মিথ্যে অভিনয় আর নয় আর নয়

পরশপাথর  

নীতি কখনো রীতি হয়না। নীতির প্রতি প্রীতি দেখিয়ে গীতি গাইতে গেলে সেটা এই সমাজে ভীতি বৈ আর কিছুই সঞ্চার করতে পারেনা। তাই সম্প্রীতির নাম করে যেগুলো আজ হয়ে উঠেছে সমাজের ভিত্তি, সেগুলোকে দুর্নীতি বলে অভিহিত করা হলেও খুব একটা বাড়াবাড়ি হবেনা। বহু দিন ধরে গড়ে উঠা সে-রকমই এক সামাজিক রীতির বাহারী নাম হচ্ছে ‘বিয়ে’। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যেটি হয়ে উঠেছে নারী নির্যাতন আর নিপীড়নের সবচাইতে গ্রহণযোগ্য সামাজিক মাধ্যম। দুই অক্ষরের এই ছোট্ট শব্দটির ভেতর লীন হয়ে গেছে বাঙ্গালী নারীর কান্না আর অবমাননার বেদনাময় এক তিক্ত ইতিহাস। 

যৌবন কিংবা কৈশোরের রঙ্গিণ সব খেলা শেষ করে বাঙ্গালী মেয়ে যায় স্বামীর ঘরে। তারপর তারা নাকি হয়ে উঠে নারী। শিমুল তুলোর বিছানায় তখন জীবনের আর একটা খেলাই তাদের অবশিষ্ট থাকে। কথা থাকে প্রীতির, কথা থাকে প্রেমের। একদা ভালোবাসার বন্যা বইয়ে দেয়া মন উদাস করা উদ্‌ভ্রান্ত প্রেমিক, জীবন বাজী রাখা দিক্‌ভ্রান্ত রসিক, তাদের সমস্ত আকাঙ্খার পরিসমাপ্তি ঘটে বিয়ের মধ্য দিয়ে। তারপর নারী এক লুণ্ঠিত নগরী,ঝরে পড়া ফুল। ইচ্ছে হলে পুরুষ কুড়িয়ে নেবে, না হয় ঝরা ফুল হয়েই পড়ে থাকবে গাছতলায়। 

ক্ষেত্র বিশেষে পুরুষ হয়ে যায় বহুগামী, ইতিহাসও সেরকমটাই বলে। অন্যদিকে নারীকে হতে হয় সংসারী। সংসার যে সুখের হয় রমনীরই গুণে। তাকে সংসারের মোহে আবদ্ধ করে রাখার হাতিয়ার হিসেবে সূচনা করা হয় নতুন নতুন সব অধ্যায়ের। সন্তানের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়ে নারী। হয়তো পুরুষও পড়ে বাঁধা, তবে সাথে সাথে কুঞ্জে কুঞ্জে খুঁজে ফেরে নব নব রাধা। পুরুষ যেন চাইলেই একটু আধটু বিপথগামী হতে পারবে। নারী থাকবে ঘরে; সন্তান আর সংসার নিয়ে। সেই পুরোনো রীতি, যেন এমনটিই হবার কথা ছিলো, এমনটিই হচ্ছে, এমনটিই হবে। যে নারী মুখ বুজে সয়ে যেতে পেরেছে সে তো পেরেছে, আর তীব্র জেদ আর আত্মসন্মানসম্পন্ন নারী বেছে নিয়েছে অন্য পন্থা; সমাজের মুখে থু থু ছিটিয়ে করেছে আত্মহত্যা। 

স্বামী যখন সংসার করতে অপছন্দ করছে তখন স্বামী এবং পরিবারের সকলে মিলে স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করিয়ে ফেলবে। সেক্ষেত্রে স্ত্রীকেই কারণ দর্শাতে হবে যে, ‘এত কিছুর পরও তাকে কেন সংসারে রাখা হবে, কেন তাকে বাপের বাড়ীতে তাড়িয়ে দেয়া হবেনা?’ আবার স্ত্রীর যখন সংসার করতে অপছন্দ হবে, অস্বস্তি বোধ করবে, তখনও স্ত্রীকেই কারণ দর্শাতে হবে যে, ‘এত অল্প তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেন সে এই সংসার করবেনা, এটা যে তার বাড়াবাড়ি হচ্ছে কেন সে তা বুঝতে পারছেনা?’ 

