আমার মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতার কথা
নৃপেন্দ্র নাথ সরকার

 

ড. অভিজিত রায়ের আত্মা নিয়ে ইতং বিতং (তৃতীয় পর্ব) থেকে মনে হয়, মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতাকে দুভাগে ভাগ করা যায়, যথা ১)’বিরাট টানেলের শেষে আলো দেখা’, ২) ‘দেহ বিযুক্ত হয়ে ভেসে বেড়ানো’। আমার অভিজ্ঞতাটি এই দুটো বিভাজনের কোনটাতেই পড়েনা বলে আমার ধারনা। আমার অভিজ্ঞতাটি প্রেক্ষিত বা ঘটনাটির ধারাবাহিকতাকে রক্ষা করে মৃত্যুর অপর পারে তাক্ষণিক দৃশ্যে চলে যাওয়া।

হাজারো মানুষ হাজার রকমের মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে পারেন। আমার এই মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতার তেমন কোন বিশেষত্ব বা গুরুত্ব নেই। এটি আমা্র একান্তই নিজস্ব ঘ্টনা। এ অভিজ্ঞতা অন্যের পড়ার কোন কারন নেই। তবে ডঃ রায়ের মত গবেষকরা আমার অভিজ্ঞতার কোন প্রয়োগ বা মূল্য পেলেও পেতে পারেন।

প্রেক্ষিত প্রেক্ষিতটি এরকম। ১৯৬৭ সালের জুন মাস হবে। বাংলায় আষাঢ়। বাড়ী থেকে এক মাইল দূরে নদী। সেই নদীতে প্রান এসেছে, ভরতি হয়েছে নতুন জলে। নতুন জলের আগমনে নদীর পার যেন উপছে পড়ছে। সেই জলে মাতামতি করা আর অবগাহন করে স্নান করার আনন্দ তুলনাহীন। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। ফল বেরোতে মাস তিনেক সময় লাগবে। আড্ডা আর ঘুরে বেড়ানোর অফুরন্ত সময়। কাছাকাছি বয়সের জন-দশেক প্রতিদিন নদীতে স্নান করতে যাই দুপুর বেলা।

বংশী নদী। এপাশ থেকে ওপাশের মানুষকে ছোট দেখায়। চেনা যায়না। পড়নের কাপড় থেকে পুরুষ কি মহিলা সেটা বুঝা যায় মাত্র। প্রায় সবাই মিলে তাক্ষণিক ভাবে সিদ্ধান্ত – ভাটির টানে সাঁতরায়ে দুই মাইল দূরে নদীর অপর পাড়ে উঠতে হবে। তারপর পায়ে হেঁটে ফিরে আসতে হবে। যে কোন খেলাধূলায় আমার স্থান সবার পেছনে। পাঁচ মিনিট ভেসে থাকা আমার জন্য বিরাট ব্যপার। আমার কাছে তাক্ষণিক এই সিদ্ধান্ত কিছুতেই গ্রহনযোগ্য নয়। মুখে কিছু বলতেও পারলাম না। আমার অন্তরাত্মা জোর গলায় বলতে থাকল – ওরে, তোরা এই মরণ সিদ্ধান্ত নিসনে, তোরা যাসনে। হায়রে কচি বয়স! যেই কথা সেই কাজ। মূহূর্তে সাঁতরানো শুরু হয়ে গেল। সবার সামনে আছে দলনেতা, রবীন্দ্র নাথ সরকার, আমার পিসতুত দাদা, আমার চেয়ে বছর চারেকের বড়। আজীবন আমার বড় ভাইয়ের স্থানে বসে আছেন। আমি তাঁর একমাত্র ছোট ভাই।

একে একে প্রায় সবাই দলনেতার পেছনে সাঁতরানো শুরু করে দিল। আমার বছর পাঁচেকের ছোট রণঠাকুর আমার মতই ভাবছে, যাব কি যাব না। আমি ভাবছি, ও গেল না ভালই হল। আমরা দুজন বাড়ী চলে যাব। ওমা! রণঠাকুরও সাঁতরাতে শুরু করে দিল! আমার চেয়ে এত ছোট ছেলেটিও যদি দলের সাথে চলে যায়, তাহলে আমি কেন যাব না? দ্বিধাদন্ধ এবং কিঙ্ককর্তব্যবিমূঢ়তাকে পেছনে ফেলে আমি আমার নিজের শারিরীক সামর্থের দীনতাও ভুলে গেলাম। শরিক হয়ে গেলাম। অপরিনামদর্শিতার দন্ড অত্যন্ত ভয়াবহ। মৃত্যু মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে।

