বিবমিষা
রিফা আরা

সভাকক্ষ প্রস্তুত। সবকিছু পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে। সুদৃশ্য টেবিল ধবধবে চাদরে ঢাকা। ফুলদানিতে টাটকা ফুল। একপাশে উপহারগুলো ডাঁই করে রাখা। সারিবদ্ধ চেয়ার। কোথাও কোন ত্রু টি নেই। আর একটু পরেই সবাই এসে বসবে। কদম আলী সব কিছু দেখল। না, কোথাও কোন অবাঞ্ছিত ময়লা নেই। থাকলে কদম আলীকে তিরস্কৃত হতে হবে। কদম আলী এ অফিসের ঝাড়ুদার। গত তেইশ বছর এ অফিস ঝাড়ু দিচ্ছে। বলা যায় এ প্রতিষ্ঠানে যে কজন নীরব কর্মী আছে কদম আলী তাদেরই একজন। ভোর সাড়ে ছটায় আসে। ঝাঁট দিয়ে সব কিছু পরিপাটি করে। তারপর সারাদিন টয়লেট, বেসিন পরিষ্কার করা। অফিস ছুটির পর সবাই চলে গেলেও কদম আলীর ছুটি হয় না। সারাদিনের ময়লা আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলা। যারা নীরব শ্রম দিয়ে সভ্যতাকে গড়ে তোলে কদম আলী তাদেরই একজন। ব্যক্তি স্বভাবে কদম আলী কিছুটা চুপচাপ বলে কারো সাথে তেমন ঘনিষ্ঠতাও হয়না। সবার সঙ্গেই আছে আবার কারো সঙ্গেই নেই - এমন একটা ভাব। অফিসের পলিটিক্সেও আছে নেই এমন। মিটিং ফিটিং এ যায়। কিন্তু চুপচাপ থাকে বলে চেয়ার টেবিলের বাইরে তার অস্তিত্ব তেমন ধরা পড়ে না। কিন্তু মিতভাষীতার কারণে সে অনেকের কাছেই বিশ্বস্ত। কারণ একজনের কথা সে অন্যজনকে বলে না কখনো।  

আজ এ অফিসের বড়কর্তা অবসর নেবেন। তাঁর বিদায় অনুষ্ঠান। গত কদিন থেকে এ নিয়ে প্রচন্ড তোড়জোড়। বিরাট এ হলঘরটিতে সবার বসার ব্যবস্থা হয়েছে। সামনে চেয়ার টেবিল দিয়ে বড়সাহেব, হবু বড়সাহেব এবং আরো কজন। এদিকের সারিতে প্রথমে অফিসারদের এবং তারপর ক্রমান্বয়ে সবার শেষের এই কোণের সিটটি কদম আলীর। কদম আলী সবার আগে এসেছে। কারণ একটু দেরিতে এলে অনেকের গা পা ডিঙিয়ে আসতে হবে। আর অফিসের সামান্য ঝাড়ুদারদের  জন্য এটা বেয়াদবী। কিছুক্ষণ পরেই অফিসের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা হুড়মুড় করে ঢুকলো সভাকক্ষে। অফিসাররা দুএকজন করে হেলে দুলে এলেন। বসলেন। মিটিং শুরু হবার কথা দশটায়, এখন বাজে দশটা তেতাল্লিশ। তার মানে আরো অনেক দেরি হবে।  

অবশেষে সাড়ে এগারোটায় বড় সাহেব এলেন। সবাই উঠে দাঁড়ালেন। মেদবহুল স্ফীত দেহটি কিছুটা নুইয়ে সবার সালামের জবাব দিলেন বড়সাহেব। এবার ফুলের তোড়া প্রদান। প্রথমে হবু বড় সাহেব, তারপর অফিসার, কেরাণী এবং চতুর্থ শ্রেণীর পক্ষ থেকে দেয়া হলো। টেবিলে রাখা ফুলের তোড়ার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছেন বড় সাহেব। কদম আলীর ভীষণ মায়া হলো। একজন মানুষের জন্য একদিনে এতগুলো ফুল নষ্ট হলো। অথচ গাছে থাকলে আরো কদিন ফুটে থাকতো, দেখলেই চোখ জুড়াতো। তাছাড়া যাকে ফুলগুলো দেয়া হলো সেকি এর যোগ্য?  

