প্রস্তুতি
লুনা শীরিন

মাত্র পাচঁদিন হলো মায়ের বাড়িতে এসছে নিতা সাথে ৮ মাসের দুধের শিশু ,নিতার মা কোনকালেই নরম বা আলগা দরদ দেখানো মানুষ ছিলেন নানেই কারনেই নিতার নিজের সংসার ছেড়ে মায়ের বাড়িতে চলে আসার পরে প্রাথমিক  সময়গুলোও খুব সহজ ছিলো নাসংসার করা হবে না বলে নিতা সারাক্ষন ঘরে বসে বসে মানুষের প্রশ্নের  উত্তর দেবে, স্বামী সংসার ফেলে আসার জন্য আহাজরি করবে, এর কোনটাই নিতার মা এক মুহুর্তের জন্যও বরদাস্ত করবেন না এই সত্য নিতা বহুকাল আগে থেকেই জানতোতাই মায়ের বাড়িতে আসার পরের দিন থেকে কিভাবে একটা চাকরি জোটানো যায় বা কি কি করলে নিতা ব্যাস্ত থাকতে পারবে সেই চিন্তা নিতাকে করতে হয়েছে ঠিক পর মুহুুর্ত থেকেই

ছোট ছেলে নিওর তখনো বুকের দুধ খায়,একদিন নিতা গিয়েছে চাকরি খুজতে হঠা নিতা বুঝতে পারে  বাবুর দুধ খাওয়া দেরী হয়ে গেছে, হাপাঁতে হাপাঁতে বাড়ি পৌছে দেখে লিফট বন্ধ,ভীষন অস্থির হয়ে সিড়ি ভেংগে ৮ তালার উপরে যখন উঠে বাসাতে ডুকলো,দেখে ছেলে দিব্যি নানীআপুর কোলে বসে বোতলের দুধ খাচ্ছে নিতা মাকে কেবল বলেছে আমাকে দাও,ওমনি নিতার মা মুখ কঠিন করে বললেন, বাচ্চার জন্য দরদ দেখাতে হবে না চাকরি খুঁজে নিজের জীবন সেটেল করোসত্যি কথা বলতে কি সেদিন কয়েক মুহুর্তের জন্য হলেও মাকে ভীষন নিষ্ঠুর মনে হয়েছে নিতারএর পর তো সেই বয়ে যাওয়া সময়,সেভ দ্য চিলড্রেন এর ৭ মাসের প্রোজেক্ট, নিতাকে  প্রতিমাসে চার বার করে ফিল্ডে যেতে হয়েছে ,বাবুও দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠলো এরপর নিতা ডুকেছিলো  দি হ্যাংগার প্রোজেক্ট নামে এক বেসরকারী সংস্থাতে কাজ পেলো , কিন্তু ফিল্ডে যাওয়া এবার ও অবধারিতনিতা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতো কখন বাড়ি ফিরে ছেলেটাকে বুকে তুলে নেবে, যদিও নিতা জানতো মায়ের বাড়িতে  ছেলের কোন অসুবিধাই হবে না এই ফাঁকে একটা কথা হঠা মনে পড়লো,নিতার বড়বোন নিপা তখন নিউইয়র্কে থাকে,বাচ্চা হবার সময় মা গিয়েছেন, নিপা ১৫ দিনের বাচ্চাকে  মায়ের কাছে রেখে কাজে যায় আর কাজ থেকে ফোন করে করে মায়ের খোঁজ নেয় , বিদেশ বিভুই এ মা একা কি করছেরএকদিন মা নিপাকে জিঞ্জেস কওে, কি রে  তুই যে ফোন করে আমার খোজ নিস , মেয়ের কথা তো  জানতো চাস না, নিপা হেসে দিয়ে বলে,মা,তোমার ভরসাতেই তো বাচ্চাকে রেখে আসি, তুমি ঠিক থাকলেই বাচ্চা ঠিক থাকবেএই ছোট কথাটা নিতার মনে দাগ কেটেছিলো খুব বেশী।  যাইহোক হ্যাংগার প্রোজেক্টের কাজে থাকাকালীন সময়ে একদিনের  ঘটনা  নিতাকে ভীষন অবাক করেছিলোনিতা গিয়েছে কুমিল্লায় চারদিনের উজ্জীবক প্রশিক্ষনে, দ্বিতীয় দিনে এক মাঠকর্মীর মোবাইল ফোন থেকে ঢাকাতে ছোটবোনের কাছে ফোন করে বাচ্চার খোজ নিতেই  ছোটবোন আবেগের বসে বলে বসলো মেঝপা, তুমি কি খুব ব্যাস্ত?বাবুর তো একটু জ্বর এসছে,পারলে চলে আসোছেলে তখন মাত্র ১৪ মাসের,নিতা সেই সন্ধ্যাতেই কুমিল্লা থেকে  ঢাকার বাসে উঠেছিলো হুড়মুড় করে বাড়ি ডুকতেই নিতার মা অবাক , কি রে তুই? নিতা বিস্মিত হয়ে বলে,রিতা যে বলল বাবুর খুব জ্বর, মা সেদিনও বলেছিলেন, তোমার যদি মনে হয় ঘরে বসে ছেলে মানুষ করলেই তোমার জীবন যাবে তাহলে আমার কিছু বলার নেই নিতা বুঝতে পেরেছিলো,ছেলের সামান্য গা গরম হওয়াকেই জ্বর বলেছে ছোটবোন, আর মা তাতে  খুশি হননি মোটেই

