গরু সমাচার

হাসানআল আব্দুল্লাহ 

গরুর মাথায় দুটো শিং; কিন্তু নিরীহ প্রাণী। অবশ্য সে সর্বদা শান্ত থাকে তাও নয়। তাকে উত্তক্ত করলে রাগে—আবার রাগ দীর্ঘায়িত হলে যাকে তাকে সামনে পেলেই গুঁতিয়ে মনের ঝাল মেটাতে চায়। এমতাবস্থায় তার থেকে দূরে থাকাই ভালো। অন্যদিকে রাগাক্রান্ত গরুকে খোঁয়াড়ে বেঁধে রেখে দু’চারদিন যদি খড়-বিচুলী বন্ধ করে দেয়া যায় বা কঠোর শাসনে রাখা যায় তবে তার উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। কিন্ত গরু সম্পর্কে যা-ই বলি না কেনো তার নিরীহ চরিত্রটা সর্বজনবিদিত।

      অনেক পরে জানতে পারি গরুর আরবি প্রতিশব্দ বাকারা—তাও আবার কোরানের ইংরেজী অনুবাদ পড়তে গিয়ে। ছোটো বেলায় যখন সাত সকালে উঠে মুরব্বিদের বকা খেয়ে মক্তবে যেতাম আরবি শিখতে, তখন অবশ্য মনে হয়নি যে এই ভাষার অর্থ জানা দরকার। হুজুররাও পারত পক্ষে অর্থ বলতেন না। এখন বুঝি যে ওইসব হুজুরদেরও একটি ভিন দেশী ভাষার অর্থ জানা থাকতো না; কদাচিত সামান্য জানলেও তা থেকে অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার কাজ চালানো যেতো না। ফলত মুখস্ত করিয়েই সব লেঠা চুকে যাবার সম্ভাবনায় ওরা ঢেকুর তুলতেন। অবশ্য ওরাও ওইভাবে না-বুঝে আরবি মুখস্ত করতেন ওদের ছেলে বেলায়। বাংলাদেশ সহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই এই প্রক্রিয়া এখনো চালু আছে। তবে বাংলা অনুবাদে যে কোরান পাওয়া যেতো না তা বলছি না; একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী অর্থসহ আরবি শিখে সে ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত মুসলমানদের জন্যে—তবে গ্রামগঞ্জে তার সংখ্যাও তেমন চোখে পড়ার মতো ছিলো না। তবু যখন বাংলা অনুবাদ দেখার সুযোগ হলো, সেখানেও পেলাম দ্বিতীয় ও বৃহৎ সুরার নাম, ‘সুরা বাকারা।’ ‘সুরা’ এবং ‘বাকারা’ এই দুটি শব্দের অর্থ বাংলা ভাষান্তরে তখনো জানা হলো না।

      কিন্তু ইংরেজী অনুবাদ খুলে, ‘দ্যা কাউ,’ মানে ‘গরু’ শিরোনাম দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। তাহলে কি মোহাম্মদ বা মুসলমানদের সৃষ্টিকর্তা, আল্লাহ (যেহেতু প্রত্যেক ধর্মেই সৃষ্টিকর্তার নাম আলাদা, যেমন ভগবান, আল্লাহ, ঈশ্বর, চুকু ইত্যাদি) মানুষকে প্রথমত নিরীহ গরুর মতো দেখতে চেয়েছিলেন? অর্থাৎ প্রয়োজনে তারা ক্ষেপে উঠবে, আর আবদ্ধ গোয়ালে দানাপানিহীন কিম্বা উপযুক্ত শাসনে রাখলে শান্ত, ভদ্র, সহনশীল হয়ে দিন কাটাবে! এর উত্তর আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষের অতীত এবং বর্তমান জীবন প্রবাহের কদর্যতা দেখে মনে হয় এদের অনেকেই এক শিংঅলা গরুতে পরিণত হয়েছে। ‘ধর্ম’ শব্দের দিকে তাকালেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। একটা ‘রেফ’ যেনো একটা আস্ত শিং-এর মতো উঁচু হয়ে আছে।ফলতঃ বাংলাদেশের মানুষ গরুর মতোই নিরীহ। তবে হ্যাঁ, গরু যেমন তার শিং-এর উপর মাছিটিও বসতে দিতে চায় না, দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা একই প্রক্রিয়ায় ‘ম’-এর উপর বসে থাকা ওই ‘রেফ’-এর কোনো অমর্যাদা হতে দেয় না। আর যদি কোনোক্রমে ওর কাছাকাছি দিয়ে একটা বিড়ালও হেঁটে যেতে দেখা যায় তবেই সেরেছে—ঊর্ধ্বশ্বাসে হিংস্র ষাঁড়ের মতো গুঁতিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেয়ার জন্যে এগিয়ে আসে। ওদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগলেই হলো, সামনে ঝাপিয়ে পড়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো চিন্তা তখন আর মাথায় আসে না। তাই পৃথিবীতে অসংখ্য মুসলমান থাকলেও সালমান রুশদীর “স্যাটানিক ভার্সেস” প্রকাশের পর ঢাকায় সবচে’ বড়ো মিছিলটি সংঘটিত হয়। তসলিমাকে দেশ ছাড়া করা, হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করা সহ তুচ্ছ হাস্যরস উদ্রেককারী কার্টুনেও ওরা রেগে মেগে রক্ত দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকে। সারা বিশ্ব ওদের কাণ্ড কারখানা দেখে হাসলেও, গরুর মতোই ওদের সে-সবে কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকেনা। ওদের এক শিং তখন চতুর্দিকে সীমাহীন অঘটন ঘটিয়ে ছাড়ে।

      আবার যখন শান্ত হয় তখন গরুর মতোই নিরীহ, ঠিক যেমনটি মোহাম্মদ চেয়েছিলেন।   

 

Hassanal Abdullah, the poet and the editor of the international bilingual poetry journal,  Shabdaguchha, is the author of 13 books. He is the 2007 Queens Borough poet laureate finalist. Mr. Abdullah is a New York City High School math teacher.