পুনর্জন্ম
রিফা আরা

¾ হাসানের মা কই গো? এক্ষণেও তোমার বান্ধা-ছান্দা হইল না। ঘাটে নৌকা আইসা পড়ছে। এখন না বাইর অইলে ট্রেন পাওয়া যাইব না। তারপর আবার সব লইয়া বাড়িও ফিরন লাগব। তখন পাটি বিছাইয়া কানতে বসবা।  

¾ এই তো হইয়া গেছে আমার। বলতে বলতে আবার পোটলা পুঁটুলিগুলো গুণে দেখেন হাসনা বেগম। এই যে এটাতে নাড়ু, নারিকেলের বরফি, রসপোয়া, মুড়ি-মুড়কি, নকশী পিঠা, দুধের ক্ষীর। এটাতে ক্ষেতের ছোলা আর বাদাম। মুখে বলতে বলতে আঙুলের করে হিসাব করেন - কই দশটাতো হল না। আবার পুঁটুলি হাতড়ান- হ্যাঁ এটাতে আমস্বত্ত্ব, আর বাকি দুটো গাছের জামরুল আর গোলাপজাম। এবার মিলেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবার বোরকাটা গায়ে চাপাতে শুরু করেন। 

বাইরে থেকে আবার ডাক শোনা যায় - কই গো হাসানের মা। তাগাদা করো।

¾ আসি, আসি। বলে দুহাতে একগাদা জিনিস নিয়ে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন হাসনা বেগম।

¾ আরে তুমি দেখি বাড়ি শুদ্ধ উঠাইয়া নিছ। এত কিছু নিয়ে ট্রেনে উঠবা ক্যামনে। আমি দেখিনা চোখে, বুড়াবুড়ি উঠুম না এসব তুলবাম।

¾ তোমারে তুলতে অইব ক্যান। মনু তুইল্যা দিব। সে আমাগোরে গাড়িত না তুইল্যা দিলে তারে ভাড়া দিমু নাকি! 

মনু মাঝি এতক্ষণ দাওয়ায় রাখা বেঞ্চিতে বসে বুড়োবুড়ির কান্ড দেখছিল। এরা যতবারই ঢাকা যায় ততবারই এমন হয়। শুকনো মৌসুমে সে যখন রিক্সা চালায় তখন রিক্সায় বস্তার জন্য বসতে পারে না দুজন। বুড়ো হাকিম চাচা চেঁচামেচি করেন ¾ এত নিয়া কী অইব। অরা কি এখন এগুলান খায়? অরাতো এখন খালি ফাস্টফুড আর কি সাপ-ব্যাঙের চাইনিজ খাইয়া বেড়ায়।

¾ অরা না খাক। আমার দিব্য খাইব। চাচীও জবাব দেন।  

এবার মনু মাঝি এগিয়ে এল। দ্যান চাচী আমারে দ্যান। আপনারা দুইজন ঘাটের দিকে আগান। রহমত নায়ে আছে। বাদলা যদি জোরে নামে তাইলে ভিজ্যা যাইবেন। লন, ত্বরা করেন।  

বুড়ো হাকিম সাহেব ফি আমানিল্লাহ বলে লাঠি ঠুক ঠূক করে বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন। হাসনা বেগম দরজার তালাটা আরেকবার ভাল করে টেনে দেখেন বন্ধ হয়েছে কিনা। তারপর রুমালে বাঁধা চাবির গোছাটা হাতব্যাগে রাখেন। মনে মনে আয়াত-আল-কুরসি পড়ে চারদিকে ফুঁ দিতে দিতে উঠোনে নামেন। আকাশ মেঘলা। এত মেঘ যে সকাল বেলাতেই সন্ধ্যা বলে মনে হচ্ছে। গত কদিনের টানা বৃষ্টিতে মাঠ-ঘাট থৈ থৈ করছে। দহলিজের উঠোনের একপাশে কদম গাছটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে। কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে। হাসনা বেগমের মনে হলো, আহা! আগে যদি মনে পড়ত তাহলে দিব্যর জন্য কটা কদম ফুল নিয়ে যেতে পারতেন। ঢাকা শহরে যে দালান-কোঠায় ওরা থাকে সেখানে কদম কোথায়।  

ঘাটে এসে নৌকায় চড়ে আবার সব জিনিসে আর একবার চোখ বুলালেন। কাপড়ের ব্যাগ, চালের বস্তা, নারকেল আর দিব্যর জন্য নেয়া জিনিসগুলো। সব ঠিকঠাক আছে। মনু মাঝি নৌকা ছেড়ে দেয়। নদীর ঘাটে ছিপ ফেলে মাছ ধরছিলো গ্রামের কজন ছেলে-বুড়ো। তাদের মধ্যে একজন- দুলাল জিজ্ঞেস করলো - কই যান দাদা? ঢাকা নাকি? ¾ হ।

¾ নাতিরে দ্যাখতে?

