পূর্ণ মানবী তুমি শূন্য কল্পনা

পরশপাথর

আজ থেকে কয়েকশত বছর পূর্বে ইবনে বতুতা এ দেশে এসে অবাক হয়েছিলেন পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরু দেখে। খুব সস্তায় কিনতে পারা যেত কয়েক মণ চাল আর নিত্য প্রয়োজনীয় সব দ্রব্যাদি। কিন্তু তার চেয়েও অনেক সস্তায় এদেশ থেকে তিনি কিনে নিয়েছিলেন আরো একটি জিনিস; অনিন্দ্যসুন্দরী এদেশের একটি মেয়ে, এ দেশের চিরদিনের সেই চিরসস্তা নারী। কালের বিবর্তনে চাল-মাছ-মাংস মানুষের আরাধ্য বস্তু হয়ে গেলেও শুধু নারী আজও সে আগেকারমত সস্তাই রয়ে গেছে। তিন ‘কবুল’ এর বিনিময়ে আজও এখানে পাওয়া যায় পুরোনো সে দাসী, রক্ত মাংসের তৈরী এক বিরামহীন যন্ত্র। চুলোর মুখে আগুন দিতে দিতে বন্ধ হয়ে গেছে যাদের মুখ, শত অনাচার আর অন্যায়ের মাঝেও যুগ যুগ ধরে যারা প্রতিবাদের একটা ভাষাই শুধু রপ্ত করতে শিখেছে; মাথা নামিয়ে ফেলা, চোখ নামিয়ে ফেলা। 

যুগে যুগে কালে কালে হেদায়েতের জন্য পৃথিবীতে এসেছে মহাপুরুষ; এক-দুই, লক্ষ মহাপুরুষ, হাজার-চব্বিশ হাজার মহাপুরুষ। আসেনি কোন মহামানবী, ছন্দ মিলিয়ে লিখবার জন্য সৃষ্টি হয়নি ‘মহাপুরুষী’ শব্দটিরও । এখানকার ভাষা, এখানকার ব্যাকরণ, এখানকার অভিধান, এখানকার ছন্দ, এখানকার পর্ব, এখানকার শব্দ সবই পুরুষ। আর তাইতো শত হস্র মহাপুরুষ আর তাদের অন্ধ অনুসারীদের মহান কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয়েছে বাংলা ভাষার সবচাইতে অশ্লীল, অশ্লীলতম বাক্য -“স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেস্ত”। প্রত্যাশা করি, এত বড় অশ্লীল বাক্য যেন পৃথিবীর আর কোন ভাষাকে কলঙ্কিত করতে না পারে। অথচ এ বাক্যটিই কি হতে পারত না-“স্বামীর হৃদয় মাঝে স্ত্রীর বেহেস্ত”? এ বাক্যটিই কি হতে পারত না –‘হৃদয়’ আর ‘বেহেস্ত’ নামক দুই কল্পিত নগরীর কাল্পনিক যোগসূত্র? 

একদা আরবের মরুভূমিতে কর্ষণযোগ্য ভূমির অভাব দেখা দিলে, আরব পুরুষদের হাহাকার শুরু হয় শস্যক্ষেত্র নিয়ে। কে জানতো সে হাহাকারের বলি হতে হবে এমন এক জাতিগোষ্ঠীকে যাদের আবার তারা মা বলে ডাকতেও লজ্জাবোধ করেনা। লজ্জাবোধ করবেইবা কি করে, সেটাও যে তারা নারীদের ভূষণ করে রেখেছে। আর সেই নির্লজ্জ পুরুষদের তাণ্ডবে নারী হয়ে উঠেছে শস্যক্ষেত্র, তারা তাতে আবাদ করে যায় ইচ্ছামত। কিন্তু বিবেকবান মানুষরাও যে বসে থাকেনি। তারা মহাপুরুষের বাণীর ব্যাখ্যা চেয়েছে, ঘৃণাভরে বর্জন করেছে সেই নিম্ন রুচিসম্পন্ন বাক্যমালা। আর তখনি হাপুরুষের দালালরা ঘোষণা করেছে এ বাণী মহাপুরুষের নয়, এ বাণী বানোয়াট। যুক্তির আঘাতে পিষ্ট হয়ে গেলে তারপর সে বাণী বানোয়াট হয়ে যায়। তবে এতটুকু স্বীকার করতে তাদের নিশ্চয় আপত্তি নেই যে, মহাপুরুষের না হলেও এ বাণী পুরুষের তথা পুরুষদের, মহাপুরুষের দালালদের। 

