একটি ভাষণের অধীর প্রতীক্ষায়

মোঃ জানে আলম*

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার একটি প্রত্যাশিত ভাষণের অধীর প্রতীক্ষায় প্রহন গুণছি কিছু দিন ধরেনজর রাখার চেষ্টা করছি ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার পর্দার নীচের স্ক্রলে কখন ভেসে ওঠবে একটি লেখা জাতির উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা  যে কোন সময়ে ভাষণ দিবেন, ঠিক যেমনটি ভেসে ওঠেছিল বর্তমান রাষ্ট্রপতি, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের  স্বঘোষিত প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজ উদ্দিনের ভাষণের সংবাদ, ১১ ই জানুয়ারী, ২০০৭ ইং তারিখে, সন্ধ্যার সময়

প্রায় মধ্য রাতে ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমদ যখন তার ভাষণটি শুরু করেন, তখন আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না, এ ভাষণ ড. ইয়াজউদ্দিন দিচ্ছেনকারণ এ ভাষণ প্রদানের ঘন্টা কয়েক পূর্বেও তিনি যে কথা বলেছেন, যে কাজ সমাধা করার অঙ্গীকার করেছেন, এ ভাষণের বক্তব্য ও বাক্য বিন্যাস সবকিছুই ছিল তার ঠিক বিপরীতযে জোট সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিনি দীর্ঘ ৪ বসরাধিক কাল বহাল ছিলেন, যাদের সুশাসনের প্রশংসা তিনি তার প্রতি ভাষণে করতেন, হঠা করে এ ভাষণে তিনি তার  উল্টো কথা বলছেনযে নির্বাচন করতে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন, সে নির্বাচন স্থগিত করলেন, ভোটার তালিকা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করলেন সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতির জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করলেনকিছুই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল নাঅত:পর দেশে জরুরী শাসন, নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জ্বেহাদ ঘোষণা, নতুন সরকারের কিছু অভাবিত সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন , জাতীয় পরিচয় পত্র ও ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সর্বোপরি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দেশের দুর্নীতিপরায়ন জাতীয় নেতা-নেত্রীদের কারাগারে প্রেরণ, ইত্যাকার পদক্ষেপ জাতিকে আশান্বিত করে তুলে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৩৭ বছর পর দেশ বোধ হয় একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে যাবে, দেশ ও জাতি মুক্তি পাবে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমগ্ন রাজনীতিবিদ ও কালো টাকার মালিকদের খপ্পর থেকেমানুষ নতুন করে বিশ্বাস করা শুরু করল, কেউই আইনের উর্ধ্বে নন দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন উর্দ্ধগতিতে অসহনীয় ভোগান্তি সত্ত্বেও মানুষ সুন্দর আগামীর আশায় বুক বেঁধে ছিলকিন্তু হঠা পর্দার অন্তরালে যেন কী হয়ে গেল তত্ত্ববধায়ক সরকার আকস্মিক যেন নতজানু হয়ে পড়লেন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের কাছে লালু-কালু-ফালু-দুলু-ঝন্টু-মিন্টু-সাকা সবাই পুষ্পমাল্য গলায় পড়ে বীর বেশে বের হয়ে আসতে লাগল জেল থেকেতাই ইদানিং প্রতি মুহুর্তে আমি একটি ঘোষণার প্রত্যাশা করছি আমাদের করিকর্মা মিডিয়াতে যে মিডিয়া প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা জাতিকে সে সমস্ত নেতাদের ভাষণ শুণতে বাধ্য করছে, বিগত বসরগুলোতে যারা আত্মীয়-স্বজন সমভিব্যাহারে দেশের সম্পদ লুটপাট করে জাতিকে বিশ্বের দরিদ্রতম জাতিতে পরিণত করেছেন সে মিডিয়াতে হয়ত হঠা করে ভেসে ওঠবে, জাতির উদ্দেশ্যে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দিবেনপরম কৌতুহলে আমরা টিভি কিংবা রেডিও সেট অন করে বসে থাকব নির্দিষ্ট সময়ে জাতীয় সঙ্গীত বাজবেঅত:পর বক্তৃতা শুরু করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমেদএটাও হতে পারে আরও একটি ঐতিহাসিক ভাষণ১১ ই জানুয়ারী ২০০৭ ইং তারিখের রাতে প্রদত্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমদের ভাষণের সবকটি বাক্যবিন্যাস যেমনটি আমাদের কাছে বিলকুল অপরিচিত মনে হয়েছিল, সেরূপ মনে হবে নাকি ড. ফখরুদ্দীন আহমদের ভাষণ? কিছু দিন ধরে এমন একটি ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিলামও মা, এ কি! কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই টিভি পর্দায় যেন ভেসে ওঠল ড. ফখরুদ্দীনের, কেতাদুরস্ত চেহারাহ্যা, তিনি জাতির উদ্দেশ্যেই ভাষণ দিচ্ছেননড়ে চড়ে শক্ত হয়ে বসলাম যেন আমার সে বহু আকাক্সক্ষা, বহু শঙ্কার  ভাষণ শোণার জন্যভাষণ শুরু হলজনাব ফকরুদ্দীন আহমেদ বলছেন-