¾ হ, হ, নাতিরে দ্যাখতে আর আমার চোখের ছানি কাটতে। তোর বাপ-মায়েরে দোয়া করতে কইস।

¾ আচ্ছা দাদা। সালামালেকুম।

¾ ওয়ালাইকুম। 

নৌকা ছেড়ে দেয়। গ্রাম ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে এলে হাসনা বেগম ছই-এর ভেতর থেকে বাইরে এসে পাটাতনে বসেন। শ্রাবণ মাসের ভরা নদী। দুপাশের গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে বাড়িঘর। অনেক বাড়ির সীমানায় পানি ছুঁই ছুঁই। বৃষ্টিতে ভিজে গাছের পাতাগুলো কেমন সবুজ হয়ে উঠেছে। বর্ষার পানি পেয়ে গাছগুলো এত ঘন আর নিবিড় হয়ে উঠেছে যে, ভেতরের বাড়িঘর দেখা যায় না।  

¾ আহা কী সোন্দর একখান দ্যাশ বানাইছে আল্লায়। এমুন কি আর কোনখানে আছে? তবু এ দ্যাশের মানুষের এত কষ্ট ক্যান? ক্যান দ্যাশে শান্তি নাই?  

মনে মনে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আল্লাহ তুমি সব মানুষগুলারে তাগো পোলা মাইয়ারে ভাল রাইখো। আমার দিব্যরেও - দিব্যর কথা মনে হতেই আবার চারপাশ ভুলে নিজের মাঝে হারিয়ে যান। ব্যাকুল হয়ে উঠেন- কখন দিব্যকে দেখবেন।

¾ আহারে, আমার সোনা-মানিক ভালা থাইকো তুমি।  

কমলাপুর স্টেশনে থামার আগেই হাসনা বেগম জিনিসপত্র গুণে গুণে মিলিয়ে নিলেন। লোকজন নেমে যেতেই দেখলেন দিব্যর হাত ধরে এগিয়ে আসছে তার বাবা। হাসনা বেগম আর হাকিম সাহেবের একমাত্র পুত্র হাসান। দিব্য ছুটে এসে দাদীর হাত ধরলো। হাসনা বেগম দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। তাঁর মনে এক অপূর্ব আনন্দ। এ আনন্দ যেন দুকূল প্লাবিত নদী।  

¾ কেমুন আছো ভাইয়া?

¾ ভাল। তুমি কেমন আছ দাদী?

¾ খু-উ-ব ভালা। এই যে তোমারে দেখতে পাইলাম। আমি কি ভালা না থাইক্যা পারি।  

দিব্যর বাবা একজন কুলি ডেকে জিনিসপত্র বুঝিয়ে এবার বাবার হাত ধরলেন। তারপর দিব্যকে জিজ্ঞেস করলেন ¾ তুমি দাদুর সাথে নামতে পারবে?

¾ হ্যাঁ বাবা। আমি দাদুকে বাসায় নিয়ে যেতে পারব।

দিব্যর পাকা কথা শুনে বাবা, দাদা-দাদী একসঙ্গে হেসে উঠলেন।  

বাসায় এসেও দিব্যর আনন্দ ধরে না। মা অফিসে, বাবাও ওদের নামিয়ে অফিসে চলে গেছে। গোসল খাওয়া সেরে বিশ্রাম নেবার সময় হলে রীনাবু এসে দিব্যকে নিয়ে যেতে চায় তার ঘরে। অন্য সময় রীনাবুবুই তাকে ঘুম পাড়ায়। কিন্তু আজ সে কিছুতেই নিজের ঘরে ঘুমুতে যাবে না। রীনাবুবুর হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে এসে দাদা দাদুর মাঝখানে লাফিয়ে পড়ে দাদীর গলা জড়িয়ে ধরে ¾ আমি তোমার কাছে থাকব, আমি গল্প শুনব।  

¾ কী গল্প শুনবা ভাইয়া?

