নাচনেওয়ালী

ফরিদ আহমেদ 

দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ী চালাচ্ছে রাসেল। মেজাজ ভয়াবহ রকমের খারাপ। মেজাজটাকে স্বাভাবিকে আনতে মনে মনে এক থেকে একশ পর্যন্ত গোনা শুরু করেছে সে। কোথায় যেন পড়েছিল প্রচন্ড রাগ হলে মনে মনে সংখ্যা গুনলে নাকি রাগ কমে যায়। পচাত্তর পর্যন্ত গুনে ফেলেছে তবু রাগ কমছে না। কমছে না দেখেই আরো রাগ বেড়ে যাচ্ছে তার। অন্য কোন সময় হলে অবশ্য এতো ঝামেলা করতে হতো না। বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে দুনিয়ার যত খারাপ খারাপ গালি আছে সেগুলোর তুবড়ি ছুটিয়ে রাগ মিটিয়ে নিতো। মনে মনে অবশ্য রাজ্যের গালাগালি করছে, কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। শব্দ করে গালি দিতে না পারলে গালির কার্যকারিতাও থাকে না মনে হয়। এখন সেটা করা যাচ্ছে না বলেই যত সমস্যা। 

সমস্যাটার উস হচ্ছে তার পিছনের সিটে বসা স্বল্পবসনা স্বর্ণকেশী সুন্দরী নাচনেওয়ালীটি। ন্যাংটো নাচের ক্লাব লেপার্ড এর সামনে থেকে আধা ন্যাংটো এই ছুকড়িকে তুলেছে রাসেল। যাবে আরেক ন্যাংটো ক্লাব চিতায়। বেশবাস দেখেই বোঝা যাচ্ছে লেপার্ডের নাচানাচি শেষ করে চিতায় উদোম হয়ে নাচতে যাচ্ছে। তাতে অবশ্য রাসেলের মেজাজ খারাপ হওয়ার কিছু নেই। দুনিয়ার সব খারাপ কাজের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে হবে এমন কোন দিব্যি তাকে কেউ দেয়নি। কে কোথায় ন্যাংটো হয়ে নাচছে তাতে তার কিছুই যায় আসে না। নিজের সমস্যা নিয়েই আস্থির হয়ে আছে সে। অন্যের কায়-কারবার দেখার সময় কোথায়। 

ছুকড়ি যখন গাড়ীতে উঠেছে তখনই  ভুর ভুর করে মদের গন্ধ পেয়েছে রাসেল। সেটাও কোন সমস্যা নয়। মাঝে মাঝে রাতে যখন ট্যাক্সি চালায় তখন বেহেড মাতালদেরকেও যাত্রী হিসাবে নেওয়ার অভিজ্ঞতা তার আছে। তেমন বড় ধরনের কোন সমস্যাতেই সে কখনো পড়েনি। একবার এক মাতাল অবশ্য টাকা না দিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু পরের দিন ওই বাড়ীতে যেয়ে বলতেই আগের রাতের সেই মাতাল লোকটাই বার বার ক্ষমা চেয়ে দ্বিগুন ভাড়া দিয়ে দিয়েছিল রাসেলকে। আরেকবার এক মাতাল বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিল সারা গাড়ী। কার ওয়াশে নিয়ে পরিষ্কার করতে গাটের অনেকগুলো টাকাই খরচ হয়ে গিয়েছিল রাসেলের। সেই সব সমস্যার তুলনায় এই ছুকড়িতো কিছুই করছে না। 

গাড়ীতে উঠার পর থেকেই অসম্ভব বাজে ব্যবহার করা শুরু করেছিল ছুকড়িটা। আর সেটাই রাসেলের মেজাজ খারাপের মূল কারণ। রাসেলের সম্ভাষনের বিপরীতে খিটখিটে মেজাজে চিতায় যেতে আদেশ দেওয়া থেকে এর সূত্রপাত। কোন কারণে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ছিল নটি সুন্দরীর। হারি আপ, হারি আপ বলে অনবরত চিকার করছিল সে। অফিস ছুটির সময় বলে রাস্তায় অসম্ভব ভিড়। দক্ষ হাতে এ লেন ও লেন করে ট্যাক্সিটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল রাসেল। তার মধ্য দিয়ে পেছন থেকে তারস্বরে চেচিয়েছে মেয়েটা।  

