আত্মঘাতী কুসংস্কার

প্রদীপ দেব  

সম্প্রতি আমার এক কাকা মারা গেছেন। তাঁর যক্ষা হয়েছিল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ধরা পড়লো তাঁর মাথায় একটা টিউমারও হয়েছিল এবং ব্রেন টিউমারের নিয়ম অনুসারেই তা দ্রুত বাড়ছিলো। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিসার পরামর্শই দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার আত্মীয় মানে কাকার ছেলে মেয়েরা এবং আরো অনেক আপাত শুভাকাঙ্খীর বিশ্বাস বিক্ষিপ্ত। তাঁরা চিকিসা বিজ্ঞানের পাশাপাশি কিছু তান্ত্রিকের শরণাপন্নও হয়েছিলেন। বাড়িতে থাকিনা বলে ঘটনাগুলো আমার অজানাই ছিল। কিংবা ইচ্ছে করেই আমাকে জানানো হয়নি। কাকার মৃত্যুর পর যা জেনেছি - তাতে দেখা যাচ্ছে কাকাকে চিকিসা বিজ্ঞানের আওতায় আনা হয়েছিল একেবারে শেষ অবস্থায়।  

যক্ষা রোগের প্রাথমিক লক্ষণ ধরা পড়ার পর স্থানীয় হাসপাতালে যোগাযোগ করে চিকিসা নেয়ার পর কাকার আত্মীয় স্বজনরা বলতে শুরু করলেন - কাকাকে বাণ মারা হয়েছে। যে সে বাণ নয়, একেবারে রক্তবাণ। রক্তের সম্পর্কের কেউ নাকি কাকার ক্ষতি করার জন্য জাদু টোনা করে এই বাণ মেরেছে। কাকা নিতান্তই দরিদ্র একজন মানুষ। তাঁর ক্ষতি করে আত্মীয়স্বজনদের কী উপকার হবে কে জানে। তবে এ ধরণের ব্যাপারে পাড়া প্রতিবেশীর বিশ্বাস অর্জন করতে সময় লাগে না। বাণ কাটার ব্যবস্থাও আছে। বিখ্যাত তান্ত্রিককে হাজির করা গেলো একজোড়া হালের বলদ বিক্রি করে। নানারকম জাঁকযজ্ঞের প্রহসনে গেলো আরো কয়েক হাজার টাকা। রক্তবাণ কাটা গেছে বলে মহাবাক্য উচচারণ করতে করতে কাকার গোয়াল থেকে একটি গাই গরু নিয়ে চলে গেলেন তান্ত্রিক সাধক। কাকা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেলেন আরো কয়েক ধাপ। প্রাণের সাথে সাথে ধনেও টান পড়লো মারাত্মকভাবে।  

এ ধরণের ঘটনা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এতটাই স্বাভাবিক যে শুনে আমাদের খুব একটা প্রতিক্রিয়া হয় না। আমরা যেন ধরেই নিয়েছি যে এসব তো ঘটবেই। শুধু আমার দরিদ্র কাকার বেলায় কেন - খুব বড় বড় মানুষের ক্ষেত্রেও তো দেখা যায় নানা রকম অবৈজ্ঞানিক কাজ কর্ম। এই তো সেদিন স্কয়ার হাসপাতালের সামনে গণদোয়া অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার রোগ মুক্তির জন্য। সারাদেশে এ ধরণের দোয়া, প্রার্থনা অবিরাম চলছে যে কোন ব্যাপারেই। সম্প্রতি দেশের খারাপ অবস্থার জন্যও দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান ব্যক্তি দায়ী করলেন স্বয়ং আল্লাহ্‌কে। আল্লাহ্‌ নাকি পরীক্ষা করছেন দেশের মানুষের। কয়েক বছর আগে জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন যখন একজনের মৃত্যু প্রসঙ্গে বলেছিলেন - আল্লাহ্‌র মাল আল্লাহ্‌ নিয়ে গেছেন কেউ কেউ প্রতিবাদ করে বলেছিলেন - তিনি দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করছেন। এখন আল্লাহ্‌ আমাদের পরীক্ষা করছেন কথাটা কি দায়িত্ব এড়ানোর পর্যায়ে পড়ে না? আসলে যুক্তিনির্ভর মানুষ মাত্রেই জানেন যে - অলৌকিকতার আশ্রয় মানুষ তখনই নেয় যখন লৌকিক ব্যাপারটা নিজের বিপক্ষে যায়।  

