নোয়াখালীঃ কল্পলোকের গল্পকথা ()

পরশপাথর

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি নোখালীর পথে/ বঙ্গোপ সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মেঘনা সাগরে। অতএব, বনলতা সেনদের দেখা এখানেও যে আমি পাব তা আর নতুন করে বলার কি? তবে বনলতা সেন পেলে কি হবে, দুদণ্ড শান্তি আমার পাওয়া হয়ে উঠেনি। তারা পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে যেই না এক দণ্ড শান্তির অবতারণা করে অমনি আবার মুখ দিয়ে এতদিন কোথায় ছিলেন বলতে গিয়ে সর্বনাশের গোড়াপত্তন করে। তবে তাদের সেই বিচিত্র উচ্চারণের বৈচিত্র নিয়ে লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু একটু কারণ খুঁজতে চেষ্টা করেছি, আর সেই সঙ্গে অবাক হয়ে দেখেছি কি চমকারভাবে সেই স্থানীয় ভাষা দিয়ে তৈরী হয়ে গেছে লোকসাহিত্য। অন্যদিকে, বলতে গেলে বনলতা সেনের নাটোরে গিয়েই আমি বরং হতাশ হয়েছি একটু বেশী। চারপাশে বনলতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, বনলতা ব্রয়লার হাউস, বনলতা এসি সেলুন, বনলতা বস্ত্র বিতান। যে দিকে দুচোখ যায় বনলতা আর বনলতা। এক পর্যায়ে আমারতো মনে হয়েছিলো, শীঘ্রই বনলতা নামটার ব্যবহারের উপর  বিধিনিষেধ আরোপ করা উচি। জীবনানন্দ বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এ হতে দিতেন না। 

এখানকার স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলগুলোতে বাচ্চারা পড়তে থাকে দুই ধরণের । একটা হাঁটুভাঙ্গা অন্যটা দানের(ধানের) । কিন্তু দুটোই । ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগে তাহলে এখানে দুটো থাকার দরকারটা কি? সেটার উত্তর থাকা উচি শিক্ষকদের কাছে। কিন্তু শিক্ষকদের সাথে কথা বলে বুঝা গেল, তারা মোটামুটি শপথ করে বলতে পারবে, স্বল্পপ্রাণ মহাপ্রাণ নামক অভদ্র শব্দগুলোর নাম তারা ইহজনমে কোনদিন শোনেননি; আল্লাহ না করুন, শুনতেও চান না। তাদের সাথে কথা বাড়িয়েও লাভ নাই। কারণ আমি ভালো করেই জানি এ সমস্ত আলোচনার উপসংহার একটাই, বলেন দেখি ভাই, সরকার আমাদের বেতন দেন কত?   

মনে মনে যখন ভাবছিলাম এরা হয়তো মহাপ্রাণ ধ্বণিগুলোকে এড়িয়ে চলে। তাই হয়তো , বলতে চায়না। কিন্তু  তখনই মনে পড়ে যায়, এখানে জাতীয় কোন কিছুর অস্তিত্বইতো নেই। সম্ভবত স্বল্পপ্রাণ ধ্বণি হলেও বলতে এর চেয়ে বেশি পরিশ্রম লাগে। সে যাই হোক, এখানকার নিয়ম অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই শিং মাছেকে বলা হবে হিং মাছ, প্রেম হয়ে যাবে ফ্রেম, সে ঠিক আছে। কিন্তু মাগুর মাছকে কেন যে যাগুর মাছ বলা হয় তার রহস্য উদ্ঘাটন করা আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব হয়নি।  

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তারা দান এবং ধান এর পার্থক্য করে কি করে? স্পষ্টতই,  তারা দুটো ক্ষেত্রেই বলে, কিন্তু উচ্চারণ কিভাবে যেন হয়ে যায় আলাদা। অবশেষে বুঝতে পারি, বাংলা বর্ণমালায় হ্রস্ব , দীর্ঘ কিংবা হ্রস্ব , দীর্ঘ থাকলেও হ্রস্ব বা দীর্ঘ বলে কিছু নেই। দানের ক্ষেত্রে তারা বলে দান, কিন্তু ধানের ক্ষেত্রে বলে দাআন। পার্থক্যটা এখানেই। সে যাই হোক, ভাষা যেহেতু আছে এবং সেটা দিয়ে ভাবও প্রকাশ করা যাচ্ছে সম্পূর্ণভাবেই। অতএব লোকসাহিত্যের জন্ম হবেই। এবার সে দিকটাতে একটু যাই। 

এখানকার বহুল প্রচলিত দুএকটি বচন বা শ্লোক তুলে ধরছি। খুব বেশি সংখ্যকলোক এই শ্লোকটির সাথে পরিচিত-                

মইচ্ছে আগুনে। কাইন্তো আয়ছে হাগুনে

(মারা গেছে অগ্রহায়ণ মাসে, কাঁদতে এসেছে ফাল্গুন মাসে) 

শ্লোক হবার মানদণ্ড কি সেটা আমি জানিনা। কিন্তু স্থানীয়রা এগুলোকে বলে সোল্লক। তাই ধারণা করলাম এটা শ্লোক হতে পারে। উপরের শ্লোকটির অর্থও খুব সহজ। সময়ের কাজ সময়ে না করে দেরিতে করা হলে এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 

আরেকটি শ্লোক হচ্ছে-                 

যাল বাইটতে যঅলে আত,

কেন্নে খামু স্বামীর ভাত? 

