তখন ও এখন 

গীতা দাস

(১৯)

 

চাই না মাগো রাজা হতে

রাজা হবার সাধ নাই মাগো

দুবেলা যেন পাই মা খেতে

------------------------

মাটির ঘরে বাঁশের খুঁটি মা

পাই যেন সেথায় খড় যোগাতে

যদি দ্বারেতে অতিথি আসে

না হয় যেন মুখ লুকাতে

উপরের লাইন কয়টিতে মধ্য যুগের সাধক ও গায়ক কবি রামপ্রসাদের সাধারণ জীবন যাপনের আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছেএ শুধু কবি রামপ্রসাদের নয়  ----- এ-ই ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রাণের চাওয়াদ্বন্দ্বহীন, জাঁকজমকবিহীন, বিলাসিতা বর্জিত, সাদামাটা জীবন যাপন। হঠা কোত্থেকে যে বান এলো, আর সে বানের তোড় ভাসিয়ে নিয়ে গেল শাশ্বত ও সর্বজনীন যাপিত জীবনের বৈশিষ্ট্যএখন শুধু চাওয়া আর চাওয়া 

উল্লেখিত গানে মানবিকবোধে বিকশিত হবার মন্ত্র রয়েছেএকদিকে যেমন শুধু দুবেলা পেট ভরে খাবার ও খড়ের ঘরের আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে অতিথিকে আপ্যায়ণ করার মত সামর্থ চায় অতিথিকে আপ্যায়ণ করা ছিল ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য   

আমার ছোটবেলায় দেখেছি গ্রীষ্মের আম কাঁঠাল, কাঁঠালের পিঠা, বর্ষায় তালের পিঠা, শীতে অন্যান্য পিঠা ছিল আত্মীয় স্বজনের জন্য বরাদ্দ সরকারের বার্ষিক বাজেটের মতই

আমার নিজের পিসি ছিল নাবাবা ও কাকারা তাদের মাসতুত ও পিসতুত বোনদের নাইয়র আনতেনবাবা ও কাকারা আনতেন মানে ঠাকুরমা ও বোন আনাতেনতাদের ছেলেমেয়েদের সাথে আমরা দল বেঁধে পাকা আম বিশেষ কায়দায় খেতাম আমটিকে আঙ্গুল দিয়ে টিপেটিপে তুলতুলে করে বোঁটার উল্টো দিকে একটু ফুটো করে চিপে চিপে চুষে চুষে রস খেতাম এখনকার ব্লেন্ডারে আমের জুস বানিয়ে স্ট্র দিয়ে খাবার মত স্বাদ ও আয়েস ছিল 

আমাদের ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে যেমন আত্মীয় স্বজন আসত তেমনি আমরাও বেড়াতে যেতাম

কিন্তু এখন কী তা পারা যাচ্ছে? প্রায়ঃশই যাচ্ছে নাকারণ কী? কারণ --- ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের বিকাশ, মতান্তরে ---- শব্দান্তরে স্বার্থপরতাএকক পরিবারের সৃষ্টি, জীবিকার প্রয়োজনে ব্যস্ততম নাগরিক জীবন সামাজিক বলয়ের পরিবর্তনমননেরও রূপান্তর

অধিকন্তু, নিজেদের চাওয়ারই শেষ নাই।  চাই চাই আরো চাই

যে মানুষটির সময় নেই অজুহাতে রক্তীয়দের সাথে সামাজিকতা কমিয়ে দিয়েছে, সে কিন্তু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সময় কাটানোতে কার্পণ্য করে নাপার্টি সংস্কৃতির চর্চায় তার ব্যস্ততম সন্ধ্যা কাটেতবে তাতে বৈষয়িক ও সামাজিক কারণসহ আত্মিক সম্পর্কও হয়ত রয়েছে যে যার সাথে সময় কাটাতে চায়, যাকে ভালবাসে অথবা যার সাথে সময় কাটানোর প্রয়োজন রয়েছে, তার সাথেই সময় কাটায়।

নরসিংদীর মেঘনার এমন অনেক মাছ ছোটবেলায় দেখেছি ও খেয়েছি যা এখন আর দেখি নাযেমনঃ টাকা মাছগোল গোল এবং রূপার মত চকচক করত বলে নাম ছিল টাকা মাছসে স্বাদ চাখার সুযোগ পাচ্ছি না

