যুক্তিবাদের জয় ও আমাদের করণীয়

প্রদীপ দেব  

মুক্তমনা অভিজি রায়কে সাধুবাদ জানাচ্ছি তাঁর যুক্তিবাদীর বিজয় - রিজন হ্যাজ ওন দ্যা ডে লেখাটির জন্য ও ইউটিউবের চমকার ভিডিও লিংকগুলোর জন্য। অন্ধবিশ্বাস আমাদের সমাজের সকল অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় অবস্থানের মধ্যেই উপস্থিত আছে। এক্ষেত্রে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে মোটামুটি সার্বজনীন বলা চলে। কয়েকটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তিও অন্ধবিশ্বাসের ডোবায় আটকে আছেন অনেক ব্যাপারে। সোজা সাপ্‌টা কথায় বললে তো বলতেই হয় যে, যাঁরা সৃষ্টিকর্তার বা সৃষ্টিকর্ত্রীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন - তাঁরা সবাই কোন না কোন বিশ্বাসের ব্যাপারে অন্ধ। এবং মজার ব্যাপার হলো এই - অনেক ব্যাপারে তাঁরা যে স্ববিরোধীতায় ভোগেন তা নিজেরাই বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না।  

অভিজি রায়ের কল্যাণে ইন্ডিয়া টিভির প্রোগ্রামটি দেখলাম। তান্ত্রিক শক্তি বনাম বিজ্ঞান। পন্ডিত সুরিন্দর শর্মা বনাম Rationalist International এর প্রেসিডেন্ট স্যান্যাল এডমারাকু। যুক্তি যদি সঠিক হয় - তাহলে ফল কী হবে তা দেখার জন্য বসে থাকতে হয় না। জানাই ছিল যে সুরিন্দর শর্মা’র মন্ত্রশক্তি কিছুই করতে পারবে না স্যান্যালকে। যেরকম হওয়া স্বাভাবিক - সেরকমই হলো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু কয়েকটি ব্যাপার এখানে অবশ্যই উল্লেখ করার দরকার আছে। ব্যাপারগুলো আপাত দৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও - আসলে এখানেই লুকিয়ে থাকে মারাত্মক সব প্রতারণার কৌশল।

 সুরিন্দর শর্মা তান্ত্রিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য যে চ্যালেঞ্জটি দিয়েছিলেন তা হলো তিন মিনিটেই তিনি স্যান্যালকে মেরে ফেলতে পারবেন শুধুমাত্র মন্ত্র উচচারণ করে। তারপর তিন মিনিটের জায়গায় প্রায় কয়েক ঘন্টা ধরে যা করলেন তা নিছক ভাওতাবাজীর চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাতে যে মন্ত্রগুলো তিনি উচচারণ করলেন - তার কয়েকটি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ “শ্রী শ্রী চন্ডী” থেকে নেয়া। [চন্ডীর আগে দু’বার শ্রী কেন বলতে হয় তার কোন সঠিক উত্তর আমি খুঁজে পাইনি। অনেক স্বঘোষিত পন্ডিতকে  জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাঁরা এলোমেলো ভাবে যা বলেছেন তাতে শুধু তাঁদের মূর্খতাই প্রমাণিত হয়েছে।] “যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ” এ মন্ত্রটি উচচারিত হয়েছে অনেকবার। বাকী যেগুলো তার বেশির ভাগই অর্থহীন কিছু সংস্কৃতরূপ শব্দাংশ। “যা দেবী সর্বভূতেষু ...” মন্ত্রটি আসলে অনেকবার করে লেখা আছে চন্ডীতে। হিন্দুদের দেব দেবীরা ভীষণ আত্মপ্রেমী। তাঁদের খুব করে প্রশংসা না করলে তারা সন্তুষ্ট হন না। তাই এই মন্ত্রগুলোতে দেবী দুর্গার নানারকম প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে তিনি শক্তিরূপে বিরাজ করেন, তিনি মাতৃরূপে বিরাজ করেন, তিনি দেবী রূপে বিরাজ করেন ইত্যাদি। এখানে পন্ডিত সুরিন্দর শর্মা সেই শক্তিরূপী দেবীর প্রশংসা সূচক মন্ত্র পাঠ করে যুক্তিবাদী স্যান্যালকে খুন করতে চেয়েছেন। পন্ডিতের সাহস আছে বটে। কিন্তু আসলেই কি তিনি নিজে শুধুমাত্র মন্ত্রশক্তির উপর বিশ্বাস রাখেন? মোটেই না। মন্ত্র হলো সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। আসল খুন করার জন্য সুরিন্দর শর্মারা বস্তুজগতেরই আশ্রয় নেন। প্রবীর ঘোষের লেখাগুলো যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন কীভাবে তাঁকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে অনেকবার।