(ঝাল বাটতে জ্বলে হাত,

কেমনে খাব স্বামীর ভাত?) 

ঝাল বাটতে গিয়ে হাত জ্বললে হবে কি করে, তাহলেতো ঝাল বাটা সম্ভব হবেনা? সেই বউকে স্বামী রাখবেইবা কেন? কোন কিশোরী হয়তো তারা আয়েশি স্বভাবকে ব্যঙ্গ করতে গিয়ে নিজে নিজেই বলে উঠে এ ধরণের শ্লোক। 

তবে শ্লোকের ব্যাপার বাদ দিয়েও যে আরেকটা জিনিস আছে, সেটা একটু বলতেই হয়। রবীন্দ্রনাথ ভয়ঙ্কর সুন্দরের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু সুন্দরের আরো একটা প্রকারভেদ মনে হয় আছে। অশ্লীল সুন্দর। কি বুদ্ধিদীপ্ত আর বিজ্ঞানসন্মত সেই অশ্লীলতা! ভাষায় প্রকাশ করে তার রেশটুকু নষ্ট করার মানে হয়না।  

তবে এমন কিছু বচন বা শ্লোক আমি পেয়েছি যার সঙ্গতি খুঁজে বের করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু সেগুলোর মধ্যেও একধরণের ছন্দময় কারুকাজ আছে। যেমনঃ 

এক তাই আইয়্যে যেন তাইর মত তাই,

আরেক তাই আইয়্যে যেন নাকের অদ্দেক নাই। 

(একেক জন আসে একেবারে বিশাল জনের মত, (ভাব নিয়ে)

আরো জন আসে একেবারে নাকের অর্ধেক নাই। (তার পরও ভাব)) 

সাধারণত ব্যঙ্গার্থে এই ধরণের শ্লোক ব্যবহার হয়ে থাকে। এবার একটা ধাঁধা বলি, যেটি এখানে বহুল প্রচলিত। 

ঘরে হিছে কইতরের টং,

হঅয় বউ এক্কই রঙ। 

(ঘরের পিছনে কবুতরের টং,

শাশুড়ী বউ এর একই রঙ।) 

এই ধাঁধাটির উত্তর হচ্ছে হ্লুদ। কিভাবে হলুদ সেটা কেউই ব্যাখ্যা করতে পারলোনা। তবে সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিল এটার উত্তর অতি অবশ্যই হলুদ। 

আমার নিজেরও এই সব দিকে খুব ভালো ধারণা না থাকার কারণে অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারছিনা, কিছুটা হয়তো ভুল ব্যাখ্যাও করে থাকতে পারে। তবে যত কম ধারণাই থাকুক না কেন একটা ব্যাপার কিন্তু ঠিকই বুঝেছি। দেশে দেশে, যুগে যুগে, কালে কালে সম্পর্কের ধরণ একেক রকম। স্থান-কালভেদে তার বিভিন্ন রূপ। কেবল একটা সম্পর্কই মনে হয় আছে যার রূপ সমস্ত পৃথিবীজুড়ে এক, যার ধরণ সমস্ত যুগে সমস্ত কালে এক। সন্তান এবং পিতা-মাতার সম্পর্ক।  

আজ থেকে বহুদিন পূর্বে ভারতচন্দ্র তার অন্নদামঙ্গলে লিখেছিলেন, 

ভবানন্দ মজুন্দার নিবাসে রহিব।

বর মাগ মনোনীত যাহ চাহ দিব।।

প্রণমিয়া পাটুনী কহিছে যোড় হাতে।

আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।।

তথাস্তু বলিয়া দেবী দিলা বরদান।

দুধে ভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান।।’ 

দেবী অন্নপূর্ণা ভবানন্দ ভবনে যাত্রার প্রাক্কালে খেয়া পারকারী ঈশ্বরী পাটুনীর আচরণে খুশি হয়ে বর চাইতে বলেন। সোনা-রুপা নয়, ধন-দৌলত নয়। দেবীর কাছে পাটুনী চেয়েছিল তার সন্তানের জন্য। সন্তান যেন ভালোভাবে খেয়ে পরে বাঁচতে পারে, দুধ-ভাতের উপর থাকতে পারে। নোয়াখালী অঞ্চলে এসে আবার সেই কাহিনীর কথা মনে হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। এখানকার একটা শ্লোক ঠিক এরকমই- 

মার গফুর বাশ্‌শা কোই,

হঅনে গেছে গোই,

দুধ কেলা দি ভাত দিমুগো,

বোলাই আনো গোই। 

(মার গফুর বাদশাহ কোথায়,

পড়নে(মক্তবে) গেছে সে,

দুধ কলা দিয়ে ভাত দেব

তাকে ডেকে আন। )      

ছোট শিশু পড়ার জন্য মক্তব বা স্কুলে গিয়েছে, মায়ের খুশি যেন আর ধরেনা। আজ সে এত খুশি যে ছেলেকে সেখান থেকে আনবার জন্য লোক পাঠাচ্ছে। তাকে দুধ কলা দিয়ে উত্তম খাবার দেয়া হবে। 

এ শ্লোক হয়তো নোয়াখালীর নয়, সমস্ত বাংলার। বাংলার মায়েদের। বাংলার সব মায়েদের জন্য আমাদের শুভকামনা। মা, তোমাদের সন্তানরা যেন তোমাদের স্নেহ ভালোবাসার মূল্য বুঝতে পারে।  ( … ) 

[email protected]