জয় বাবা পশুনাথ

বন্যা আহমেদ

 

 

- আই তৃষা – প্যাঁচার মত মুখ করে বসে আছিস কেন?

- প্যাঁচা? প্যাঁচা মানে কি?

-owl, গাধা একটা...

- গাধা আসলো কোথা থেকে?

 

এরকম কথাবার্তা প্রায়ই হয় তৃষার সাথে আমার আর অভিজিতের। সেদিন তো ও আমার বাবাকে বলেই বসলো, ‘ নানা, মা আমাকে কালকে ছাগলের বাচ্চা বললো, তার মানে তো মা হচ্ছে ছাগল, আর তুমি হচ্ছো ছাগলের বাপ।’  আমার বাবা বেচারা কি আর বলবে, হেসে বললো, ‘হ্যা নানু,  মার কথা অনুযায়ী তো ব্যাপারটা তাইই দাঁড়ায়।’ ১১ বছর বয়স তৃষার, বেশ কিছুদিন ধরেই ও একটা কথা বলে – ‘তোমরা বাংলায় বকা দেওয়ার সময় খালি পশু পাখি নিয়ে আসো কেন? যেমন,  ছাগলের বাচ্চা তো একটা খুবই কিউট ‘এনিম্যাল’– এরা আবার কি দোষ করলো? এদের নাম নিয়ে বকো কেনো? এটা একটা ‘ডিস্ক্রমিনেশান’। ও যতবারই এটা বলে ততবারই আমি আর অভিজিত মহা আনন্দে ওর উপরে ঝাপিয়ে পরে পলিটিকাল ব্লাক্-মেইলিং করি ‘তোদের কাছে তো আরেক দেশে গিয়ে মানুষের উপর  ৫০০ পাউন্ডের বোমা ফেলে আসলে কোন অসুবিধা হয় না, আর আমরা পশুপাখির নাম করে একটু গালি দিলেই ওটা হয়ে যায় ‘ডিস্ক্রমিনেশান’, হিপোক্রেট কোথাকার...’।

 

কিন্তু সেদিন হঠা করেই মনে হল, আসলেই তো, আমাদের ভাষার এত ‘পশুপাখি-প্রীতি’ কেন? আমরা কারণে অকারণে পশু পাখি নিয়ে গালিগালাজ করি, ব্যাপারটা তো বেশ ভ্যাজাইল্যা। ভেবে দেখলাম – তাইতো - বদ পাবলিকরে আমরা বলি ‘জানোয়ার’। অত্যাচার আর নির্যাতনকে বলি ‘পাশবিক’।  কিছুক্ষণ মুখে মুখে গাধা, গরু, ছাগল, শুয়োর, বান্দর, হনুমান, ভেড়ার পাল বলতে বলতে, লেখার জন্য খাতা কলম আনতে  দৌড়ালাম, কি কান্ড, পাতাটা তো ভরে গেল, বিভিন্ন রকম পশু পাখিময় গালাগালিতে...। আর ওদিকে  অভিজিতের তো আনন্দ আর ধরে না, গালি দেওয়ার সুযোগ পেয়ে খুশীতে নাচতে নাচতে বলতে  থাকলো, ‘কুত্তার বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা, হারামীর বাচ্চা... লাগায় দাও’। আমি বলে উঠলাম, ‘আরে  হারামী তো কোন পশু হল না... ‘

 

- আরে হইলো না তো কি হইছে? হইলেই হওয়ায় দেওন যায়। হারামী মানে হইল কাউঠা পাবলিক। আর কাউঠা হইল গিয়া কচ্ছপের প্রতিশব্দ।

 

- কাউঠা আর হারামী কবে এক হইল?

 

- আরে হইল আরকি। ‘বক’ যদি ধার্মিক হয়ে ‘বক ধার্মিক’ হতে পারে  ‘হারামী বকচ্ছপও’ হতে পারে। খচ্চরের মত গালি দেওয়া নিয়া না কথা।  আর তা ছাড়া হারামী আইছে ‘হারাম’ থিকা। আর হারাম কি? ওই যে  নিষিদ্ধ প্রানী - শুয়োর। দেখো, শেষ মেষ পশুতে আইস্যাই ঠেকলো।

 

এই ধরণের জিনিস আর কি আছে?

 

আছে ধর ... এই যে আমার শরীরটা হাতির মত বিশাল হয়ে যাচ্ছে বলে প্রত্যেকদিনই খোঁটা দিচ্ছ – কোথায় হাতী আর কোথায় অভিজি। তোমার চিল্লাচিল্লির উত্তর না দিলেই বল, আমার নাকি গন্ডারের চামড়া, চামড়ার পুরুত্বের সাথে বৌদ্ধিক সংবেদনশীলতার সম্পর্কটা কি ভাই?

