আমরা কেমন আছি?
১
কেমন আছি আমরা? প্রশ্নটি আসলে নিজেকেই করা। ‘আমি কেমন আছি?’ – এভাবেও প্রশ্নটি করা যেতো। কিন্তু আমার ভালো থাকা বা মন্দ থাকায় আমি ছাড়া হয়তো আর কারো কিছুই যায় আসে না। তাই নিজেকে অন্যের সাথে জড়িয়ে কিছুটা হলেও বহুবচনে থাকার প্রচেষ্টা। তাতে খুব খারাপ থাকলেও একটা সান্ত্বনা থাকে যে আমি ছাড়াও আরো কেউ কেউ আছেন আমার মতো। তো কেমন আছি আমরা?
এটুকু বলার পরেই স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসবে এই “আমরা” বলতে কাদের বোঝাচ্ছি? “আমরা” কারা? “আমরা” কোথায় থাকি? আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থান কোথায়? বিভাজনের প্রশ্নতো আসবেই। সামগ্রিকভাবে যদি “আমরা” বলতে বাংলাদেশের মানুষ বোঝাই – সাথে সাথে অবিশ্বাসের আঙুল উঁচিয়ে প্রশ্ন করবেন অনেকেই – বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে অন্যকোন মহাদেশে বসে নিজেকে বাংলাদেশের মানুষ ভাবার কোন অধিকার কি আছে?
আসলেই তো। আমরা যারা বাংলাদেশের বাইরে আছি তারা যেন কিছুতেই বাংলাদেশের মানুষ হতে পারছি না। বাংলাদেশের ভালোমন্দ নিয়ে আমরা কিছু বলতে গেলেই আমাদের বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার একটি প্রবণতা দেখা দেয় অনেকের মাঝে। জীবনের প্রধান অংশ বাংলাদেশে কাটলেও – মা বাবা ভাইবোন আত্মীয় স্বজন সবাই বাংলাদেশে বাস করলেও – উপার্জনের সিংহভাগ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিলেও – ব্যস্ত দৈনন্দিনের কিছুটা সময় ভাবনায় লেখায় বা আলোচনায় নিত্য বাংলাদেশের সাথে কাটালেও – আমরা দেশের বাইরে থাকি – এটাই আমাদের বড় অযোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়। আমরা যুক্তির কথা বললে – তার উত্তরে বলা হয় – “নিরাপদ অবস্থানে থেকে বড় বড় কথা বলা খুবই সহজ”। দেশের বাইরে যারা থাকেন – কেবল তারাই কি বড় বড় কথা বলেন? দেশের ভেতরে বসে বড় বড় কথা কেউ বলেন না?
কথাগুলো মনে হবার কারণ অনেক। তারমধ্যে একটি সাম্প্রতিকতম কারণ হলো কবি নির্মলেন্দু গুণের আক্রমণ। আক্রমণ সরাসরি আমাকে করা হয়নি – কিন্তু আক্রমণের ধরণ দেখে মনে হয় – দেশের বাইরে বসে কেউ তাঁর সমালোচনা করলেই তিনি আক্রমণ করবেন – এবং সে আক্রমণের ভাষা ঠিক কবি নির্মলেন্দু গুণ সুলভ নয়।
ঘটনাপ্রবাহ মোটামুটি এরকমঃ প্রথম আলোতে “নাম” শিরোনামে একটি কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে নাকি মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে মারাত্মক আঘাত লেগেছে। বাংলাদেশে এখনো প্রচ্ছন্ন মৌলবাদী সরকার কাজ করছে। তাই ধর্মীয় উগ্রতার হাত থেকে বাঁচার আশায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন মারাত্মক ক্ষমতার অধিকারী ইসলামী নেতাদের কাছে। এতে মতিউর রহমানের ইমেজ রক্ষা না হলেও রক্ষা পেয়েছে প্রথম আলো। এ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা সমালোচনা স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয়েছে। মতিউর রহমানের কাজের পক্ষে বিপক্ষে যথেষ্ঠ যুক্তি আছে। মতিউর রহমানকে সমর্থন করার পক্ষে যুক্তি যেমন আছে – সমর্থন প্রত্যাহার করার পক্ষেও আছে। কবি নির্মলেন্দু গুণ মতিউর রহমান যা করেছেন ঠিক কাজই করেছেন বলে মন্তব্য করে লিখেছেন মুক্তমনা ফোরামে (Msg No. 44125, 29/09/2007)। এর সূত্র ধরে জাহেদ আহমেদ মন্তব্য করেছেন যদি শেখ হাসিনা ও আরো অনেকে সেনাবাহিনী প্রধানকে অকুন্ঠ সমর্থন না জানাতেন তাহলে হয়তো আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। জেনারেল মইন বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় ভাবে জাতির পিতার সম্মান দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অনেকদিন আগে। এজন্য তিনি অনেকের অভিনন্দন পেয়েছিলেন সেদিন। নির্মলেন্দু গুণও জেনারেল মইনকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছেন মুক্তমনা ফোরামে। এখন এ বিষয়ে অনেকের মোহভঙ্গ হতে শুরু করেছে। তাই জাহেদ নির্মলেন্দু গুণের কাছে প্রশ্ন করেছেন – কবিরাতো ভবিষ্যতদ্রষ্টা হয়ে থাকেন – এক্ষেত্রে ভবিষ্যত দেখতে না পাবার কারণ কী ছিলো?