জীবনে পেছনে ফিরে তাকালে স্পস্ট দেখি, দ্বিধাদন্ধের মধ্যে যে কাজটি করেছি, সেই কাজটিই ভুল হয়েছে। অনুতাপ করতে হয়েছে। কিন্তু এই সাংঘাতিক ভুলটির জন্য আমার জীবন প্রদীপের আলোটি ধপ করে নিভতে গিয়েও থমকে গেছে। যমরাজ বুঝিবা ঘুমুচ্ছিল তখন। তাই আমি আজও বেঁচে আছি আমার দ্বিতীয় জীবনটি নিয়ে।

রণঠাকুর চলে গেছে অনেক সামনে। শুধু ওরই মাথার চুল তখনও দেখা যায়। আর কাউকে তখন আর দেখিনা। এক সময় মনে হল ভয়ঙ্কর জায়গাটিতে চলে এসেছি। নাম ‘বৈদের বাড়ী’। স্বাভাবিক ভাবে নৌকায় যেতেও এই বিশেষ জায়গাটিতে দম আটকে আসে। জলের গভীরতা এই খানটিতেই সবচেয়ে বেশী থাকে। বিশ থেকে ত্রিশ ফুট তো হবেই। উজান থেকে ভাটিতে স্বাভাবিক স্রোত এখানে বহে না। জল ভূসমান্তরালে বৃত্তাকারে ঘোরপাঁক খায়। ফলে জলে গর্ত সৃস্টি হয়। জল আবার নদীর তলদেশ থেকে বালি মাটি উপরে নিয়ে আসে, আবার নীচে নিয়ে যায়। আমি তারই মাঝখানে সেই মুহুর্তে মারা যাচ্ছি।

মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতা আমি জলের ঘুর্নাবর্তের একেবারে মাঝখানে, মারা যাচ্ছি। এপার-ওপার আমার দৃস্টিসীমার বাইরে। তাকিয়ে দেখার মত মস্তিস্কের অবস্থা আর আমার নেই। শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশ্বেসিত। হাতপা নড়া বন্ধ। আমি মারা যাচ্ছি এক মূহূর্তের মধ্যে। আমার পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। একটি ছোট গন্ডীর মাঝখানে আটকা পড়ে আছি। চারিদিকে বালি মিশ্রিত ঘোলা জল। আমি সেই ঘোলা জল বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছি নীচে। ঘোলা জল ক্রমশঃ স্বচ্ছ হয়ে আসছে। সব মিলিয়ে ফুট দশেক গভীর। জলের স্তর দুটো ভেদ করে খোলা জায়গায় ঢুকে গেলাম। সেখানে দিনের আলোর মত সবই পরিষ্কার আকাশ। এই আকাশের গভীরতা দশ-বার ফুট। উপরে তখনও স্বচ্ছ জলের স্তর, তার উপরে ঘোলা জলের স্তর। নীচে নদীর অসমতল তলদেশ। ঝর্ণাধারার মত জল বয়ে যাচ্ছে, চুয়ে চুয়ে পড়ছে উপ্র থেকে নীচের ধাপে। ধাপ গুলো তিন থেকে ছয় ইঞ্চির মত। নীচের ধাপ জলের আঘাতে গর্ত গর্ত হয়ে গেছে। জলের সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে ‘ভাদিলা’ ঘাসের কালো খসখসে ছোবড়াওয়ালা বিচি। কখনও আবার দুটো বিচি্ ওদেরই লতায় আটকানো। আবার কখনও ছোট ছোট কাঁকড় লাফিয়ে লাফিয়ে নীচের ধাঁপে পড়ছে জলের সাথে। এর সাথে অন্য ঘাস পাতাও আছে। আমি এরই একটু উপর দিয়ে ভেসে ভেসে চলছি আর এগুলো দেখছি কাছ থেকে। শরীরখানা গুটিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখছি। আমার কোন ওজন নেই। মিনিট দশেক আগের পৃথিবীতে আমি কোন কালেই ছিলাম না, কিছুই মনে নেই। আমি বিচ্ছিন্ন। যেন এই পৃথিবীতে আমিই একমাত্র বাসিন্দা। এখানে আর কারোর থাকার কথা নয়। ঝর্ণাধারার উপর দিয়ে ভেসে বেড়ানোটাই আমার জীবন।

ফিরে এলাম কিভাবে? কিভাবে মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে এলাম! আমি তা জানিনা। দুই মাইল ভাঁটি পর্যন্ত কারও যাওয়া হয় নাই। বাঘের মত শক্তিধারী দাদার হঠা মনে পড়েছে ছোট ভাইটির কথা। এই মনে পড়াটা আর কয়েক সেকেন্ড দেরী হলে তাঁর আর কিছুই করার থাক্ত না। ‘ভাদিলা’ ঘাসের বিচি গোনা আমার আর কোন দিনই শেষ হত না।

১-১৯-০৮