ক্ষুধার্তকে অন্ন দেবার আর নিরাশ্রয় কে আশ্রয় দেবার জন্য মহাপুরুষ লাগেনা, লাগেনা তার দিস্তা দিস্তা বাণী। লাগে শুধু বিবেক। পুরুষের বিবেক নয়, একটা মানুষের বিবেক। বিবেকবান মানুষ ঠিকই বুঝতে পারে, কোনটি ধর্ম আর কোনটি অধর্ম। তার ভিতর সহজাতভাবে জন্ম নেবে ধর্মের। সে ধর্ম ন্যায়ের, সে ধর্ম মানবতার, সে ধর্ম সাম্যের। বায়তুল মোকাররম এর মেঝেতে ঘষে ঘষে বিবেক ক্ষয় করে ফেললে, তলপেটের কাছে গিয়ে ঝুঁকে থাকলে, বিবেক ক্ষয়ে ক্ষয়ে গিয়ে জমা হয় তলপেটের ঠিক নীচটাতে। সে বিবেক দিয়ে কর্ষণ ছাড়া আর কোন কিছুই সম্ভব হয়ে উঠেনা। সে তলপেটে বিবেকধারীরা আসে কর্ষণের দাবী নিয়ে, আসে দিস্তায় দিস্তায় বাণী নিয়ে। আসে আবাবিল হয়ে, আসে প্রস্তর খণ্ড নিয়ে। তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে নারী, একদিন যাদের স্তন্য পান করেই আজ তারা প্রস্তুত হয়েছে, প্রস্তুত হয়েছে কর্ষণক্রিয়ার জন্য। 

নারী! তুমি কি সেই তলপেটে বিবেকধারী পুরুষদের চিনতে পারো? তুমি কি জানো তাদের কোনও ভাগ নেই, বিভাগ নেই? তাদের মধ্যে উঁচু নেই নীচু নেই, বড় নেই ছোট নেই, ডাক্তার নেই ইঞ্জিনিয়ার নেই, ছাত্র নেই শিক্ষক নেই, কুলি নেই, মজুর নেই, রিক্সাওয়ালা নেই কামার নেই, কবি নেই লেখক নেই। আছে শুধু একটা জিনিস, আছে শুধু পুরুষ, তলপেটে বিবেকধারী পুরুষ। নারী! তোমার কি মনে পড়েনা সে দিনের কথা? তুমি কি ধর্ষিত হওনি তোমারই সহপাঠীদের দ্বারা? তুমি কি পরীক্ষার খাতায় লিখে রাখোনি, “আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কোনো ইচ্ছে নেই। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই (জাহাঙ্গীরনগর) ক’জন ছাত্রের হাতে ধর্ষিত হয়েছি।” তুমি কি দেখোনি রোশনারার মত বীর মুক্তিযোদ্ধা তার মর্যাদা পায়নি। একপাল পুরুষ যে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র প্রকাশ করে তাতে তোমাকে দেখানো হয়েছে ‘নিহত’ হিসেবে। ‘শহীদ’ শব্দটি যে তোমার জন্য নয়, তাতে যে একমাত্র পুরুষদেরই একচেটিয়া অধিকার। তুমি কি দেখোনি, তলপেটে বিবেকধারী পুরুষরা ‘বীরাঙ্গনা’ আর ‘বারাঙ্গনা’ এর মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পায়নি। তুমি কি দেখোনি বীরাঙ্গনাদের ঠাঁই দিয়েছে তারা বারাঙ্গনাদের সাথে। 

তবে ভয় নেই, বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন লোক ও এই সমাজে আজ কম নেই। চারিদিকে চলছে  চিন্তার মুক্তি। যদি কিছুই করতে না পার, তবে ঘরে বসে নিজ সন্তানকে শিক্ষা দাও, শিক্ষা দাও দশজনকে। যুক্তি আর সত্য দিয়ে বিচার করতে দাও পৃথিবীকে। এভাবেই শুরু হোক তোমার আন্দোলন। আর পৃথিবীকে জানিয়ে দাও তোমার শক্তির স্বরূপ। আর কোন কবি যেন কোনদিন স্পর্ধা দেখিয়ে বলতে না পারে, “অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।” নিশঙ্ক চিত্তে তাদের বুঝিয়ে দাও, কোন মাপকাঠির মানদণ্ডে তুমি এতটুকু অল্পনা, “পূর্ণ মানবী তুমি শূন্য কল্পনা।” 

১। বাঙ্গালি নারী, মাহমুদ শামসুল হক, প্রথম প্রকাশ, পৃষ্ঠা ২৪৯

২। দৈনিক মানবজমিন, ১৭ আগষ্ট, ১৯৯৮

৩। মহিলা মুক্তিযোদ্ধা, ফরিদা আখতার সম্পাদিত, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ঢাকা       

[email protected]

April 20, 2008