ইউ ফাকিং ইডিয়ট, মুভ ফাস্টার। শিট, আই এ্যাম গোনা বি লেট। ডোন্ট ইউ নো হাউ টু ড্রাইভ? হু গেভ ইউ দ্য ফাকিং লাইসেন্স 

তোর বাপে দিছে, মাগী। রাসেল মনে মনে বলেছিল। মুখে অবশ্য বলেছিল, আই এ্যাম ট্রাইং ম্যাম। টু মেনি ট্রাফিক্স টুডে। প্লিজ, হ্যাভ পেশেন্স 

ট্রাফিক সিগন্যাল হলুদ হয়ে আসতেই ট্যাক্সিটাকে এক ইন্টার-সেকশনে থামিয়েছিল রাসেল। আর পায় কে? নাচনেওয়ালীর মুখে যেন খই ফুটতে শুরু করেছিল। হোয়াট আর ইউ ডুয়িং, এ্যাসহোল? হোয়াই দ্য হেল ইউ স্টপড? হোয়াই ডিডনট ইউ রান দ্য ইয়েলো লাইট? ফাকিং থিফ। ইউ ওয়ান্ট টু স্টিল মাই ফাকিং মানি 

তোর গতর বেচা টাকা চুরি করার কোন ইচ্ছাই আমার নাই। ওই টাকায় আমি থুথু দেই। তোর টাকা তুই মশলা মাখায়া খা গিয়া। মনে মনে বিচ্ছিরি একটা গালি দিয়ে বলেছিল রাসেল। বাইরে অবশ্য পাথরের মতো ভাবলেশহীন মুখে নর্তকীর গালি হজম করেছিল সে। কাস্টমার গালি দিলেও হাসিমুখে তা হজম করতে হবে এটাই এই দেশের নিয়ম। 

যে শালারা এই দেশে কাস্টমারদের ঈশ্বরের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে তাদের চোদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়ে রাসেল। সামারের সময় অনেক বাঙালিদের ফ্যান বা এয়ারকুলার কিনে কয়েক মাস ব্যবহার করে ওয়ালমার্টে ফেরত দিতে দেখেছে রাসেল। স্যার স্যার বলে ওই সব ছ্যাচড়দের পুরো টাকা ফেরত দিয়ে দেয় ওয়ালমার্টের গর্ধভগুলা। নিজের অদৃষ্টকেও গাল দিতে ছাড়ে না রাসেল। কোন দুঃখে যে ক্যানাডায় এসেছিল। এই মরার দেশে কেউ আসে। পড়ার খরচ যোগানোর জন্য হেন কোন কাজ নেই যা সে করেনি। ভয়ংকর ঠান্ডার মধ্যে ফুল সার্ভিস গ্যাস স্টেশনের এটেনডান্টের কাজ করেছে সে। ক্যানাডিয়ান টায়ারের সামনে দাঁড়িয়ে সারাদিন ধরে হটডগ বেচেছে একসময়। মেক্সিকান শ্রমিকদের সাথে দিনের পর দিন লেমিংটনের টমাটো ক্ষেতে কাজ করারও অভিজ্ঞতা আছে তার। ভাগ্য ভাল ক্যাব লাইসেন্স করেছিল। এক বাঙালি ক্যাব ড্রাইভার সপ্তাহে দুই দিন তার গাড়ী রাসেলকে চালাতে দেয়। 

