তৃতীয় পর্ব

নোটবুক এবং একজন বিজ্ঞানীর প্রতিকৃতি

ফরিদ আহমেদ

(পর্ব-৪)

লিওনার্দোর বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকার (৩) 

কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদ দিলে (যেমন রজার বেকন), রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকেই লোকজনের চিন্তাশক্তি ঝিম মেরে ছিল ক্রিশ্চিয়ান ডগমা দিয়েই পরিচালিত হতো তাদের সকল চিন্তা-ভাবনা এই ডগমা অনুযায়ী মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্ট সামান্য প্রাণী বই আর কিছুই নয় প্রাকৃতিক শক্তি এবং ঈশ্বরের ইচ্ছাই এই মহাবিশ্বের সব কিছু সেই জগতে মানুষের উপস্থিতি একেবারেই তাপর্যহীন একটি বিষয় এই ধরনের চিন্তা-চেতনা বদ্ধ সমাজ গড়া ছাড়া আর কীই বা করতে পারে   

রেঁনেসার চিন্তাবিদরা নিজেদেরকে তুচ্ছ এবং তাপর্যহীন ভাবাতো দূরের কথা বরং কীভাবে মানুষের ধীশক্তিকে সংরক্ষণ এবং পুষ্ট করা যায় সেই ধারণাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এই পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতেই, আমরা দেখি যে প্লেটোনিক দর্শন বিকশিত হচ্ছে মানব সদগুণাবলীতে, যা ছিল সক্রিয়  মানবতাবাদের মূল বৈশিষ্ট্য প্লেটোর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল যে, মানব সম্প্রদায় প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমেই ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে পারে প্লেটোর জন্য এটাই ছিল অনুপ্ররণার ভিত্তিমূল, এবং তা রেঁনেসার সর্বোচ্চ মেধাবী ব্যক্তিদের চিন্তার মূল নিয়ামক হিসাবে পরিগণিত হয়ে উঠেছিল লিওনার্দো তার ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ভিন্নমার্গী থাকা সত্ত্বেও, প্লেটোনিক এই আদর্শকে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যদিও তিনি প্লেটোনিক দর্শনের অনেক কিছুর সাথেই দ্বিমত পোষণ করতেন ওই সময়ের অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিই সদগুণাবলীর ধারণাকে গোঁড়া খ্রীষ্টীয় মতবাদের সাথে একীভূত করে ফেলেছেন, যদিও এর উস ছিল মূলতঃ চিরায়ত সভ্যতা 

লিওনার্দো সক্রিয় মানবতাবাদের অত্যন্ত আধুনিক ব্যাখ্যাকে ধারণ করতেন তার কাছে সদগুণাবলী প্রচলিত ধর্মের চেয়ে আলাদা কিছু ছিল তিনি একে দেখেছেন সম্পূর্ণ মানবীয় গুণাবলী হিসাবে যা ব্যক্তিকে প্রকৃতির একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে দেয়  

মানব চাহিদা হিসাবে প্রাচীন জ্ঞানের হস্তগতকরণ থেকে প্রাজ্ঞতার বিকাশকে আমরা পুরোপুরি বুদ্ধিবৃত্তিক দিয়ে অনুসৃত পথ বলে চিত্রায়িত করতে পারি মানুষের সক্ষমতা সম্পর্কে নয়া বোধ এবং ঈশ্বরের বিশ্বজগতে মানবতার ভূমিকার নতুন ইতিবাচক বিন্যাসের কারণে এটা জগতকে নতুনভাবে উপলব্ধি করার রাস্তা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীর ইউরোপে বস্তুজগতে যে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা যে শুধুমাত্র এই কারণেই সংগঠিত হয়েছে বলাটা সংগত হবে না  এই বিশাল পরিবর্তনের জন্য আরো অনেক জায়গাতেই পরিবর্তন আসতে হয়েছিল এর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে স্থানান্তরযোগ্য মুদ্রাক্ষর আবিষ্কার এবং ছাপার ব্যাপক বিস্তার 