প্রিয় দেশ বাসী, আসলামু আলাইকুমআজ অত্যন্ত দু:খ ও অনুশোচনা  ভারাক্রান্ত মনে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছিআপনারা আমার ও আমার উপদেষ্টামণ্ডলীর গোস্তাকি মাফ করবেনআমরা নিজেদের অজ্ঞতা ও অপরিণামদর্শীতার জন্য জাতির যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছি, তার জন্য আমি আমার সকল উপদেষ্টা মণ্ডলীর তরফ থেকে আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করছিঅতি পরিচিত এ  কন্ঠ তবুও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এ ভাষণ ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ দিচ্ছেন, ঠিক ১১ ই জানুয়ারীতে প্রদত্ত মাননীয় রাষ্ট্রপতির ভাষণ শুণতে শুণতে মনে যেমন সন্দেহ হচ্ছিল, কে ভাষণ দিচ্ছেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজ উদ্দিন সাহেবতো ? নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, সন্দেহ হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছিনাতো ? তদ্রুপ প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন একি বলছেন? যিনি তার প্রত্যেকটি সুলিখিত ও সুপঠিত ভাষণে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতেন জাতি আর ওয়ান ইলেভেনের পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না, দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের প্রতি তার সরকার জিরো টলারেন্স দেখাবেন, অস রাজনীতিবিদদের কবল থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হবেআর সেই ড. ফখরুদ্দীন আজ বলছেনÑ আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে, বস্তুত: আমাদের রাজনীতিবিদদের হাতেই দেশ ও জাতির ভাগ্য চুড়ান্তভাবে নির্ভরশীলতারা ছাড়া দেশ ও জাতিকে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না।  তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়নিবরং তাদের শুচিশুভ্র চরিত্রে কালিমা লেপনের অপচেষ্টা  করে আমরা মহা বিভ্রম ঘটিয়েছিআমাদের এ ঔদ্ধত্য-ধৃষ্টতা ক্ষমার অযোগ্যআমরা একালের রাজা-রাণী-রাজপুতদের যে ভাবে হেনস্থা করেছি, তাতে আমি সপরিষদ যারপরনাই লজ্জিত