এবার মাইকে ঘোষণা হচ্ছে। ঘোষক দরাজ গলায় বড় সাহেবের গুণকীর্তন করছেন। কদম আলীর হাসি পেল। এই ঘোষকটি এডমিনিস্ট্রেশনে কাজ করে। কদম আলী কতদিন শুনেছে এই লোকটি বড় সাহেবের রুম থেকে এসে তাঁর বাপ দাদা চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করছেন। অথচ আজ বলছেন - মহানুভব। আরো কী কী সব শব্দের অর্থও কদম আলী বোঝে না।  

এবারে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পক্ষ থেকে পিওন হামিদ মিয়া বলছে। বড় সাহেবের দয়া সহানুভূতির কথা হামিদ মিয়া তার নোয়াখালির আঞচলিক ভাষায় পরিবেশন করছে। কদম আলী শুনতে পেল - বড় সাহেবের মত মানুষ হয় না। তাতো হয়ইনা। কদম আলীর মনে পড়লো - অফিসের বার্ষিক নাটক হচ্ছিলো। সবাই এসেছে পরিবার পরিজন নিয়ে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির সামনে পানির গ্লাস দেয়া হয়নি বলে এই বড় সাহেব সেদিন নাটক দেখতে আসা বৌয়ের সামনে পিয়ন হামিদকে আচমকা চড় মেরেছিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে  কদম আলী দেখেছিল ভয়ে বিস্ময়ে হামিদের বৌয়ের চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসবে। সেদিন আর নাটক দেখা হয়নি বেচারীর।  

এবারে বড় সাহেবের সেক্রেটারি পারভিন সুলতানা বলবেন। কদম আলী গলা উঁচিয়ে দেখল বড় সাহেব একটু নড়ে চড়ে বসলেন। কদমের মনে হলো বড় সাহেব যেন একটু ভয় পাচ্ছেন। না পারভিন সুলতানা খুব সুন্দর করে বড় সাহেবের কথা বলছেন। তিনি শুধু অফিসে নয় পরিবারের প্রতিও কত দায়িত্বশীল তা তাঁর কাছাকাছি থেকে দেখা যায়।

- কচু!

কদম আলী কতদিন ওদের জন্য খাবার এনে দিয়েছে। কদম আলীর সামনে বড় সাহেব স্ত্রীকে ফোন করে বলেছেন, অফিসে জরুরি মিটিং। দুপুরে বাসায় আসতে পারবো না। তারপর দুজনে মিলে খাওয়া দাওয়া, ফুর্তি। আর এখন সেই বলছে পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতার কথা। মেয়েটা পারেও বাবা! এর মধ্যেই হবু বড় সাহেবের সাথে লটপট শুরু করেছে।  

এবার বড় সাহেব দাঁড়িয়েছেন। কদম আলী কান খাড়া করলো।

- প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ

বড় সাহেব বলে চলেছেন, আপনারা জানেন আপনাদের জন্য আমি কি না করেছি।

ছাই করেছেন। এটা একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরকার যখন যা দেয় কর্মচারীরা আন্দোলন করে তা আদার করে। সেবার টেন পার্সেন্টের দাবীতে সবাই এত ক্ষেপে গেলো। কিন্তু বড় সাহেব দেবেন না। শ্রমিক কর্মচারীকে কম দিয়ে কোম্পানির মুনাফা বাড়ালে সাহেবের প্রমোশন বিদেশ ট্যুর ট্রেনিং। আজমল নামের এক শ্রমিক নেতা তখন ধরে বসলো - আমাদের টেন পার্সেন্ট চাই। একদিন তো বড় সাহেবের সামনে দাঁড়িয়েই বলে ফেলল,

- আপনি সব ভোগ করবেন, মালিকের পয়সায় বিদেশ ঘুরবেন। আর আমাদের বাঁচার দাবী মানতে আপনার এতো অসুবিধা কেন?

বড় সাহেব সেদিন কিছুই বলেন নি। কিছুদিন পর আজমল তার ঘরে অফিসেরই দারোয়ানের বউ সহ ধরা পড়লো। বামাল সমেত ধরা। সঙ্গে সঙ্গে ছাঁটাই। ব্যাপারটা আজো সবার কাছে রহস্য। অথচ সেই দারোয়ান আর তার বউ দিব্যি আছে।  

বড় সাহেবের চোখ দুটো ছলছল করছে। সবার কাছে ভুল ত্রু টির জন্য মাফ চাইছেন। ঘোষক আবার  ঘোষণা করছে - আমরা আজ এমন একজন মানুষকে বিদায় দিলাম - - -। 

সবাই বেরিয়ে যাবার পর কদম আলী বেরুলো। এতক্ষণ গরমে এক জায়গায় বসে হাঁফ ধরে গেছে। বের হতেই কদম আলীর ভীষণ বমির বেগ হলো। বাথরুমে ছুটে গিয়ে গলগল করে বমি করলো। একটু শান্তি লাগছে। কদমের মনে হলো সবার বলা এতগুলো পালিশ মিথ্যা তার হজম হয়নি।

 

রিফা আরা। চট্টগ্রাম শাহীন কলেজের বাংলার অধ্যাপক।