আমরা মনে করি থাকি যে, মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে জোহান গুটেনবার্গের দ্বারা ১৪৪৫ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে কোন একটা সময় কিন্তু এই ধারণা অতি-সরলীকরণ মাত্র মুদ্রণ অত্যন্ত প্রাচীন কৌশল খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে চীনারা এর ব্যবহার করতো  গুটেনবার্গের মূল কৃতিত্ব ছিল স্থানান্তরযোগ্য মুদ্রাক্ষর আবিষ্কার এর কারণে খুব সহজেই যে কোন মুদ্রণযন্ত্রের পক্ষে খুব সহজেই এবং অতি দ্রুত গতিতে বিভিন্ন লেআউট তৈরি করা সম্ভব ছিল 

কীভাবে প্রথম স্থানান্তরযোগ্য মুদ্রাক্ষর ব্যবহার হলো তার বিশদ বর্ণনা খুবই চিত্তাকর্ষক কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিকাশের ইতিহাসে কীভাবে মুদ্রণ ব্যবস্থা সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লো এবং কীভাবে এক নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ তৈরিতে সক্ষম হলো সেটাই সবচেয়ে বেশি তাপর্যপূর্ণ 

গুটেনবার্গের বিখ্যাত বিয়াল্লিশ লাইন বাইবেল তৈরি হয়েছিল ১৪৫৫ সালের দিকে এর তিন বছরের মধ্যেই স্ট্রাসবোর্গে ছাপাখানা তৈরি হয়ে যায় ১৪৮০ সালের মধ্যে এক ডজনেরও বেশি ছাপাখানা কাজ করতে শুরু করে রোমে শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই ভেনিসে একশর মতো ছাপাখানা চালু হয়ে যায় 

প্রশ্ন হচ্ছে ছাপাখানার এই বিপ্লব বিজ্ঞানকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল? 

কিছু আধুনিক ভাষ্যকারদের মতে রেঁনেসার বিজ্ঞান ছিল স্ববিরোধী তবে আজকে আমরা বিজ্ঞানকে যেভাবে দেখি তার কারণেই মূলতঃ এই মূল্যায়ন স্বাভাবিকভাবেই ওই সময়ের বিজ্ঞান ছিল খুবই পিছিয়ে পড়া এবং খুব সামান্যই জানতো বা বুঝতো তারা যা দুই হাজার বছর আগে গ্রীকরা ইতোমধ্যেই ব্যাখ্যা করে গেছে  এ ছাড়া তেমন একটা সন্দেহই ছিল না যে, বিজ্ঞানের অনেক ধারণাই অতীন্দ্রিয় এবং অতিপ্রাকৃতিক ধারণা এবং কার্যক্রমের সাথে মিশে গিয়েছিল এর কিছু দায় দায়িত্ব গ্রীক এবং রোমানদেরও উপরে বর্তায় কেননা রেঁনেসার বুদ্ধিজীবিরা তাদের বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানই তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন 

এর একটা উদাহরণ হচ্ছে যেভাবে জোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্র একে অপরের সাথে  জড়িত হয়ে গিয়েছিল গ্রীকদের অবশ্য জ্যোতিষশাস্ত্রে তেমন কোন জ্ঞান বা বিষয়টির প্রতি কোন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি প্রাচীন রোমানরা অবশ্য জ্যোতিষশাস্ত্রে গভীরভাবে আগ্রহী ছিল ল্যাটিন ভাষায় লেখা Manilius এর Astronomica – তে কীভাবে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে 

