বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ২

বাসুন আমার,
মানুষের জীবনে কি প্রতিটি দিনই ঘটনাবহুল নাকি শুধু কয়েকটা দিনমাত্র? তুই আজও ঘুমাচ্ছিস বাবু, রাত সাড়ে বারোটা মতোন হবে, আজ আমি গিয়েছিলাম টরোন্টো শহরের প্রথম বইমেলার প্রোগ্রামে যা উদ্বোধন করতে ঢাকা থেকে এসছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ আনিসুজ্জামান , উনি তোর বাবার এবং আমার শিক্ষক । তোর বাবার সাথে সংসার করাকালীন সময়ে স্যার এবং চাচী উভয়ই আমাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন --- সেগুলোও অনেক ইতিহসের কথা রে বাবু , অনেক অনেক লম্বা কথা । তোর বাবার সাথে যে ছয়বছর সংসার করেছি সেখানে লুকিয়ে আছে না বলা অনেক কাহীনি আবার মনে হয়, এই হয়তো ভালো করেছি তোকে একদম ভিন্ন একটি পরিবেশে বড় করে তুলছি । আসলে সত্যি কথা কি জানিস, আগামী সময়গুলোর কথা কিছুই জানি না , যেমন অতীতে জানতাম না আমার জীবনে আজকের দিনটি আসবে,যেদিন শুধু তোকে নিয়েই আমার দিন কাটাতে হবে। বাসুন রে, জীবনের হিসেবগুলো এত সহজ কখনই হয়নি।

আমার আর তোর এই নতুন সংসারে , অথাৎ সাজানো নতুন বাড়িতে আজই প্রথম তোকে বিছানায় রেখে আমি তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে গেছি কারন আজ ঘরে বসেই দুটো পয়সা রুজি করবো। জীবনে টিকে থাকার জন্য অর্থ দরকার এবং এই হিসেবটাই বোধকরি অন্যসবকিছুর চেয়ে নির্মম । তোকে আগের চিঠিতেই বলেছি যে, আমি কোন কাজ এখন করছি না , বরং তুই আর আমি মিলে আমাদের চারপাশের এলাকাগুলোতে পোস্টারিং করেছিলাম বেবীসিটিং এর জন্য কোন বাচ্চা পাওয়া যায় কিনা । আমার আর তোর এই দিনগুলোর কথা তোর মনে থাকবে তো রে বাসুন? তোকে নিয়ে এভাবে সময় পাড় করতে করতেই একদিন হয়তো বেলা শেষের গান গাইবার সময় চলে আসবে রে সোনা , সেদিন মায়ের কথা তোর মনে পড়বে না বাবা? আমার বুঝি বয়স হয়ে যাচ্ছে তাই না রে সোনা, এখন কেমন অল্পতেই চোখের কোনা ভিজে উঠে।

যা বলছিলাম তোকে , আজ বইমেলায় আনিসুজ্জআমান স্যার আর চাচী আমাকে দেখেই প্রথম তোর কথা জানতে চাইলেন ,কতবড় হয়েছিস তুই, কেমন আছিস ,তুই বাংলা বলতে জানিস কিনা ইত্যাদি নানান কথা , আর আমার বার বারই মনে পড়ছিলাম তোর জন্মের সময় আমাদের সংসার জীবনের সেই ফেলে আসা সময়গুলোর কথা । তোর বাবার সাথে আমার সম্পর্কের সামাজিক সমাপ্তির পর ঢাকাতেই শহীদ মিনারের এক অনুষ্ঠানে আনিস স্যার একদিন আমার হাত ধরে জানতে চাইলেন ” কি হয়েছে তোমাদের দুজনের যে একেবারে থাকতেই পারলে না (আমার আর তোর বাবার কথা বলছিলেন তিনি) বাইরে থেকে তো তোমাদের বেশ ভালোই মনে হতো?” আমি সেদিন স্যারকে বলেছিলাম , স্যার আপনি কেমন মানুষ এটা শহীদ মিনারে দাড়িয়ে বলা যাবে না , এটা জানবার জন্য চাচীর সাথে খুব নিবিড়ভাবে কথা বলতে হবে , সেদিন স্যার আমাকে কোন উত্তর দেননি । আজ মাঝে প্রায় ৭ বছর চলে গিয়েছে , স্যার চাচী সেই একই ভালোবাসা নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন , এই প্রাপ্তিগুলো আমার সঞ্চয় , আমার অর্জন।

গতরাতে বইমেলা থেকে ফিরতি পথে আমাদের উপরের ল্যান্ডলর্ড ও লেডী আমাকে ওদের দুটো বাচ্চাদেখাশোনা করার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে, হয়তো কিছু পয়সা আসবে আর সেকারনেই ভোরবেলা উঠে পড়েছি , একটা সুন্দর সকালে তোকে লিখছি বাসুন। সবচিন্তা একসাথে নিয়ে যখন তোকে লিখতে বসি তখন একসাথেই সবকিছু মনে পড়ে , কথা এলোমেলো হয়ে যায়,কি করবো বল? তোকে কেন্দ্র করেই তো সময়ের কাটা ঘোরে তাই তুই আমাকে ধৈর্ষ ধরে শুনিস বাসুন । আমার আর তোর জীবনে আরো একটা সকাল শুরু হলো বাবু।
আদর, মা ।

৯ জুলাই, ২০০৭

টরোন্টো, কানাডা ।                                                                                               Email:[email protected]

পর্ব                                                                                                                           পর্ব