আজকাল গ্রামে গঞ্জে সাধারণত দেখা যায় সাধারণ মানুষ পাঙাশ মাছ আর জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় মাসে একটা কাঁঠাল বাজার করে বাড়ি ফিরছে, মাছের ওজন প্রায় এক কেজি বা এরও কম দাম জিজ্ঞেস করে উত্তর পাই --- পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা কেজিপাঙাশ মাছের বাজার গ্রামে গঞ্জে বিস্তৃতএ মাছের সরবরাহ আছে বলেই নিদেন পক্ষে মাছে ভাতে বাঙালীর চরিত্র ঠিক রাখা যাচ্ছে। পাঙাশ আছে বলেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মাছ তো খাওয়া হয় ! একটু অবস্থাপন্নরা অবশ্য এ মাছ খায় না গন্ধ লাগে অথবা তেল বেশি

 আর কাঁঠাল! তথাকথিত ভদ্র সমাজের কাঁঠালের বিরুদ্ধে শতেক অভিযোগযে কাঁঠাল পছন্দ করে তার সম্বন্ধেও ধারণা অবহেলার।

কেউ বলে --- কে কাঁঠালকে জাতীয় ফল বানাল? এত সস্তা ও সহজলভ্য ফলকে কেউ জাতীয় ফল বানায়?

কারও ঝাঁঝাল মন্তব্য --- কাঁঠাল কোন পছন্দের ফল হল? কাঁঠালের গন্ধ ভাল্লাগে নাশুধু বীচির জন্য কাঁঠাল কিনি

কেউ ক্ষোভের সাথে বলে --- একটা কিনলে আর শেষ হয় না। আবার ফ্রিজে রাখলে অন্য সব খাবারও কাঁঠাল কাঁঠাল গন্ধ হয়ে যায়কী জ্বালা!

কেউ আবার কপালে চোখ তুলে বলে ---- শক্ত হলে তাও দুএক কোষ খাওয়া যায়। নরম কাঁঠাল! বাপরে বাপ। অনেককে দেখি নরম কাঁঠাল কী বিশ্রীভাবেই না ক্যা ক্যা করে গিলে ফেলছে।   

কেউ আবার কাঁঠালের তরকারি খায়। অর্থা কাঁঠালের যৌবনেই পছন্দ। পরিপূরক হয়ে নরম হলে অপছন্দ।

কিন্তু আমার মতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির প্রোটিনের যোগান ছাড়াও তুলনামূলকভাবে সস্তায় পেট ভরার মত ফল বটেগ্রামের সাধারণ মানুষ সকালে মুড়ি অথবা পান্তা ভাত কাঁঠাল দিয়ে খেয়ে টান টান পেটদুপুর পর্যন্ত নিশ্চিন্ত। গরীবের দেশে এ এক পরম পাওয়া।

আমাদের ছোটবেলায় গ্রীষ্মকালে আম, কাঁঠাল, তরমুজ, ভাঙ্গি, লটকন, জামরুল, জাম, লিচু, পেলাগুটা সহ হরেক রকমের ফলের একটা না একটা ঘরে থাকতই। আমাদের তখনকার সময়ে মহকুমা শহর ছাড়া আঙ্গুর আপেল পাওয়া যেত না। এখন অবশ্য গ্রামে গঞ্জের বাজারেও পাওয়া যায়।  

খেজুরের ছড়ায় রাতে লবণ জল দিয়ে টানিয়ে রাখা হত। সকালে দেখতাম প্রায় সব পেকে আছে। বিশেষকরে গ্রীষ্মকালে আমার সকালে উঠার অভ্যাস না থাকলেও খেজুরের লোভে উঠতাম। আজকালকের ছেলেমেয়েরা দেশী খেজুর মুখে দিতে চায় না। আমরাও কিনি না।   অনেকে আবার দেশী খেজুর চিনিও না। দেশী খেজুরের মাংস কম, বীচি বেশি বড়। মধ্যপ্রাচ্যের খেজুরে মাংস বেশি। কাজেই কেনই বা তারা তা পছন্দ করবে! আধুনিক অর্থনীতির তত্ত্ব নিশ্চয়ই তা সমর্থন করে না।

গীতা দাস

৭ ভাদ্র, ১৪১৫/  ২২আগষ্ট, ২০০৮

[email protected]