চরম অনীহা আর অসন্তোষ থাকার পরও এ সমাজ স্ত্রীকে ঢুকিয়ে দেয় স্বামীর কক্ষে। ঢুকিয়ে নিজ দায়িত্বে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসে। এ যেন সমাজের পরম কর্তব্য। যদি স্বামী-স্ত্রী আলাদা বসবাস করে তাহলে সমাজ স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন বউ এর সাথে থাকছে না?’ অন্যদিকে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন স্বামী তার সাথে থাকে না?’ স্ত্রীওযে না থাকতে চাইতে পারে সেটা সমাজের মাথায়ই আসেনা। সব ইচ্ছাই যেন স্বামীর, সেটাই রীতি হয়ে গেছে এখানে। 

তবে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করেছে। আমাদের সমাজ এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বাঙ্গালি মেয়েরা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।পাবলিক বাসে উঠলে এখন আর পুরুষরা মেয়েদেরকে বসেন বসেন বলে দয়া দেখিয়ে সীট ছেড়ে দেন না, মেয়েরাও কাঁদো কাঁদো মুখ করে সীট পাবার আশায় তাকিয়ে থাকছেন না। সবার মাঝে এই বোধটা আসছে যে কেউ কারো থেকে কম নয়। সব ক্ষেত্রেই সবাই সমান। মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে সমান তালে, কাজ করছে সমপরিমাণে। বেড়ে যাচ্ছে তাদের উদ্যম, তাদের সাহস। এ-সাহস দুর্বিনীত দুঃসাহস নয়; এ-সাহস মনোবলের, এ-সাহস জীবনবোধের, সামনে এগিয়ে যাবার স সাহস। 

এ-সব বেড়ে যাবার মধ্যে আরো একটি জিনিস বেড়ে যাচ্ছে ব্যাপকভাবে। যে সত্যটি বলবার  জন্য আজকের এই লেখা, এত ভূমিকা। অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে ডিভোর্সের মামলা। মিথ্যে অভিনয়ের যুগ শেষ। সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সংসার টিকিয়ে রাখার যুগও শেষ। কান পেতে থাকলে আজ ঘরের মাঝে শুধু নারীর কান্নাই শুনতে পাওয়া যায়না, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজ পুরুষরাও কাঁদতে শিখেছে। তাই দেয়ালের বুক ফুঁড়ে এখন ভেসে আসে পুরুষের কান্নাও। বিয়ে যদি হবে সম্প্রীতি আর ভালোবাসার আয়োজন, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেবার চুক্তি; সেই ভালোবাসা আর প্রীতিই যদি না থাকবে, তবে কেন আর মিছেমিছি সেই অভিনীত বন্ধন? পুরুষ শাসিত সমাজের অর্থহীন, অযাচিত উপেক্ষা আর রক্তচক্ষু কেন মেনে নেবে মর্যাদাসম্পন্ন, বিবেকবোধসম্পন্ন স্বাবলম্বী নারী? 

সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়া কোন খুশীর কথা নয়। কিন্তু যে বিশ্বাস আর স্বপ্ন নিয়ে সম্পর্কের গোড়াপত্তন, সেই বিশ্বাস যেখানে ভেঙ্গে যায়; ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে সম্পর্কের শুরু, অথচ পাওয়া যায় শুধু প্রবঞ্চনা,শুধু উপেক্ষা; কেন সেখানে মিথ্যে সংসার সংসার খেলা, কেন মিথ্যে অভিনয়? ভালোবাসাময় স্বপ্নীল এক ঘর বাঁধার স্বপ্ন সবার থাকুক; তবে প্রাপ্য ভালোবাসা, সন্মান না পেলে – আর মুখ বুজে সয়ে থাকা নয়, নয় কোন আক্ষেপ। ঘরে ঘরে যেন নেয়া হয় ঘর ভাঙ্গার নব পদক্ষেপ। 

[email protected]

09.09.08