(msg 44155, 01/10/2007)। জাহেদের এ প্রশ্নে রেগে যাওয়ার মতো কোন কারণ তো দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু নির্মলেন্দু গুণ রেগে গেলেন। তিনি বললেন বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দেখিয়েছেন বলেই তিনি জেনারেল মইনের প্রশংসা করেছেন। তিনি জাহেদের উদ্দেশ্যে লিখলেন, “...Don’t try to be oversmart. Don’t open your mouth beyond your ability. Stay well in America.” (msg. 44187, 02/10/2007)। জাহেদ স্মার্ট মানুষ, তাঁর যুক্তিবাদী লেখাগুলোও তাই স্মার্ট। কিন্তু ওভারস্মার্ট বলতে যে শ্মেষাত্মক অর্থ বোঝানো হয় তা তো জাহেদের কোন দিনই নেই। কিন্তু কবি গুণ কেন যে এরকম আক্রমণ করে বসলেন কে জানে। আর আমেরিকায় থাকার কথাটি কি এখানে খুবই দরকারী প্রসঙ্গ? তবে রাগ করার কারণ কি এই যে – জাহেদ আমেরিকায় বাস করে কবিকে প্রশ্ন করেছেন।
নির্মলেন্দু গুণের মন্তব্যের জবাবে জাহেদ লিখেছেনঃ
"Nirmalendu Goon" wrote:
<<What is the fault with Gen. Moyeen? If a man of his starure gives
tribute to BB no harm is praising him.>>
-Well, on a few occassion even Ershad praised BB when the former was
a president but people knew that it was just a political stunt. Would
you praise Ershad for that, or do you think he had true respect for
BB? [msg: 44189]
খুবই স্বাভাবিক যুক্তি। কিন্তু এর উত্তরে কবি লিখলেন জেনারেল এরশাদ তাঁর খুব ভালো বন্ধু!
Oh Jahed, you dont know, our ex-president General HM Ershad
is a very good friend of mine. I praised him in my book entitled
Senakunje Kichukkhon. (Msg: 44255)স্বৈরাচারী এরশাদ কবি নির্মলেন্দু গুণের ভালো বন্ধু!! এখানে কোন মন্তব্য করার সাহস পাচ্ছি না। কখন ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যায়। কবিতাকে ভালোবেসে আমরা কবিতার কবিকেও ভালোবেসে ফেলি। কিন্তু কী করে মানবো যে কবিরা তাঁদের কবিতায় যা বলেন তার সবটুকু তাঁরা নিজেরাও বিশ্বাস করেন না! নইলে – এরশাদের মতো মানুষের প্রশংসা করছেন কিনা আমাদের প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ! কবিকে একথা মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন আদ্নান লারমন্তভ (Lermontov Msg.44206)
dear poet NG,
how are you sir?
you have the right to say whatever you want to say, it
doesn't matter how hurtful it is, really.
but i just wanted to ask you that are you still the
same poet or the same man who wrote the poem
"agneoastro"? that's all, that is all i wanted to ask
thank you
adnan lermontovএর জবাবে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেনঃ
No Mr Adnan I am not the same poet now who wrote Agneastro.
I wrote that poem 36 years back, in 1971. Seems u loved it.