¾ ঐ যে বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর গল্প, সেবার যে বলেছিলে। দুষ্টু ভুতটার গল্প যে জেলের মাছ খেয়ে ফেলত।

¾ আইচ্ছা তোমার সব মনে আছে?

¾ হ্যাঁ, আছে তো। এখন আমার স্কুল বন্ধ। আমি তোমার কাছে গল্প শুনব। এত্তো এত্তো গল্প!

দাদী হেসে দিব্যর কপালে চুমু খান। আলতো করে গায়ে হাত বুলান। তারপর গল্প বলতে শুরু করেন ¾ এক দ্যাশে আছিল এক রাজা। আচমকা ছোট্ট হাত দিয়ে দাদির মুখ চেপে ধরে দিব্য প্রশ্ন করে ¾ দাদী, তুমি দ্যাশ বল কেন? ওটাতো হবে দেশ

দিব্যর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠেন দাদা। তোমার দাদী যে শুদ্ধ বাংলা বলতে পারেন না দাদুভাই।

¾ হ, আমি তো তোমার দাদার মত শিখ্‌খিত না। উনি তো মাস্টার। সারা জীবন কত ছাত্র পড়াইলেন।

¾ দাদা, তুমি টিচার! এবার দাদার দিকে মুখ ফেরায় দিব্য।

¾ হ্যাঁ দাদাভাই আমি টিচার ছিলাম।

¾  তাহলে দাদীকে লেখাপড়া শেখাওনি কেন?

সাত বছরের নাতির প্রশ্ন শুনে হত-বিহ্বল হয়ে পড়েন হাকিম সাহেব। এ কথাতো কোনদিন তাঁর নিজেরও মনে হয়নি। কত মানব শিশুকে তিনি শ্রমে-ধৈর্যে মানুষ করেছেন। কিন্তু যে গ্রাম্য কিশোরীটি তার ঘরে এসেছিল বৌ হয়ে তাকে লেখাপড়া শেখানোর কথা কখনো মনে আসেনি। অথচ গ্রামের স্কুল শিক্ষক হয়েও নিজের তিন মেয়ে এক ছেলেকে শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। গ্রামের কত ছেলে তাঁর হাতে পড়ে মানুষ হয়েছে। আজও গ্রামের মানুষ সব কাজে তাঁর কাছে পরামর্শ চাইতে আসে। এখনো সবাইকে ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে উসাহ দেন। অথচ ¾ ভাবতে ভাবতে কেমন যেন বিষন্ন হয়ে পড়েন হাকিম সাহেব।

¾ কি দাদাভাই চুপ করে আছ কেন? বল না।

¾ তোমার দাদাভাই কী কইব! আমি কই শুন। আমি যখন তোমার মত ছোড ¾ তখন আমার বাবা আমারে ইশকুলে ভর্তি কইরা দিছিল। কিন্তুক একদিন পন্ডিতস্যারে যখন একটা মাইয়ারে বেত মারল সেই দেইখ্যা এমন ভয় পাইলাম যে আর কুনোদিন বাবায় আমারে ইশ্‌কুলে পাঠাইতে পারে নাই। এর লাইগ্যা মায়ের হাতে কত যে মাইর খাইছি।

¾ তাহলে এখন আমার সাথে পড়তে বস। আমার মামণিকে বলব তোমাকেও পড়া শেখাতে।

দিব্যর কথা শুনে এবার দাদা-দাদী দুজনেই হেসে ওঠেন।

¾ আইচ্ছা, আইচ্ছা অইবনে। এখন আস তোমারে খোকন রাখালের পিঠাগাছের গল্প শুনাই।

¾ বল, বল।  

দাদী বলেন ¾ অনেক অনেক বছর আগে এক গেরামে আছিল এক রাখাল। তার নাম খোকন। খোকনের বাপ ছিল না ছিল শুধু মা। তো খোকনদের দুইটা দুধেল গাই খোকন মাঠে চরায়। মা গেরামে দুধ বিক্রি করে তাইতে কোনরকমে চলে। একদিন খোকনের খুব ইচ্ছা হইল পিঠা খাইতে। মাঠ থেকে ফিরা আইসা খোকন মায়েরে ডাক দেয় ¾ মা, মা। মা ঘর থেইক্যা বাইরে আসেন। কি রে খোকন এত ডাক পাড়িস ক্যান?