পঞ্চদশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের উপর Astronomica এবং আরো কিছু প্রাচীন গ্রন্থের এমনই প্রভাব ছিল যে জোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের কাজ এক লোকের উপরই ন্যস্ত করা হতো ওই শতাব্দীর সবচেয়ে সম্মানিত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন টসকানেলি (Toscanelli) তিনি কোর্টের জ্যোতিষী ছিলেন এবং জ্যোতিষ চার্টের মাধ্যমে লোকজনকে উপদেশ প্রদান করতেন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যুদ্ধ শুরু করা, শান্তি চুক্তি করা বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানসমূহ পালন প্রভৃতি কখন করতে হবে তার সব কিছু জ্যোতিষশাস্ত্রের তথ্যের উপর নির্ভরশীল ছিলএমনকি সেই সময়কার একজন অন্যতম যুক্তিবাদী লিওন আলবার্টি (Leon Alberti) তার লিখিত On Architecture এ কোন বিল্ডিং এর ভিত্তিপ্রস্তর কোন সুলগ্নে করতে হবে সেটা বলে গেছেন

 

 চিত্র : পাওলো টসকানেলি (১৩৯৭ ১৪৮২) 

শুধু জোতির্বিজ্ঞান আর জ্যোতিষশাস্ত্রই নয়, বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কযুক্ত অন্য এলাকাগুলোও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বিভ্রান্ত চিন্তা এবং পৌরাণিক কাহিনী এবং অতিপ্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভরশীলতার কারণে রেঁনেসার সময়ের চিকিসা জ্ঞান এবং তার অনুশীলনের উপর জরিপ থেকে এটা পরিষ্কার অনুধাবন করা যায় 

চিরায়ত সময় থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দুটো বই অনুবাদ করা হয়েছিল সে দুটো হচ্ছে On Medicine এবং Natural History. খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে রোমান চিকিসক কর্নেলিয়াস সেলসাস (Cornelius Celsus) রচিত On Medicine  লিওনার্দোর ছাব্বিশ বছর বয়সে ১৪৭৮ সালে অনুবাদ করা হয়Natural History সাঁইত্রিশ খণ্ডের এক বিশাল ভলিউম সেই সময়কার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যা যা জানা ছিল তার সব সেখানে লিপিবদ্ধ ছিল এই দুটো গ্রন্থই খুব গভীরভাবে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষার্ধে অনুশীলন করা হতো কিন্তু যেহেতু দুটো গ্রন্থই ছিল মোটামুটি উদ্ভট ধরনের সেহেতু এদের অনুসরণের ফলে উদ্ভট ধরনের চিকিসা পদ্ধতি চালু হয়ে গিয়েছিল 

পঞ্চদশ শতাব্দীতে গ্রীক চিকিসাবিদ গ্যালেনের (Galen) কাজগুলোর অনুবাদ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটায় তবে গ্যালেনেও ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে ছিলেন না তার গুরু (Hero) হিপোক্রেটেসের মতোই তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, শারীরবৃত্ত শরীরের অভ্যন্তরের এক ধরনের তরলের ভারসাম্যের উপর নির্ভর করে এই বস্তুকে তিনি হিউমার নামে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে হৃপিণ্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে রক্ত সঞ্চালিত হয় সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, মধ্যযুগের চিত্র শিল্পীরাই এনাটমি এবং ফিজিওলজীর উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে তাদের আবিষ্কারসমূহ ধীরে ধীরে মেডিসিনের অন্যান্য শাখাতেও গৃহিত হতে থাকে 

লিওনার্দোর সময়ে পেশাদার চিত্রশিল্পীদের শিক্ষণে প্রাণী এবং মানুষের এনাটমি অধ্যয়ন করাটা স্বীকৃত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নবীন শিল্পীদের ক্ষেত্রে এটাকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দক্ষতা হিসাবে বিবেচনা করা হতো কেননা প্রাণীর শরীর কীভাবে তৈরি তা জানার মাধ্যমে শিল্পীরা আরো ভালভাবে মানব চিত্রকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন  