এখন  ২০০৮ ,টরোন্টোতে শীতের আগমন শুরু হয়েছে , আগামী পরশু নিতা তিনদিনের জন্য টরোন্টোর অদুরে এক সেমিনারে অংশ নেবে , বিকেল থেকে সেই প্রস্তুতি চলছে, ঢাকাতে যতবারই ফিল্ডে যেতে হতো  মনটা আনন্দে মেতে উটতো , মনে হতো প্রাত্যাহিক জীবন থেকে কয়েকদিনের  ছুটি মিললো এই শহরেও এনজিওর কাজে দেশে বিদেশে ঘুরবে এই ইচ্ছে ছিলো অনেকদিনের , আজ সুযোগ মিলেছে কিন্তু সেই ১৫ মাসের শিশু আজ সাড়ে নয় বছরের ছেলে নিতা ভাবছিলো ১৫ মাসের সেই দিনগুলো কথাকতটা সময় গেছে জীবন থেকে টের পায়নি নিতা পৃথীবির আর সবার মায়ের মতোই নিতার মা ওদের চারবোনের কাছেও  শ্রেষ্ঠ মাবিকেলে যখন বাবুর বেবীসিটার এর কাছে তিনদিনের  সব বন্দোবস্ত করে এলো তখন থেকেই পুরোন দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে নিতার টরোন্টোতে এই প্রথম বাবুকে ছেড়ে অফিসের কাজে বাইরে থাকবে নিতা,কতটা কঠিন পথ  পেড়িয়ে এই জীবনকে দাড় করিয়েছে সেই সত্য লেখার ভাষা জানা নেই ওরতবে নিতা ওর মায়ের কাছে গোটা জীবনের জন্য দেনা হয়ে আছে,মায়ের কাছ থেকে কঠিন হওয়ার শিক্ষাটা না পেলে হয়তো গোটা জীবন অন্যর আশ্রিতা হয়ে কাটাতে হতো সন্মান নিয়ে বেঁচে  থাকার জন্য মানুষের কাজের কোন বিকল্প নেই,নিতাদের চারবোনকেই এই শক্তিটুকুই শুধু অর্জন করতে বলেছিলো মা, সেই মা যার দোয়ার নিতা আগামী পরশু শহরের বাইরে যাবে,প্রস্তুতির অনেক গুলো পর্ব এখনো বাকি আছে, কাল সকাল থেকে শুরু হবে সত্যিকার প্রস্তুতি 

লুনা শীরিন

১৯ শে অক্টোবর, ২০০৮