¾ আমি পিঠা খামু মা।

¾ আমরা গরীব মানুষ পিঠা কোথায় পামু বাবা। দুই বেলা ভাত খাইতে জান হাশর হইয়া যায়। ¾ ¾ দাদী গল্প বলে যেতে থাকেন। আর দাদা-দাদীর মাঝখানে উপুড় হয়ে শুয়ে দুহাতের তালুতে মুখ রেখে অপার আগ্রহ নিয়ে সে গল্প শুনে দিব্য।  

দাদার চোখের অপারেশন হয়ে গেছে। চোখের ভেতর লেন্স লাগিয়ে দেয়ায় তিনি এখন ভাল দেখতে পান। অন্যরকম এক আনন্দ তাঁর মনে। বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অস্থির। প্রায় দুমাসের বেশি তিনি বাড়ি থেকে এসেছেন। ঘর-বাড়ি, এমন কি গ্রামের মানুষগুলোকে দেখার জন্য তাঁর প্রাণটা ছট্‌ফট করছে। কেবলই মন হচ্ছে আবার নতুন কাজে হাত দেবেন। ঘরে ঘরে গিয়ে বলবেন, মাগো, তোমার ছোট্ট ছোট্ট মেয়েগুলোকে স্কুলে পাঠাও। শিক্ষা ছাড়া কোনদিন কোন মানুষের উন্নতি হয় না। কিন্তু ছেলে মেয়েরা তাঁকে গ্রামে যেতে দিতে নারাজ। বড় মেয়ে প্রতিদিন অফিস ফের তাঁকে দেখতে এসে - নিজের বাসায় নিতে চায় কিন্তু দিব্য তার দাদীকে কিছুতেই ছাড়বে না। আর দাদী না গেলে দাদার পক্ষেও তো যাওয়া সম্ভব নয়। হাসনা বেগম পাশে না থাকলে তিনি যে অচল। এদিকে বাড়ি থেকে মনু মাঝি তার ছেলেকে দিয়ে চিঠি লিখে পাঠিয়েছে - আমন ধান পাকতে শুরু করেছে। তাকে যে যেতেই হবে।

একদিন বিকেলে দিব্যর বাবা অফিস ফেরত টিকেট করে আনেন। দাদী গোপনে চোখের জল মোছেন আর জিনিসপত্র গোছান। দিব্যকে ছেড়ে যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না তার। কেবলই কান্না পাচ্ছে। কেবলই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। দিব্য এখনো জানে না। দাদীই বলেছেন না জানাতে। জানলেই বাড়িতে একটা হুলুস্থুল লাগিয়ে দেবে। এমনিতেই প্রতিদিন সকালে স্কুলে যেতে তার হাজার রকম বায়নাক্কা। প্রতিদিন দুপুরে নতুন নতুন গল্প শোনাবার প্রতিজ্ঞা করে তারপর স্কুলে পাঠাতে হয়। হাসনা বেগম তার সারাজীবনের জমানো গল্পের ঝুড়ি উজাড় করে দেন নাতির কাছে। সেই কবে দাদীমার কাছে শোনা সুয়োরাণী দুয়োরাণীর গল্প, আলাল-দুলাল দুভাইয়ের গল্প, ডাইনি বুড়ি, দত্যি-দানো কি নেই। হ্যাঁ,  ছোটবেলা থেকেই গ্রামে তার গল্প বলার সুনাম ছিল। কত চাঁদনী রাতে নিজের ছেলে-মেয়েদের, গ্রামের বৌ-ঝিদের তিনি গল্প শুনিয়েছেন। কিন্তু কখনো নাতিকে গল্প শোনানোর মত আনন্দ তিনি পাননি। এসব ভাবতে ভাবতে কাপড় গোছাতে কান্নার মাঝেও স্মিতহাসি ফুটে উঠে মুখে ¾ এক গল্প দশবার শুইনাও আবার শুনতে চায়। 

¾ মা

¾ কি বৌমা? দিব্যর মায়ের ডাকে ঘুরে তাকান হাসনা বেগম।

¾ আর কয়টা দিন থেকে গেলে হয় না মা? আপনারা থাকলে দিব্য এত হাসি খুশি থাকে আর অফিসে গেলে আমারও ওর জন্য চিন্তা থাকে না।

¾ আমার তো থাকতে ইচ্ছা করে বৌমা। তোমার শ্বশুর যে বাড়ি যাইবার লাইগ্যা অস্থির হইয়া পড়ছেন। তাছাড়া ধান উঠার সময় আইছে। না গেলে তো চলে না মা। তা দিব্য কই বৌমা?