 আলোচ্য অনুষ্ঠানটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা লক্ষ্য করেছেন যে সুরিন্দর শর্মার একটি হাত সব সময় স্যান্যালের মাথায় চোখে কপালে ঘুরছিল। স্যান্যাল বাধা দেয়াতে সুরিন্দর এটাকেই তার মন্ত্রের নিস্ফলতার কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছে। হাতে ক্লোরোফর্ম ইত্যাদি নিয়ে আক্রমণ করেন অনেক সময় এই সব তান্ত্রিকরা - অনেকটা আমাদের দেশের অজ্ঞানপার্টির মতো। আবার রাতের বেলা যে যজ্ঞ করা হলো তাতে যে ধোয়াঁ তৈরি করা হলো তাও বিপজ্জনক। যে কোন বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করে নেয়া অসম্ভব নয়। আবার সে ধোয়াঁ একটি পাখার মত জিনিস দিয়ে সান্যালের নাকের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছিলো। টিভি স্টুডিওতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সান্যাল যে সুযোগ পেয়েছেন সবকিছু পরীক্ষা করে নেয়ার - বাইরের সুরিন্দর শর্মাদের পরিবেশে তা সম্ভব নয়। সেখানে সুরিন্দর শর্মারা যে কী কৌশল অবলম্বন করতে পারে তার জন্য প্রস্তুত না থাকলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

 সুরিন্দর শর্মারা যুক্তিবাদীর চেয়ে অনেক বেশি সংগঠিত। এবং তারা নির্লজ্জ মিথ্যাবাদী। অনুষ্ঠানেই তো দেখলেন কত অজুহাত দেখালেন। তিন মিনিটের জায়গায় কয়েক ঘন্টা চেষ্টা করেও কিছু করতে না পেরে বললেন যে সান্যাল নিশ্চয়ই কোন দেবতায় বিশ্বাস করেন - এবং সেই দেবতা সান্যালকে রক্ষা করছেন। শেষ পর্যন্তও কিন্তু সুরিন্দর স্বীকার করেনি যে তার মন্ত্রের কোন জোর নেই। এক্ষেত্রে তাদের অজুহাতের শেষ নেই। কিছুদিন পর হয়তো বলা হবে - ঈশ্বর চান না যে তাঁর সৃষ্টির কোন ক্ষতি করা হোক। তাই ক্ষতি করতে গেলে তা কাজে লাগে না। কিন্তু উপকার করতে - যেমন রোগমুক্তি, লটারিতে ভাগ্য ফেরানো ইত্যাদি - মন্ত্রশক্তির তুলনা নেই।

 স্বামীর নপুংশকতার কারণে যাদের সন্তান হয়না তারা অনেক সময় তান্ত্রিক সাধকদের দ্বারা সন্তান লাভ করেন। কীভাবে করেন তা না বোঝার কোন কারণ নেই। তান্ত্রিকরা বেশির ভাগ দাঁড়িগোঁফের জংগলে নিজেদের চেহারা আড়াল করে রাখেন শুধুমাত্র ধরা পড়ার ভয়ে।

 এখন পরিস্থিতি যখন এই - আমরা কীভাবে এগোব? বা আমাদের কী করা দরকার? আসলে এর সোজা কোন উত্তর আমার জানা নেই। আমাদের লেখাপড়া করা দরকার। মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা দরকার। আমাদের নতুন প্রজন্মকে অন্ধবিশ্বাসের কালো ছায়া থেকে রক্ষা করা দরকার। কীভাবে? আমার নিজের ভেতর অন্ধবিশ্বাসের বীজ রেখে কি তা সম্ভব? আসলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিজের ভেতরের বিশ্বাস অবিশ্বাসকে আবিষ্কার করা একেবারেই অসম্ভব। একমাত্র সঠিক জানার মধ্য দিয়েই অজানাকে জয় করা সম্ভব। অলৌকিক ভাবে কিছু ঘটতে পারে না এ ব্যাপারটা বোঝাতে পারলেই হয়ে যায়। কিন্তু বড়ই কঠিন এ কাজ, বড়ই সময় সাপেক্ষ। কিন্তু তাতে কী? আমাদের কি হাল ছাড়লে চলে? আমরা যে আলোর পথের যাত্রী, আমরা যে মুক্তমনা।  

২ এপ্রিল ২০০৮

তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া

 

Dr Pradip Deb. Lecturer in Health Physics. School of Human Life Sciences. University of Tasmania, Launceston, TAS 7250, Australia. [email protected].