লিওনার্দো ছিলেন শ্রেষ্ঠতম রেঁনেসা এনাটমিস্ট ধারণা করা হয় তিনি কমপক্ষে তিরিশবার মানব দেহের সম্পূর্ণ ব্যবচ্ছেদ করেছেন এবং এর মাধ্যমে হাজার হাজার স্কেচ এঁকেছেন এবং এনিম্যাল ফিজিওলজীর উপর বিস্তারিত পরীক্ষণ করেছেন তবে লিওনার্দোর আগেও অনেকেই ছিলেন যারা ব্যবচ্ছেদে আগ্রহী ছিলেন তারা লিওনার্দোর জন্য অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছেন এবং কীভাবে শরীর কাজ করে সে বিষয়ে অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন শিল্পী এবং এনাটমিস্ট এন্টনিও বেনিভিয়েনি (Antonio Benivieni). বেনিভেনি লিওনার্দোর সমসাময়িক ছিলেন তিনি ফাঁসিতে মৃত আসামীদের দেহ ব্যবচ্ছেদ করতেন এবং তার গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রকাশ করেছিলেন De Abditis Causis  নামক গ্রন্থে 

পঞ্চদশ শতাব্দী অসংখ্য বরেণ্য ব্যক্তিদের বিপুল প্রচেষ্টা এবং অচিন্তনীয় সৃষ্টিশীলতায় পরিপূর্ণ লিওনার্দোর সামান্য আগের প্রজন্মের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিশাল বিশাল অবদান রেখে গেছেন কিছু কিছু বিষয়ে তারাই ভিত্তি গড়ে দিয়ে গেছেন যার উপরে দাঁড়িয়ে অট্টালিকা গড়েছেন লিওনার্দো

প্রতিভাবান জোতির্বিজ্ঞানী এবং ভূবিজ্ঞানী পাওলো টসকানেলি (paolo Toscanelli) ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে ম্যাপ দিয়ে অভিযানে সহযোগিতা করেছিলেন লিওনার্দোর জন্মের পঁঞ্চাশ বছর আগে জন্মেছিলেন তিনি সচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণে খাওয়া পরা নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি তাকে ফলে তিনি তার সময় ব্যয় করতে পেরেছিলেন বৈজ্ঞানিক গবেষণার পিছনে তার কোন লেখাই এখন আর নেই, কিন্তু তার সমসাময়িক ব্যক্তিদের লেখালেখি থেকে জানা যায় যে, তিনি হ্যালির ধূমকেতুসহ অসংখ্য ধূমকেতুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তাদের গতিপথ চিহ্নিত করেছেন

 

চিত্র : টসকানেলির করা ম্যাপ (রিকন্সট্রাক্টেড) 

এই পর্যবেক্ষণের ফলে টসকানেলির কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, ধূমকেতুরা চাঁদের কক্ষপথের অনেক বাইরে অবস্থান করে এবং একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথ অনুসরণ করে দুই হাজার বছর আগে এরিস্টটল ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ধূমকেতু হচ্ছে চন্দ্রতলবর্তী বাষ্প এবং এগুলো অনিয়মিত পথে পরিভ্রমণ করে প্রাচীন সমাজের অনড় আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে যেয়ে টসকানেলি কীভাবে উপসংহার টেনেছিলেন তা জানা না গেলেও, এর সবচেয়ে তাপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে যে, প্রাক কোপার্নিকাস যুগেও মুক্ত চিন্তকদের অস্তিত্ব ছিল যারা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া প্রথাগত জ্ঞানের প্রতি সন্দেহ পোষণ করা শুরু করেছিল কেননা অভিজ্ঞতা এবং পরীক্ষণের ফলে প্রাপ্ত জ্ঞান প্রচলিত ডগমার সাথে ঠোকর খাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল 

ওই সময়ের আরো একজন মহান চিন্তাবিদ হচ্ছেন লিওন আলবার্টি (Leon Alberti) টসকানেলির চেয়েও তার প্রভাব লিওনার্দোর উপর বেশি ছিল তিনি ছিলেন অসংখ্য বিষয়ে দক্ষ একাধারে ছিলেন স্থপতি, শিল্পী, লেখক, ঐতিহাসিক, ভাষাবিদ এবং প্রকৌশলী এতই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন যে, তার সমসাময়িক একজন লিখেছিলেন যে, এমন কি কিছু আছে যা এই লোক জানে না?