 

কারও চলাফেরা, ব্যবহার, চেহারা নিয়ে কটুক্তি করার সময় তো আমাদের ভাষায় পশুপাখি থেকে শুরু করে কীট পতঙ্গ পর্যন্ত কিছুই বাদ পড়ে না। নর্দমার কীট থেকে শুরু করে ছুঁচোর মত মুখ, ঘোড়ার মত দেখতে, ভিজা বিড়াল, গাছে ঝোলা বাদর, বিচ্ছু, শিয়ালের মত ধূর্ত, ‘ভ্যাদা মাছের’ মত মুখ,  কেঊটে সাপের মত বিষাক্ত, মৌমাছির মত হুল ফোঁটানো কথা, পাঠার মত গায়ের গন্ধ, বাজ পাখির মত দৃষ্টি, চিলের মত ছো মেরে কেড়ে নেওয়া... সবই আছে। আমাদের বাগধারায় আছে ‘কই মাছের’ প্রাণ, ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্ক, ‘ভুষুণ্ডির কাক’, কিংবা ‘বুড়ো শালিকের’ ঘাড়ে রো।  

 

আমার লেখা নিয়ে ছোট বেলায় বাবা বলত – হাতের লেখা নাকি ‘কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং’। হাতের লেখার সাথে বেচারা কাক আর বকের সম্পর্ক কোথায় তা আজো আমার বোধগম্য হল না।  আমরা ‘ব্যাঙের মত’ গাল ফুলাই, ‘গজেন্দ্র গমনে’ হাটি,  ‘অসুইখ্যা মুরগীর’ মত ঝিমাই, ‘ষাঁড়ের মত’ চ্যাঁচাই, হায়েনার মত হাসি,  শুয়োরের মত ঘো ঘো করি, উটের মত চলি, নাইলে  ‘তীর্থের কাকের’ মত বসে থাকি। এমনকি দেয়ালে রাজনৈতিক শ্লোগান লিখতে গেলেও –‘চিকা মারি’।

 

আমাদের ঠাকুরমার ঝুলিতে কিংবা পৌরানিক কাহিনীতেও জন্তু জানোয়ারের ছড়াছড়ি। এখানে আছে ‘শিয়াল পন্ডিত’, ব্যাঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, টোনা-টুনি, গরুর, জটায়ু, রাম গরুরের ছানা। ‘হাই প্রোফাইল’ জন্তু জানোয়ারেরও কিন্তু অভাব নাই। হিন্দু ধর্মে তো গরুকে মায়ের আসনে বসিয়ে রাখা হয়েছে, হিন্দু পুরানে দেবদেবীদের আছে নানা বাহন – সবই পশুপাখি –ময়ুর, লক্ষী প্যাঁচা, ইঁদুর, হনুমান কত কি, এই মুহুর্তে সবগুলা মনেও আসতেছে না। মা দুর্গাও ‘মহিষাসুর’ বধ না করে পারেন না।  আমাদের মহানবী আবার ‘বোরাকে’ চড়ে টাইম ট্র্যভেল করেন বলে শুনি।

 

প্রশংসা করার সময়েও আমরা জন্ত-জানোয়ার আনি, তবে তার সংখ্যা বোধ হয় খুব বেশী নাবাঘের বাচ্চা হওয়ার ইচ্ছা অনেকের আছে তা জানি, কিংবা কারো কারো আছে সিংহের সাহস, তার উপর আছে মোঘল সম্রাট আকবরের সিংহের গদি – সিংহাসনপ্রজাপতির মত ফুরফুরা কিংবা 'চপলা হরিনী' বলতেও বাধা নেইপজিটভ ভাবে আর কি কিছু বলি? মনে করতে পারছি না এখনপজিটিভ জিনিস আমদানীর দায়িত্ব মুক্তমনার লেখকদেরশুধু পজিটিভ না, পশুতালিকার লিস্টি টা যে দিক দিয়ে ইচ্ছা বড় করণের গুরুভারও আপনাদের উপরে আরোপিত হইলঅন্য ভাষাতেও এইরম 'পশুপ্রীতি', 'পাখি-প্রীতি', 'কীটপতঙ্গ-প্রীতি' কি আছে? থাকলে সেই শ্রুতিমধুর শব্দভান্ডার জানাতে ভুলেন না কিন্তু

 

বহুদিন কিছু লেখা হয় নাঅনেক গুরুগম্ভীর সব টপিক নিয়ে ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত এই ফালতু লেখাটা লিখে শেষ করে আর মুক্তমনায় পাঠিয়ে দিয়েই –'নিজের খেয়ে বনের মোষ' তাড়ালাম আর কি! তৃষাটা বাংলা পড়তে পারে না দেখে এ যাত্রা বেঁচে গেছিনইলে আমাদের ‘পশুপ্রেম’ নিয়ে তার ‘হাইপোথিসিস’টাই থিওরীতে পরিণত করে ছাড়ত।   

 

জয় বাবা পশুনাথ!

সেপ্টেম্বর ৩, ২০০৮

 


বন্যা আহমেদ, আমেরিকা প্রবাসী লেখক পেশায় কম্পিউটার প্রকৌশলী সর্বশেষ বই – ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ (২০০৭)তার বিভিন্ন প্রবন্ধ বাংলাদেশের সাপ্তাহিক ও দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে ইমেইল : [email protected]