নানা রকম মানুষের নানা রকম সংস্কার আছে। অনেক দিন থেকেই চালু হয়ে আছে এসব সংস্কার। কোন কোন সংস্কারকে আমরা কুসংস্কার বলি, কোন কোনটাকে ভালো মন্দ কিছুই না বলে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখি। যেমন অনেকে ১৩ সংখ্যাটিকে এড়িয়ে চলেন। আনলাকি থার্টিন বেশ প্রচলিত একটি সংস্কার। কেউ এ সংস্কার মেনে চললে আমরা কেউ কিছু মনে করি না। কোরিয়ায় ৪ সংখ্যাটি হলো মৃত্যুর প্রতীক। সেখানে পারত পক্ষে কেউ চার সংখ্যাটি ব্যবহার করে না। লিফ্‌টে দেখা যায়  1, 2, 3, F, 5, 6 । এ ধরণের সংস্কার নিয়ে আমরা বড়জোর হাসি। কিন্তু খুব একটা আত্মঘাতী মনে করি না এদের। ভারতীয় ক্রিকেটারদের আঙুলে হাতে বাহুতে গলায় নানারকম সুতা, আংটি, তাবিজ, লকেট দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একটা উইকেট পেলে বোলারদের যেভাবে মাদুলিতে চুমু খেতে দেখি তাতে বড়জোর মনে করি যে ক্রিকেটারটি বড়ই সংস্কারাচ্ছন্ন। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে আমরা কিন্তু এই ক্রিকেটারকে বিশ্বাসের এই অন্ধত্বের জন্য বর্জন করি না। কিন্তু সকল কুসংস্কারই যে মাঝে মাঝে আত্মঘাতী হয়ে উঠে।  

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন। চট্টগ্রাম শহর থেকে যারা শাটল ট্রেনে ইউনিভার্সিটিতে আসা যাওয়া করেছেন তারা জানেন ট্রেনের অবস্থা। একদিন ট্রেনে ফিরছি ক্যাম্পাস থেকে। প্রচন্ড ভীড়। আমাদের কম্পার্টমেন্টের সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসেছে বেশ কয়েকটি মেয়ে। আমি গাদাগাদি ভিড়ে তাদের পেছনে বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে ট্রেন থামতে না থামতেই ধুপধাপ নামতে গিয়ে মেয়েদের একজনের আর্তচিকার। তার দুই পা চলে গেছে ট্রেনের নিচে, চাকার কাছে। প্লাটফরমের ধার আর ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের মাঝে আটকে আছে সে। স্বাভাবিক রিফ্লেক্স অনুসারে দ্রুত তার হাত ধরে টেনে তুলতে গিয়েই ধাক্কাটা খেলাম। আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা মেয়েটি চিকার করছে - “আপনি না, আপনি না, কোন মেয়েকে ডাকুন”। আশে পাশের মেয়েরা কেউ সাড়া দিচ্ছে না তার আহবানে। এ অবস্থায় কোন সাহসী মেয়েকে ডেকে এনে তাকে টেনে বের করার অর্থ হলো আরো অনেকক্ষণ সময়। ট্রেন এখানে থামে বড়জোর দু’মিনিট। এর মধ্যে ট্রেন যদি চলতে শুরু করে - আস্ত পা নিয়ে আর উঠতে হবে না তাকে। দু’বন্ধু মিলে তাকে টেনে প্লাটফরমের উপর তোলার পর মেয়েটির আবারো ধমক, “কেন আমার হাত ধরলেন আপনারা”? একটি  দুর্ঘটনা থেকে একজন মেয়েকে হাত ধরে টেনে উদ্ধার করার মধ্যে কী অপরাধ থাকতে পারে আজও বুঝতে পারিনি। বোরকা পরা মেয়েটি কি কোরাণের বাণী অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছেন যে বেগানা পুরুষের স্পর্শে পাপ হয়। এ কী ধরণের সংস্কার একজন ইউনিভার্সিটি পড়া স্টুডেন্টের! 

