মা কতো আদর করে বড় করেছেন, তাঁরাও একদিন পর হয়ে যাবেন টুটুলের মতো যে ভাই মিতুল ছাড়া কিছু বোঝে না, সেই টুটুলই একদিন এমন হবে যে নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখবে সম্পত্তির ভাগা-ভাগির প্রশ্ন যখন আসে, তখন এই জিনিসগুলোকে স্পষ্ট করে দেখা যায়নাহ্, ভাবতে ভাল লাগছে নাহাত বুলাতে বুলাতে ডাকলো মিতুল, ‘অ্যাই টুটুল, টুটু, ওঠ্ওঠ্ না আলসে ছোড়া কোথাকার

মিতুলের হাতটাকে বুকে চেপে ধরলো টুটুলএক চোখ সামান্য ফাঁক করে বললো, ‘সকাল তো হয়নিডাকছিস কেন? ঘুমুতে দে হ্যাঁচকা টান দিলো ও মিতুলের হাত ধরেটুটুল বললো, ‘শুয়ে পড়তো এখানে, আয় শোহাত ছাড়িয়ে নিলো মিতুল, ‘পাজি ছোঁড়া কোথাকারওঠ্কাধে এক ধাক্কা দিলো মিতুলদেড় ইঞ্চি লম্বা জিভ বের করে দেখালো টুটুলতারপর বালিশ থেকে মাথা তুলে মিতুলের কোলের ওপর রাখলো এবং এক হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরলোবললো, ‘মাথায় হাত বুলিয়ে দে না লক্ষ্ণী বোন আমারএকটু ঘুমাই

মিতুল আপত্তি করলো নাওর মাথা ভর্তি নরম চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলোটুটুল আয়েশে ঘুমিয়ে পড়লোমনে মনে বললো মিতুল, ‘দাঁড়া, তোকে বিয়ে দিয়ে দেবোতোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার লোক হবে তখনবিয়ের ব্যাপার নিয়ে দুভাই-বোনে মজার মজার তর্ক হয়মিতুল যখন বলে, ‘শোন্রে টুটু, শিগগির তোর লাল টুকটুকে বউ আসবেতোর বিয়ে হবে, হি হিজবাবে টুটুল জিভ দেখিয়ে বলে, ‘ইস্ লাল টুকটুকে বউ! তুই যদি আমার বোন না হতি, তাহলে তোকেই বিয়ে করতামতোর মতো লাল টুকটুক সুন্দরী দুনিয়ায় আর আছে নাকি?’ এসব বলে টুটুল যখন চুকচুক করে আফসোস করে তখন মিতুল চোখ পাকিয়ে তাকায়বলে, ‘অ্যাই পাজি ছোকড়া, খুব পাকামো শিখেছিস না? কান ছিঁড়ে দেবোটুটুল তখন জিভ দেখিয়ে পালায়

ভোরের ফর্সা ভাবটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে টুটুলের মাথাটা বালিশে নামিয়ে দিতে দিতে মিতুল বললো, ‘তোমার কি ওঠার ইচ্ছে আছে? উঠলে ওঠো, না হলে আমি চললামমিতুল রেগে গেলে টুটুলকে তুমি করে বলেহঠা টলতে টলতে উঠে বসলো টুটুলগলা জড়িয়ে ধরলো মিতুলেরঘাড়ের ওপর মাথা এলিয়ে দিলোতারপর জড়িয়ে জড়িয়ে বললো, ‘ভালো লাগছে নারে আপুঘুব ঘুম পাচ্ছেমিতুল গম্ভীর হয়ে রইলো ব্যাপারটা ঘুমের ঘোরেও বুঝতে পারলো টুটুলচোখ খুলে মিতুলের দিকে সোজাভাবে তাকালোমিষ্টি করে হাসলোদুহাতে মিতুলের মাথাটাকে ধরে নিজের দিকে টেনে আনলোতারপর চপাচপ তিন/চারটে চুমো খেয়ে বললো, ‘লক্ষ্ণী আপু আমারআজকের মতো তুই একাই যাআমার খুউব ঘুমুতে ইচ্ছে করছেকাল ঠিক যাবোতোর আগে আমি উঠবোএই তোকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছিআরেকটি চুমু খেয়ে বললো টুটুল, ‘বল্ আপু, রাগ করিস্নি?’ হেসে ফেললো মিতুরবললো, ‘ঠিক আছে তুই ঘুমো’ ‘থ্যাঙ্কু মাই ডিয়ার আপু বলেই বালিশে এলিয়ে পড়লো টুটুল

মিতুল বিছানা থেকে নামলো জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলো বেশ ফর্সা ফর্সা ভাব হয়ে এসেছেআনন্দে নেচে উঠলো মনবাইরে বেরুনোর জন্য প্রস্তুত হলো স্কার্ট পড়ে নিলো ও ওড়না-টোড়না দরকার আছে বলে মনে করলো নাভোরের বাতাসে যতো কম পোশাকে বেড়ানো যায়, ততোই আরাম স্যান্ডেলও নেবে না ওকারণ স্যান্ডেল পায়ে বেরুলে শিশিরে ভেজা মাটি আর ঘাঁসের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ানোর আনন্দটাই শেষ হয়ে যাবেজানালা দিয়ে বাইরেটা আরেকবার দেখে নিলোতারপর বেরুনোর আগে খাটের কাছে দাঁড়ালোঘুমন্ত টুটুলকে ভাল করে দেখলোঝুকে দুটো চুমু খেলোএকটি কপালে, একটি ঠোঁটেটুটুল জবাবে মিষ্টি করে হাসলোমিতুল বললো, ‘থাক্ যাই

দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো ও অন্ধকার ভাবটা থাকলেও আকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছেকখন যেন বাতাসটা পড়ে গেছেতাই কুয়াশার আবরণ নেমে এসেছেমিতুল স্কার্টের নিচের অংশটা খানিক উঁচু করে নরম নরম শিশির ভেজা ঘাঁসের মধ্যে নেমে এলোকোন দিকে না তাকিয়ে ছুটলো বকুলতলার দিকেবেশ দূর হাঁটতে হয়তাই ঘাঁসের শিশিরে পায়ের দিকটা একাকার হয়ে গেলওই অবস্থায় ছড়িয়ে থাকা বকুল ফুলের     আস্তরণের কাছে এসে থামলো

একটু চমকে উঠলোএই জায়গাটায় অন্য কারো আসার কথা নয় এমনিতেই ফাঁকা জায়গা বাগানের অন্যান্য দিকে কোন বাড়ি-ঘর নেইশুধু ফসলের ক্ষেতকিন্তু বকুলতলার  মাটিতে কিছু যেন হেঁটে গেছেবড় বড় জুতোর মতো অনেক দাগ একেবারে গর্ত হয়ে বসে গেছে দাগগুলো স্পষ্ট, যা এখনই হেঁটে যাবার প্রমাণ তুলে ধরছেগর্তের ভেতরে সাদা সাদা বকুল ফুলের স্তুপ বসে গেছেভয় পেয়ে সামনের দিকে তাকালো মিতুলচমকে উঠলো আবার হতভম্বের মতো দেখলো অস্ত্র হাতে কালো কালো একদল মানুষ চলে যাচ্ছেতাদের কাঠামোগুলো কুয়াশায় আবছা ভাবে দেখা গেলসঙ্গে সঙ্গে ঘুড়ে দাঁড়ালো মিতুলদৌঁড় দিলো বাড়ির দিকে

কিন্তু পথ আগলে দাঁড়ালো ভয়ঙ্কর দর্শন এক মিলিটারিহাতের মেশিনগান তাক করা মিতুলে বুক বরাবরএকজন নয়, কয়েকজন মিলিটারি ঘিরে ফেলেছে ওকে মেশিনগান তাক করে রাখা মিলিটারিটি চাপা গলায় বললো, ‘বানচো, এখানে কি হচ্ছে? দৌঁড়াচ্ছিলি কেন?’ স্তম্ভিত হয়ে গেল মিতুলআতঙ্কে গলা দিয়ে স্বর বেরুলো নাপা দুটো হয়ে গেল পাথরের মতো শক্ত, আর ভারীঠিক স্বপ্নে দেখা সেই অবস্থার মতোচেষ্টা করেও নড়তে পারলো না মিতুলকোন শব্দও করতে পারলো না মিলিটারিটা ধমকে উঠলোকিন্তু মিতুল পাথর, হতভম্বটলছে ও, এখনই পড়ে যাবে মিলিটারিরা নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করলোওদের দৃষ্টিতে চকচক করে উঠলো লালসা

ঠিক তখনই সম্বিত ফিরে পেলো মিতুলচিকার দেয়ার জন্য মুখ খুললোকিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কেও একজন মুখ চেপে ধরলোঅন্য কেও একজন হাতকাটা স্কার্টের ওপরের অংশ ধরে হ্যাঁচকা টান দিলোএকটানে জামাটা ছিঁড়ে দেহ থেকে চলে গেলবেরিয়ে পড়লো নিরাভরণ দেহআরেকটা হ্যাঁচকা টান দিলোওকে ঠেলে নিলো পাশেই উপ্ড়ে কাঁত্ হয়ে পড়ে থাকা একটা বড় আম গাছের দিকেঠিক তখনই একজন ওর পরণের নিচের অংশটায় হ্যাঁচকা টান দিলোওটাও ছিঁড়ে মিলিটারির হাতে চলে গেলওকে চি করে ফেলে দিলো আম গাছের গুড়িতেকোন শব্দ করার সুযোগ পেলো না মিতুল নড়াচড়াও করতে পারলো না।..................

মিতুলখানিক আগেও মেয়েটির কাছে এই প্রকৃতি বড় সুন্দর ছিলসুন্দর ছিল অরণ্যে ঘেরা বাগান, ঘাঁস, পাখি, শিশির, বকুল ফুলবড় ভাল ছিল পৃথিবী আর সব মানুষওর একটা স্বপ্নের জগ ছিল প্রাণের চেয়েও প্রিয় একটা ভাই ছিলছিল বাবা-মা, আত্মীয় আর বন্ধু-বান্ধবহয়তো ওর ভালবাসারও কেও ছিলতাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন ছিল, আশা ছিলসুন্দর একটা ভবিষ্যতের কল্পনা ছিলকিন্তু এক লহমায় সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল নিষ্ঠুর   বাস্তবতা মিতুলের সবকিছু চুরমার করে দিলো

---- চলবে ----


আবুল হোসেন খোকন : লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।