¾ পড়তে বসেছে। আপনারা চলে যাবেন শুনে খু-উ-ব মন খারাপ। আমি বলেছি পড়া শেষ করলে দাদী তোমাকে আজ অনেক মজার মজার গল্প শোনাবে। আমরা সবাই ছাদে পাটি পেতে বসে গল্প শুনব, সারারাত।  

হাসনা বেগমের এবার ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করে। হায়রে কেমন করে দিব্যকে রেখে বাড়িতে একলা থাকবেন তিনি।  

ঘুমন্ত দিব্যর কপালে আলতো চুমু খেয়ে রওনা দেন হাসনা বেগম ও হাকিম সাহেব। আজ শুক্রবার দিব্যর স্কুল নেই। কাল অনেক রাত পর্যন্ত দিব্য তার কাছে গল্প শুনেছে। ভেলুয়া সুন্দরী আর বেহুলা লক্ষীন্দরের গল্প শুনে সে তো অবাক। তারপর ঘুমুতে যাওয়ার সময় বলেছে, আমি তোমাকে চিঠি লিখবো দাদী। তুমি আমাকে চিঠিতে গল্প লিখে পাঠাবে। আমি আমার বন্ধুদের পড়ে শোনাব। ওরা তোমার রাখালের সেই পিঠা গাছের গল্পটা শুনে যা মজা পেয়েছে। জানো দাদী ওদের কেউ গল্প বলে না। আমাকেও তো মা-মণি শুধু সিডি কিনে দেয়। কিন্তু আমার তোমার কাছে গল্প শুনতে ভালো লাগে। সারাটা পথ দিব্যর কথা ভাবতে ভাবতে চোখের জলে ভাসতে থাকেন হাসনা বেগম।  

এখন সারামাঠে হেমন্তের পাকা ধান। এখন আর নৌকা চলে না। মনুমাঝি স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। সে গাড়ি থেকে ব্যাগ সুটকেস নামিয়ে তাদেরকে রিক্সায় তুলল। রিক্সায় প্যাডেল মারতে মারতেই মনু জানতে চায়, হাসান ভাই ভাবীজান কেমুন আছে চাচা? ওনাগো পোলাডা ভালা আছে নি? দ্যাশে আহে না ক্যান? দ্যাশ গেরাম চিনতে অইব না? মনুর এই এক দোষ। কথা বলা শুরু করলে থামতে চায় না।  

¾ হেরা ক্যামনে আস্‌ব। বৌমা - হাসান দুইজনেই তো চাকরি করে। আর ঈদের সময়তো আসেই। শহরের বাসাবাড়ি খালি রাইখা কি সবসময় আসন যায়? তুই কি বুঝবি? পথ দেখে সাবধানে চালা। এত কথা কইস না তো।

হাকিম সাহেবের ধমক খেয়ে চুপ করে যায় মনু মাঝি।  

বাড়ি এসে ধান তোলার কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন হাসনা বেগম। মাঠ থেকে ধান আসে। কাজের মানুষদের দিয়ে সে ধান শুকাতে হয়। ঝাড়া-বাছা শেষে মরাইতে রাখতে হয়। তদারকি না করলে চলে না। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘরের দাওয়ায় জলচৌকি পেতে বসে সব কিছু দেখেন হাসনা বেগম। এখন আর আগের মত নিজে ছুটাছুটি করতে পারেন না। এরই মাঝে সারাক্ষণ মনে পড়ে দিব্যর কথা। কখন স্কুলে যাচ্ছে, কখন ফিরল সব যেন দেখতে পান তিনি। আর দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে জিরিয়ে নেবার জন্য একটু গড়াগড়ি দিতে গেলে কেবলই কানে বাজে ¾ দাদী একটা গল্প বল। ঐ কাজলরেখার গল্পটা আবার বল না দাদী। হাসনা বেগম তখন কিছুতেই কান্না চেপে রাখতে পারেন না।  

আজ সকাল থেকে ধান ঝাড়তে বসেছে চারজন। মাঝখানে ধানের স্তূপ। উঠোনের আম, কামরাঙা আর জামরুলের ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে রোদের ঝিলিমিলি। খোপের কবুতরগুলো গলা আর পেখম ফুলিয়ে বাকুম বাকুম করছে। হাসনা বেগম একটা লম্বা ছড়ি নিয়ে মুরগি আর চড়ুই তাড়াচ্ছেন। এমন সময় হাকিম সাহেব বাইরের বাড়ি থেকে ফিরলেন। তাঁর হাতে একটি হলুদ খাম। আগে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করার সময় হোস্টেলে থাকতে এমন খামে চিঠি আসত। হাকিম সাহেব পড়ে শোনাতেন তাকে। এখন মোবাইল ফোন আছে। ওরা ফোন করে। কিন্তু দিব্য ছোট বলে তার মা তাকে ফোনে কথা বলতে দেয় না।

¾ কই গো, তোমার চিঠি আইছে।

¾ আমার চিঠি? আমি কি পড়তে জানি? সারাজীবনে কুনুদিন আমার চিঠি আইছিল?

¾ আহা, এখনতো আইছে। তোমার নাতি লিখছে। এই দেখনা তোমার নাম লেখা।

তিনি খামটি হাসনা বেগমের চোখের সামনে ধরেন।

¾ পড়েন, পড়েন দেখি কী লিখছে আমার দিবু সোনা। 

হাকিম সাহেব খাম খুলে পড়েন ¾  

দাদী,

তুমি কেমন আছ? দাদাভাই কেমন আছে? তোমরা চলে গেছ আমার কিছু ভাল লাগে না। বাসাটা খালি খালি লাগে। তুমি আবার এলে আমি তোমার সাথে বাড়ি চলে যাব। তোমার কাছে গল্প শুনব। এখন কেউ আমাকে গল্প বলে না। তুমি আমাকে চিঠি লিখবে। তুমি কেন লেখাপড়া শেখনি দাদী? তুমি চলে এসো, চলে এসো, চলে এসো।

দিব্য। 

হাসনা বেগমের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। তিনি চোখে আঁচলচাপা দিয়ে ঘরে চলে যান। ফুঁপিয়ে উঠেন ¾ দিব্য, আমার দিবু সোনা।  

সেদিন সন্ধ্যায় হাকিম সাহেব ও হাসনা বেগমের ঘরে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। হাকিম সাহেব খাটে বসে একটা বই পড়ছিলেন। হাসনা বেগম তাঁর পাশে এসে বসেন। তারপর বলেন ¾ আপনেরে একখান কথা কইলে রাখবেন?

¾ কী কথা কওনা শুনি।

¾ আমারে লেখাপড়া শিখাইবেন? আমি দিব্যরে চিঠি লিখুম।

বলতে বলতে আঁচলের নিচ থেকে একটা বই আর খাতা বের করেন হাসনা বেগম।  

কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন হাকিম সাহেব। কোনদিন যা চাননি আজ এতদিন পর তাই চাওয়া। শুধু নাতির জন্য! তাঁর কানে বেজে ওঠে ছোট্ট দিব্যর সেই প্রশ্ন ¾ দাদা তুমি টিচার। তাহলে দাদীকে লেখাপড়া শেখাওনি কেন?  

সোজা হয়ে বসেন হাকিম সাহেব। তারপর হাসনা বেগমকে বলেন, হ্যাঁ আমি তোমারে লেখাপড়া শিখামু। না অইলে আমি আর কেমন শিক্ষক। এতদিন ঘর অন্ধকার রাইখ্যা বাইরে আলো জ্বালাইছি। এইবার ঘরে জ্বালামু।  

রাত গড়ায়। একজন বৃদ্ধ শিক্ষক নতুন দৃষ্টি নিয়ে তার নবীন ছাত্রীটিকে পড়াতে থাকেন। হাসনা বেগম শৈশবের দুরন্ত বালিকা নয়, মনোযোগী ছাত্রীর মতই সবটুকু শিখতে চান। তাকে যে শিখতে হবে। দিব্যকে চিঠি লিখতেই হবে।

 

রিফা আরা। চট্টগ্রাম শাহীন কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।