 

চিত্র ১০: লিওন আলবার্টি (১৪০৪ ১৮৭২) 

শুধুমাত্র তার বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহ এবং অবদানের জন্যই তাকে রেঁনেসার চিন্তা বিকাশের মূল ব্যক্তিত্ব হিসাবে চিহ্নিত করা যায় বয়স তিরিশ পেরনোর আগেই তিনি লিখে ফেলেছিলেন চিত্রকলার উপর সাড়া জাগানো একটা গ্রন্থ সেখানে তিনি জোর দিয়েছিলেন কৌশলগত দিক এবং বৈজ্ঞানিক নীতি প্রয়োগের দিকে কাজেই এতে খুব একটা বিস্ময় নেই যে, এই গ্রন্থটি লিওনার্দোর উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল তিনি যখন চিত্রকলার উপর তার নিজের গ্রন্থ Trattato della Pittura লিখতে গিয়েছিলেন তখন এর প্রভাব ছিল সবিশেষ  

চিত্র ১১: আলবার্টির ডিজাইন করা সান্তা মারিয়া নুভেলার বহিরাঙ্গ 

বেকনের আগ পর্যন্ত পরীক্ষণকে উপেক্ষা করা হয়েছে ভয়াবহভাবে কিন্তু তার সমসাময়িক টসকালেনি এবং উত্তরসুরি লিওনার্দোর মত আলবার্টি নিজস্ব পরীক্ষণ চালাতেন এবং পর্যবেক্ষণগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখতেন 

এখন পর্যন্ত টেকনোলজিক্যাল উন্নয়ন টাকা কামানো এবং বস্তুগত সম্পদ কুক্ষিগত করাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে টাকার ধান্ধা এবং বস্তুগত পুরষ্কারের আশায় উদগ্রীব হয়ে পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীর লোকেরা অনাবিষ্কৃত অঞ্চলে পৌঁছানোর জন্য উন্নত নেভিগেশনাল কৌশল আবিষ্কার করেছিল  

লিওনার্দো বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয় ধরনের বৈজ্ঞানিক বিকাশের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন একদিকে তিনি ছিলেন ভীষণভাবে বাস্তববাদী মানুষ যে কোন জিনিষ তৈরি করতে পারতেন তৈরি করতে পারতেন যে কোন কিছুর মডেল ছিলেন একেবারে গ্রামের লোক তার প্রাথমিক শিক্ষা এসেছে তার চাচা ফ্রান্সেসকোর থেকে ফ্রান্সেসকোর প্রকৃতির বিষয়ে জ্ঞান এবং কৃষকসূলভ বাস্তবতা তার মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছিল কিন্তু লিওনার্দো আবার টসকানেলি এবং আলবার্টির মত লোকজনের সংস্পর্শে এসেছেন যারা তাকে তাত্ত্বিক নীতি এবং কৌশল দিয়ে আলোকিত করেছেন  

লিওনার্দো তার যুগের সমস্ত জ্ঞানকে ধারণ করেছেন এবং এমন সব জিনিষ আবিষ্কার করেছেন যা তার যুগের কেউ কল্পনাও করতে পারেন নাই নিজের আবিষ্কারকে চমকার ড্রয়িং এবং ঝরঝরে ভাষায় বর্ণনা করে যাওয়ার প্রতিভাও তার ছিল যার কারণে আজকে এতদিন পরেও আমার খুব সহজেই ধরতে পারি যে তার চিন্তাভাবনা কোন খাতে প্রবাহিত ছিল 

                                                                                     (চলবে)

মায়ামি, ফ্লোরিডা।                                                                      [email protected]                                                             

===============================================

মুক্তমনার মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।