সাপের কামড়ে ডাক্তারের বদলে ওঝার শরণাপন্ন হয় এখনো বেশির ভাগ মানুষ। সাপ সম্পর্কে কত রকম কুসংস্কারই না চালু আছে আমাদের মাঝে। সাপুড়েরা নানারকম আষাঢ়ে গল্প করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছে নিয়মিত। বীণ বাজালে সাপ ছুটে আসে একথা বিশ্বাস করার লোকের অভাব নেই। আর সাপ সম্পর্কে অদ্ভুত সব অসত্য গল্পে ভরা আমাদের লোককাহিনীগুলো, রূপকথাগুলো। আর সিনেমা গুলোর তো কথাই নেই। এসব পড়ে দেখে শুনে সাপ সম্পর্কে আমাদের কুসংস্কার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে - সাপে কামড় দিলে সোজা যে হাসপাতালে নেয়ার দরকার তা না করে ওঝার হাতে সময় সঁপে দিই। নির্বিষ সাপে কামড়ালে বেঁচে যাই - প্রাথমিক চিকিৎসায় - যা ওঝা তাদের নানারকম ভড়ং সহ দিয়ে থাকে। আর বিষধর সাপে কামড়ালে ওঝাও যখন কিছু করতে পারে না - তখন ডাক্তার ডাকি। কখনো বাঁচি - বেশির ভাগই মরি। কারণ বিষের ক্রিয়া ততক্ষণে মারাত্মক হয়ে ওঠে। আমাদের আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও ওঝার ডাক পড়ে - এর চেয়ে আত্মঘাতী সংস্কার আর কী হতে পারে।  

সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় সিডরে ভোলার অনেক গুলো ইউনিয়নে নিজেদের ঘর ছেড়ে বের হয়নি বাড়ির বউরা। সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিলেও বাড়ির বউরা ঘরে রয়ে গিয়েছিল এই বিশ্বাসে যে “ঘরের মইধ্যে বউরা না থাইকলে হেই ঘর থাহেনা”। যুগান্তর পত্রিকায় এ খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল ৪/১২/০৭ তারিখে। সিডর কাউকে রেহাই দেয়নি সেখানে। কারণ ঘরে বউ থাকলো কি থাকলো না তাতে কিছু যায় আসে না প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাছে। কিন্তু এই আত্মঘাতী কুসংস্কার দূর করা কি যায় এত সহজে? বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে বসে থাকার শক্তি যোগাচ্ছে আত্মঘাতী সব কুসংস্কার।  

অনেক গ্রামে আমি দেখেছি - সন্তান জন্মাবার পর মা ও শিশুকে প্রায় এক মাস থাকতে দেয়া হয় আঁতুড় ঘরে। এই আতুঁড় ঘর হলো বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে নোংরা একটি ঘর। এই একমাস প্রসূতি মাতাকে এই আঁতুড় ঘরে প্রায় বন্দী করে রাখা হয়, অস্পৃশ্য করে রাখা হয়। এক মাস নাকি মা ও শিশু অপবিত্র থাকে। অথচ এই সময়টাতে মা ও শিশুর থাকা দরকার সবচেয়ে আরামে, সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন অবস্থায়। কারণ যে কোন সুযোগেই নানারকম সংক্রমণ ঘটতে পারে মায়ের এবং নবজাতকের। কিন্তু কুসংস্কারের কারণে প্রসূতি মাতা ও নবজাতককে কাটাতে হয় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে যা পরবর্তীতে তাদের স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।  

আমাদের সংস্কার চিন্তা প্রবল। দিনে দিনে তা আরো বাড়ছে। কিন্তু যতসব কুসংস্কারের ডিব্বা গলায় বেঁধে সযতনে আগলে রেখে কতটুকু এগিয়ে যাওয়া সম্ভব আমাদের? আমাদের দেশে লোডশেডিং-এ যত মোমবাতি জ্বলে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে মোমবাতি জ্বলে মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোড়া ফকির দরবেশ আউলিয়াদের মাজারে। এই মানত করা মোমবাতির আলোতে মনের কুসংস্কারের অন্ধকার আরো গাঢ় হয়, আমরা এগিয়ে চলি অন্ধকারের দিকে। এখন আমাদের দরকার একটি ঝকঝকে নতুন বিজ্ঞান-প্রজন্ম। সংস্কারে মসৃণ হওয়ার দরকার নেই, যুক্তিতে রুঢ় হলেই হলো।

০৮ এপ্রিল ২০০৮ 

তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া।

 

Dr Pradip Deb. Lecturer in Health Physics. School of Human Life Sciences. University of Tasmania, Launceston, TAS 7250, Australia. [email protected].