ট্রাফিক সিগন্যালের গালিগালাজের পর থেকেই কি কারণে যেন চুপ মেরে গেছে মেয়েটা। রাসেল রিয়ার ভিউ মিররে দেখার চেষ্টা করে তাকে। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে স্বর্ণকেশী। মুখের একপাশটা শুধু দেখতে পায় রাসেল। ডিম্বাকৃতির অপূর্ব সুন্দর একটা মুখ। এক মাথা ঢেউ খেলানো সোনালী চুল আছড়ে পড়ে আছে সুগঠিত নগ্ন কাঁধে। সুডৌল স্তনদ্বয়ের অর্ধেকটাই উদ্ধত ভঙ্গিতে উন্মুক্ত। গাড়ির দুলুনির সাথে তির তির করে কাঁপছে সে দুটো। মনে হচ্ছে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে এক জোড়া অবাধ্য কবুতরকে। সুযোগ পেলেই বাঁধন কেটে ডানা মেলে উড়াল দেবে আকাশে। অন্য সময় হলে হয়তো রাসেল তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতো এই অসাধারণ সৌন্দর্যকে। কিন্তু মেজাজ গরমের কারণে এখন আর তা হচ্ছে না। এরকম একটা সুন্দরী মেয়ের মুখ দিয়ে এরকম বিচ্ছিরি সব গালিগালাজ কি করে বের হয় তাই নিয়ে বরং গবেষণা শুরু করে দেয় সে। 

চিতার সামনে আসতেই ইচ্ছা করেই সজোরে ব্রেক করে রাসেল। প্রচন্ড ঝাঁকি খেয়ে আকাশের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নেয় মেয়েটা। সাপের মত হিস হিস করে গালি দেয় রাসেলকে, ফাক ইউ 

বাসায় আসিস, হারামজাদী। তখন দেখবো কে কারে কি করে। থমথমে মুখে মনে মনে পালটা উত্তর দেয় রাসেল। 

মিটারে সাড়ে চৌদ্দ ডলার ভাড়া উঠেছে। পার্সের ভিতর থেকে একটা বিশ ডলারের নোট বের করে দলা পাকিয়ে সিটের উপর দিয়ে রাসেলের কোলে ছুড়ে দেয় মেয়েটা। কাটা কাটা স্বরে বলে কিপ দ্য চেঞ্জ। তারপর পেভমেন্টে নেমে দড়াম করে গাড়ীর দরজা বন্ধ করে দেয় সে।  

তোর চেঞ্জের আমি নিকুচি করি, বেশ্যা মাগী। মনে মনে কঠিন প্রতিজ্ঞা করে রাসেল। একদিন লেপার্ড বা চিতায় যেয়ে এই নাচনেওয়ালীর নাচ দেখবে সে। উলঙ্গ হয়ে ছুকড়িটা যখন তার টেবিলের সামনে আসবে তখন সে তার বিশেষ অঙ্গে বিশ ডলারের একটা নোট গুজে দিয়ে উদার স্বরে বলবে, কিপ ইট 

এখন গলা ছেড়ে গালি দিলে আর শুনবে না এই ভরসায় ঘাড় ঘুরিয়ে রাসেল তার জানা সবচেয়ে কুসিত খিস্তিটা দিতে গিয়ে মাঝপথেই থমকে গেলো। কোন এক আশ্চর্য উপায়ে মেয়েটা যেন জানতো রাসেল কি করবে। ঠিক একই সময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সেও তাকিয়েছে রাসেলের দিকে। মেয়েটার চোখে চোখ আটকে যায় রাসেলের। সাগরের মতো ঘন নীল দুটো মায়াময় ডাগর চোখে গভীর বিষাদ। এতো দুঃখী চোখ মানুষের হয় কি করে? চোখ নামিয়ে নেয় রাসেল।  

রাসেলের দিকে পিছন ফিরে পা টেনে টেনে বিষন্ন ভঙ্গিতে মেয়েটা এগিয়ে যেতে থাকে চিতার প্রবেশ মুখের দিকে। 

মায়ামি, ফ্লোরিডা                                                                       [email protected]

===============================================

মুক্তমনার কো-মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।