So? You want me to continue writing similiar poems all through
my life? What do u mean by thats all?
What the hell you do, Mr? Live in the USA, as most of the wise
people opt for? Stay well in the safe heaven, Mr Lermontov.(Msg: 44258, 6/10/07)
কবি হয়তো ঠিকই বলেছেন যে সময়ের সাথে তিনি বদলে গেছেন। বদলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাতে কবিদের কোন সমস্যা হয়না। সমস্যা হয় আমাদের – যারা কবিকে ভালোবাসি। ভালোবাসায় প্রত্যাশাও থাকে বেশি। আমাদেরও ছিলো। সে প্রত্যাশা পূরণ হয়না বলেই যত কষ্ট। সে নাহয় মানলাম – কিন্তু মিঃ লারমন্তভের আমেরিকায় থাকার প্রসঙ্গটা কি এখানে মোটেও জরুরি ছিলো?
এ কারণেই মনে হচ্ছে – দেশের বাইরে থেকে দেশের কথা বলাটাকে আমাদের অপরাধ বলে মনে করেন কেউ কেউ।
২
দেশের বাইরে যারা থাকেন সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাদের অবস্থাটি মোটামুটি এরকমঃ বাংলাদেশের ভেতর প্রচন্ড সংগ্রাম করে কোনভাবে দেশের বাইরে যাবার সুযোগ করে নেয়ার জন্য প্রতি পদে পদে ধাক্কা খেতে খেতে এয়ারপোর্টের শেষ ধাক্কাটি কোন রকমে হজম করে বিদেশের মাটিতে পা রাখা। তারপর অনিশ্চিত ভবিষ্যতে কিছুটা নিশ্চয়তা লাভের জন্য অন্যরকম সংগ্রাম। বিদেশী ভাষা, বিদেশী সংস্কৃতি, বিদেশের আবহাওয়া – সব প্রতিকুলতার মাঝে সামান্য কূল পাওয়ার পর একটু স্বস্তি। এর মধ্যেও সারাক্ষণ দেশের খববের জন্য মন কেমন করা – নিজের দেশের মানুষের সাথে দেখা হলে ব্যক্তিগত ব্যাপার ছাপিয়ে দেশের কথায় মেতে ওঠা। কীভাবে দেশের ভালো হবে – এ নিয়ে নানা জনের নানা মত। যারা মত দেন তাঁরা নিজের নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই মত দেন। বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরে এসেছেন এমন প্রত্যেকেরই বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু না কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। এ অভিজ্ঞতা যেন অন্য কারো না হয় – সে কারণেই তাঁরা অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। শেয়ার করার জন্য তাঁরা লেখেন, অন্যের লেখার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা লাভের জন্য নিজেদের মাঝেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার অনুশীলন করেন, মুক্তবুদ্ধির মুক্তমনের চর্চা করেন।
মন যখন মুক্তভাবে চিন্তা করার সুযোগ পায় – তখন স্বাভাবিক ভাবেই “জো হুকুম জনাব” বলে হুকুম তামিল করার মন আর থাকে না। অন্যের কথা অন্যের মত বিনাচিন্তায় বিনাদ্বিধায় মেনে নেয়ার মানসিকতা মুক্তমনাদের থাকে না। আর আমার মতের সাথে কেউ দ্বিমত পোষণ করলেই আমার অহংকারে আঘাত লাগলে আমি কিসের মুক্তমনা? মুক্তমনা হবার অনুশীলন করতে হয় নিয়মিত। একজন মুক্তমনার সবচেয়ে দরকারী বন্ধু হচ্ছে তার যৌক্তিক সমালোচক। যুক্তিতে শান দেয়ার মূল অস্ত্র হলো কড়া সমালোচনা। যুক্তির যুদ্ধে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তো কমার কথা নয়। কিন্তু বড়ই নিরাশ হতে হয় যখন দেখি নির্মলেন্দু গুণের মতো মানুষ বলেন যে তিনি তাঁর সমালোচকদের প্রতি থুথু নিক্ষেপ করেন ( laugh at and spit on my critics. Msg 44257)।
এরপরেও কীভাবে ভালো থাকি আমরা?
০৯ অক্টোবর ২০০৭
তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া
Dr Pradip Deb. Lecturer in Health Physics. School of Human Life Sciences. University of Tasmania, Launceston, TAS 7250, Australia. [email protected].