প্রিয় দেশবাসী,

আমাদের নেতা-নেত্রীদের প্রিয় সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয় স্বজনেরা যেটুকু দুর্নীতি করেছেন বলে দুদক অভিযোগ তুলেছে, তা আর তেমন কিছুই নয় রাজা-রাজড়াদের ছেলে-মেয়ে-আত্মীয়-স্বজনদের এ রকম একটু আধটু দোষ থেকে থাকে বৈকিতবুও সে সকল মহাসম্মানিত নেতা-নেত্রীদের উপরই নির্ভর করে আমাদের জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যত, আমাদের বহু কাক্সিক্ষত গণতন্ত্রএ ব্যাপারে সর্বশেষ পাকিস্তানের ঘটনা আমাদের চক্ষু উম্মীলিত করে দিয়েছেআপনারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, মি. টেন পার্সেন্ট নামে খ্যাত জনাব আসিফ আলী জারদারী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে গণতন্ত্রের মকছুদ-মঞ্জিলে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব স্ব-স্কন্দে তুলে নিয়েছেন।  একটু বিলম্ব হলেও আমরা উপলদ্ধি করেছি যত দুর্নীতি লুঠপাট করুক, নিজের, ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীর নামে যত সম্পদ গড়ে তুলুক, আসলে শেষ বিচারে সে সকল জাতীয় নেতারাই হল আমাদের ত্রাণ কর্তা, যারা বিগত ৩৭ বসর ধরে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তক্কে তক্কে এগিয়ে নিয়েছেন বিশ্বের সর্বসেরা দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের দিকেতাতে কী, আমাদের দেশের কোন লোক তবুও না খেয়ে মরেনি, দ্রব্যমূল্য এত আকাশচুম্বী হয়নিআমাদের এ বোধোদয়ে বিলম্বের কারণ আমাদের রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতাআপনারা জানেন, আমি এবং আমার পরিষদের সকল সদস্য বস্তুত আমলাকোন দিন রাজনীতি করিনি, তাই রাজনীতি বুঝি নাআমাদের এ বোধোদয়ের প্রেক্ষিতে আমরা তাদের সসম্মানে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে শুরু করেছিআপনার অজস্র পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করে তাদের বরণ করে নিচ্ছেনঅবশ্য আপনারা জানেন, কারাগারেও আমরা তাদের মান-সম্মান সদা সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছি বাংলাদেশ ফৌজদারী দণ্ডবিধিতে ভি,আই,পি আসামী বলে কোন সংজ্ঞা না থাকলেও আমরা তাদের সব সময় ভি,আই,পি আসামী  বলে সম্বোধন করেছি এবং ভি,আই,পি আসামীর মর্যাদা প্রদান করতে কুণ্ঠা বোধ করিনি।  আপনারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, কারাগারে তাদের তনু-মন-প্রাণকে সুস্থ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় রাখার জন্য আমাদের জেল কর্তৃপক্ষ কী গলদঘর্ম ভূমিকা পালন করেছেনতাদের জন্য বিশেষ কক্ষ, বিশেষ বিছানা, ডিশ লাইনসহ টিভি সেট এবং রাজকীয় খানার ব্যবস্থা করা হয়েছিল স্বদলীয় এক দল বিশেষজ্ঞ চিকিসক তাদের অহর্নিশ পরীক্ষা করতেন, মিডিয়ার সামনে এসে আপনাদের উদ্দেশে তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা বয়ান করতেনআমাদের উর্দিপরা-সদাহাস্য জেল সুপার অনুক্ষণ তাদের খবরাখবর রাখতেন বিভিন্ন সময়ে কঠোর নিরাপত্তার সাথে বিভিন্ন নামী-দামী ক্লিনিকে নিয়ে যেতেন আল্লাহের অশেষ রহমতে তারা আজ সুস্থ শরীরে বের হয়ে আসছেন অনভ্যস্ত দীর্ঘ কারাবাসের অবসাদ দূর করতে তারা কেউ কেউ একটু বিদেশ সফর করে আসবেন

প্রিয় দেশবাসী,

আমি আবারো আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমার ঘোষিত রোডম্যাপ অনুসারে ডিসেম্বরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবেসে নির্বাচনে আমাদের স্বনামধন্য এ সকল নেতা-নেত্রীরা অংশ নেবেনআপনারা অবাধে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে দেশ পরিচালনার গুরু দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দেবেনআমি সহাস্য বদনে তাদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে সপরিষদ বিদায় নেবএকটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতি মুক্তি পাবেআমাদের নবনির্বাচিত নেতা-নেত্রীরা জাতি ও দেশকে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন অগ্রগতির পথে মাভৈ: মাভৈ: বলে নিয়ে যাওয়ার মহানব্রতে আত্মনিয়োগ করবেনদেশে আবার গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবেএ মহান জাতি সে সুদিনের আশায় প্রহর গুণছেআমরা করব জয় একদিন, আমাদের সে সুদিন ফিরে আসবেই আপনাদের সকলকে অফুরন্ত ধন্যবাদআল্লাহ হাফেজ

ভাষণ শেষ হতে না হতেই লাফিয়ে  ওঠে বসি বিছানায়একি! চোখ দুটি  অশ্রু সিক্ত কেন! দূর থেকে মোয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে আযানের শব্দ ভেসে আসছেঅদূরে একটি কাকও যেন কা-কা করে ডেকে ওঠলভাবতে লাগলাম একি স্বপ্ন, নাকি দু:স্বপ্ন? না, বুঝতে পারিনি

[email protected] 

-----------------------------------------------------------
*মোঃ জানে আলম গবেষণা, পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান বিষয়ক সম্পাদক, গণফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি।