কান্নার রঙ, জোস্ন্যার ছায়া 

 

যুদ্ধ পরবর্তী সর্বাংশে ভঙ্গুর সদ্য ভূমিষ্ট দরিদ্র শিশু রাষ্ট্র বাংলাদেশে সমস্যার তখন কোন অন্ত ছিল না, যেদিকেই চোখ যায় চতুর্দিকে হানাদারদের ফেলে যাওয়া ধ্বংসের ছায়া অধিকাংশ জনগনই ছিলেন তখন স্বজন হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত, সাথে ছিল নিজেদের মধ্যে লালন করা বিভীষিকাময় স্মতি আর নিজেদের বাড়িঘরে হানাদারদের রেখে যাওয়া ধ্বংসের চিহ্নের মধ্যে শোকে মূহ্যমানযেদিকে চোখ যায়, ধুসর চারিধারসবার জীবন লালিত হচ্ছিল অসংখ্য সমস্যার মধ্যে এরমধ্যে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিতা নিপীড়িতা নারীদের সমস্যা ছিল আরো হৃদয়বিদারকযারা ঢাকতে পারতেন এই লজ্জা, অপমান তারা কোনরকমে ঢেকে রাখলেন আর যারা পারলেন না তারা মরমে মরে রইলেন বাকশক্তিহীন হয়েঅতি আদরের যে মেয়েটি একবেলা রাগ করে ভাত না খেলে বাবা সে অভিমান সহ্য করতে পারতেন না, তার সাধ্যের মধ্যে থাকা সবকিছু করে ফেলতেন মেয়ের রাগ ভাঙ্গানোর জন্য, সেই মেয়েটি মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে হয়ে গেলো মৃত, কিংবা চলে গেলো এমন কঠিন কোন দূরত্বের ব্যবধানে যা কখনও ঘোচানো যায় নামৃত মানুষের নাম উচ্চারন করে কেউতো কাদে কখনও কখনও, কিন্তু তাদের নাম উচ্চারনও নিষিদ্ধ হয়ে যায় নিয়তির কোন নির্মম টানেকাদলেও নিঃশব্দ, কেউ যেনো জানতে না পারে, এমন ভাব করতে হবে যেনো মেয়েটি এই বাড়ীতে কখনই ছিল না কিংবা সে পৃথিবীতে কখনই জন্মায়নি। সেই হতভাগীদের অতি ভালোবাসার পরিবার পরিজনরা তাদের এই দুঃসময়ে তাদের কাছে টেনে নেয়ার বদলে বরং হয়ে ওঠে অপরিচিত মুখএকদিন যার সাথে অনেক ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি বিনিময় হয়েছিল সে আজ অনেক অচেনা, অসংখ্য স্বপ্ন নিয়ে বড় ওঠা চির পরিচিত সেই আঙ্গিনা আজ তার জন্য বন্ধযুদ্ধ করে সবাই পেলো স্বাধীন বাংলাদেশ আর তারা হারালো সমস্ত কিছুপরিবার, পরিজন, বন্ধু, সমাজ, ভালোবাসা, স্নেহ, ঘর, স্বপ্ন সব রাষ্ট্র তাদের বীরাঙ্গনাখেতাব দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ করলকিন্তু এই বীরাঙ্গনাদের এবং তাদের গর্ভে থাকা অনাহুত শিশুদের সামাজিক, অর্থনৈতিক পুর্নবাসনের কোন দায়িত্ব তারা নিল না, তৈরী হলো না রাষ্ট্রের তরফ থেকে তাদের জন্য কোন আশ্রয়কেন্দ্র বুদ্ধিজীবিরা তাদের দায়িত্ব শেষ করলেন হূদয়বিদারক উপন্যাস, গল্প আর নাটক রচনার মধ্যেইতারা সোচ্চার হননি এইসব হতভাগীদের সমাজে পুর্নবাসনের দাবীতে মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের দাবীর শ্লোাগান নিয়েআজও ভাবলে গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে, দেশের জন্য নিষ্পেষিত, বিলীন হওয়া এইসব সৈনিকদের প্রতি সমাজ, পরিবার কতোটা নিষ্ঠুর ছিল 

সে সময়ে অনেক বিদেশী সংস্থা বাংলাদেশে যুদ্ধ পরবর্তী পুর্নবাসনে সহায়তা করছিলযারা রাস্তা-ঘাট, পুল-কালভার্ট নির্মান, আহত সৈনিকদের চিকিসা দেয়াসহ নানা পুর্নবাসন পরিকল্পনার সাথে সাথে এই সম্যাটিকেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলো এবং সেইসব নারীদের এবং শিশুদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পুর্নবাসনের প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ছিল অভিবাসন ইউরোপের অনেক সংস্থায়ই তখন যুদ্ধে যে সব শিশুরা তাদের বাবা-মাকে হারিয়েছে, অনেকে যারা বাবা-মাকে খুজে পাচ্ছে না, অনেকে যারা অনাহুতভাবে বা সামাজিক বীধি ছাড়া সমাজে এসে পড়েছে, অনেক দরিদ্র পিতামাতা যারা যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে ক্ষুধার জ্বালায় সন্তান বিক্রি করছে কিংবা অসুস্থ ক্ষুধার্ত সন্তানকে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে গেছে তাদের পুর্নবাসনের, অভিবাসনের ব্যবস্থা করেছিল যে সমস্ত ঘটনা দেশের লোককে কাদাতে পারেনি সে সমস্ত ঘটনায় অনেক অচেনা বিদেশীরা চোখের জল ফেলে ছিলেন ভাবতেও কেমন একটা অচেনা অনুভূতি হয় সমস্ত শরীরেইউরোপে তখন অনেক শিশুদের আগমন হয় বাংলাদেশ থেকে এরমধ্যে ডেনমার্ক, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এ সবচেয়ে বেশী শিশু আসে রাজনীতি সম্পর্কে আমার খুব একটা আগ্রহ বা জ্ঞান কখনই ছিল না কিন্তু পত্রিকা পড়ার সুবাদে আর নেতাদের কাদা ছোড়াছুড়ির কারণে অনেক জিনিসই না চাইলেও চোখে পড়ে যায় অনেক সময় পত্রিকার খবরনুযায়ী যে সময় রাজধানী ঢাকাতে অনেকেই ধন সম্পদের পাহাড় গড়ার মহড়া দিচ্ছিলেন ঠিক সে সময়েই অনেকে সামান্য খাবারের বিনিময়ে সন্তানকে বিক্রি করে দিচ্ছিলেন বিদেশীদের কাছে চিরজনমের মতো, সারাজীবনে হয়তো বুকের মানিককে আর একটিবারও দেখতে পাবেন না এ নিদারুন সত্য জানা সত্বেওকি বিচিত্র এই সভ্যতাঅবশ্য এখেলা আমাদের দেশে হরদমই ঘটে যাচ্ছে আজোওএক শ্রেনী দেশে পয়সা খরচ করে আনন্দ পান না বিধায় ইন্দোনেশিয়া থেকে লাসভেগাস পর্যন্ত যান ক্যাসিনো খেলতে আর তার বাড়ীর পাচ কিলোমিটারের মধ্যেই হয়তো অন্য একজনকে দেখা যায় খাদ্যের অভাবে কুখাদ্য খেয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যেতে, কিংবা অভাব ঘোচানোর জন্য প্লেনের চাকা ধরে বিদেশ যাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় মৃত্যুবরন করতেএই লেখাটি তেমন কোন হতভাগ্য জীবনটিকে কেন্দ্র করেই চলবে 

আবীর চাকুরীর সুবাদে নেদারল্যান্ডসে আছে একা, মাত্র কমাস আগে দেশ থেকে এসেছেএক শীতের সন্ধ্যায় এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই পরিচয় হয় ২২ বছর আগে মাত্র পাচ বছর বয়সে বাংলাদেশ থেকে চলে আসা বেবুলের সাথেআবীর বাংলাদেশ থেকে এসেছে এবং বাংলাদেশী জেনে বেবুলের আগ্রহের সীমা ছিল না তার সাথে কথা বলারদুজন তখন রেস্টুরেন্টে দাড়িয়ে টেলিফোন নাম্বার আর ঠিকানা বিনিময় করলেও ব্যস্ততার কারণে তেমনভাবে আর যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি দুজনের মধ্যেতাছাড়া দুই বিপরীত লিঙ্গের স্বাভাবিক সঙ্কোচতো ছিলইতার কিছুদিন পর আবীর ছুটিতে দেশে এসে, বিয়ে করে এবং প্রায় তার সাথে সাথেই বউকে নিয়ে নেদারল্যান্ডসে এলোআবীর বউকে নিয়ে মাঝে মাঝে সেই রেস্টুরেন্টে খেতে যেতো বাড়ীর কাছে বলেতখন হঠা একদিন আবীর গল্পচছলে তার বউ মোহরকে বেবুলের কথা বললমোহর শুনে যোগাযোগ করতে খুবি আগ্রহ প্রকাশ করল কিন্তু ততদিনে আবীর বেবুলের কনটাক্ট নাম্বার হারিয়ে ফেলেছেদিন যায় দিন আসেআবীর আর মোহরের সেই রেস্টুরেন্টে হঠা একদিন আবার বেবুলের সাথে দেখা হলোআবীর বেবুলকে প্রথম চিনতে না পারলেও বেবুল তাকে চিনতে পেরেছিল সাথে সাথেইআবার নতুন করে যোগাযোগ এবং আলাপ-পরিচয়মোহরকে দেখে বেবুলও একটু স্বস্তি বোধ করছিলবিদেশী ছেলেদের সম্পর্কে ধারণা সবসময় খুব ইতিবাচকতো নয় এদেরঅনেক ঠেকেই শিখেছেএবার ঠিকানা বিনিময় করতে গিয়ে দেখা গেলো মোহররা বেবুলের খুব কাছাকাছিই থাকে, প্রায় ধরতে গেলে একই কম্পাউন্ডের মধ্যেএবার আর মাঝখানে বিরতি পড়ল নাসদ্য দেশ থেকে আগত কাজ-কর্মহীন, বন্ধু-বান্ধবহীন মোহর একা একা থাকে এই ফিলিপস সিটির ফ্ল্যাটেস্বামী মহাব্যস্ত তার চাকরী আর পড়াশোনা নিয়েটিভি ছাড়লেই শুধু ডাচ, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, টার্কী ভাষার অনুষ্ঠান আর তার সাথে আছে বিবিসির খবর, সিএনএন এর খবরমোহরের কাছে তখন টিভি থাকাও যা না থাকাও তাইযে এম,টিভি দেখার জন্য এক সময় দেশে হেদিয়ে মরে যেতো সেই এম,টিভি হল্যান্ডে এসে পানসে হয়ে গেলোতখনো ই-মেল আর ইন্টারনেট এতো সুলভ হয়ে ওঠেনি নেদারল্যান্ডসে আর বাংলাদেশেতো আরোই দূরের ব্যাপার ছিলো সেগুলোচিঠি আসতো মাসে দুটো কি তিনটাখবরের কাগজ নেই, আড্ডা নেই, টেলিফোন দূর্মুল্যসেই দুঃসময়ে এক কম্পাউন্ডের মধ্যে বেবুলকে পেয়ে মোহর হাতে চাদ পাওয়ার চেয়েও বেশী কিছু বোধহয় পেয়ে ছিলো হোক না গায়ের চামড়া ব্যতীত পুরো ডাচ তবুও কখনোতো বাংলাদেশ থেকে এসেছিলা 

মোহর তখন ডাচ স্কুলে যায় আর তার সদ্য শেখা ডাচ প্র্যাকটিস করার জায়গা হলো বেবুল, আর সারাজীবন ডাচ বলায় অভ্যস্ত বেবুলের ইংরেজী প্র্যাকটিসের জায়গা হলো মোহর বেবুলের বন্ধু পিট তখন আমষ্টারডামে চাকরী করছে আর বেবুল এখানকার ইউনির্ভাসিটিতে গ্রাফিক্স আর্ট এ্যান্ড ডিজাইনিং এর উপর গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে দুপক্ষের প্রবল আগ্রহ এবং নিসঙ্গতার কারণে প্রবল বন্ধুত্ব তৈরী হলো অতি দ্রুতপ্রায় অলিখিত একটি চুক্তি তৈরী হলো, সারা সপ্তাহ ওরা মোটামুটি একসাথে কাটায় আর উইকএন্ড এলেই ছুটি কারণ দুজনের বরই তখন বাড়ি থাকেমোহর এর একমাত্র কাজ তখন ডাচ স্কুলে যাওয়া আর বাসায় এসে হোমওর্য়াক করাতারপর দোকান থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হিন্দী ফিল্ম দেখা আর মাঝে মাঝে রান্না করাআর বেবুলের কাজ তখন মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রচুর ছবি আকা আর চাকরীর ইন্টারভিউ দেয়া মাঝে মাঝেপ্রায় রোজ মোহর স্কুল থেকে ফিরলে তার কিছুক্ষন পর একটি টেলিফোন আসতো বেবুলের, তুমি কি ব্যাস্ত ? আমি কি আসতে পারি? মোহর তখন বেবুলকে বাঙ্গালী কায়দা শিখালো যে রোজ ফোনের দরকার নেই, যখন আসতে ইচ্ছে হবে এসে কলিং বেল চাপবেবেবুল একটু ভয় পেলো যদি মোহর ব্যস্ত থাকে কিংবা বিরক্ত হয়, মোহর বলল, তাতেও সমস্যা নেই, আমরা এতে অভ্যস্তকিন্তু বেবুল ডাচ সিস্টেম চালু রাখায় অগত্যা মোহর বাঙ্গালী সিস্টেম চালু দিলোযেদিন বেবুল আসতো না কোন কারণে সেদিন মোহরই যেতো বাঙ্গালী সিস্টেমে টেলিফোন ছাড়াএরপর বেবুলও বাঙ্গালী সিস্টেম আরম্ভ করল কোন নোটিস ছাড়াই কলিংবেলে হাত দেয়ামাঝে মাঝেই একসাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া কিংবা শপিং করতে যাওয়া হতোদেশে বৃষ্টি পড়লে বাড়ী থেকে বেড়োনো নিষেধ, এমনকি মাঝে মাঝে বৃষ্টির কারণে দেশে স্কুল পর্যন্ত ছুটি হয়ে যেতে দেখা অভ্যস্ত মোহর বেবুলের পাল্লায় পড়ে বরফের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে ওর সাথে সাত / আট কিলোমিটার দুরে রঙ্গের দোকানে রং কিনতে গেলোগৃহকর্মে নিদারুন অপটু মোহর ফার্নিচার রং করাও শিখে গেলো ডাচ ললনার পাল্লায় পড়ে। বাড়িতে ফোনে বলল। কেউ বিশ্বাসই করতে পারলো না, ভদ্রলোকের মেয়ে বাড়ি বসে রং মিস্ত্রীর কাজ করছে !!! ঠিকমতো ডালে সম্বার দিতে পারে না, ছয় মাস আগে ঢাকা থেকে নাকের জল চোখের জলে এক হয়ে যাওয়া মোহর এখন চেয়ার রং করছে বললেই হলো আর কি? কিন্তু কি করে কাউকে বোঝাবে এগুলো গল্প মনে হলেও আসলে সত্যি। প্যানকেক খাওয়ার কতোরকম ডাচ পদ্ধতি আছে তাও শিখতে শিখতে মোহর ওজন বাড়িয়ে ফেললো নিজেরএকসাথে বরফ নিয়ে খেলা করতে করতে এক সময় অনেক দূরের অচেনা এই দেশটিও আস্তে আস্তে নিজের হতে শুরু করল মোহরের কাছে তখনআর এই পরদেশটিকে আপন করিয়ে দেয়ার পেছনে অনেক অবদান আছে সেই দূর নিজের দেশ থেকে কখনও প্রায় তাড়িয়ে দেয়া সেই মেয়েটির ............ 

(চলবে) 

তানবীরা তালুকদার

জুলাই ২০০৬