বাংলা ব্লগ

বিবর্তনের আর্কাইভ

বিবর্তন ব্লগ

মুক্তমনা কি?

প্রজেক্ট

ইবই

সাহায্য


  ভ্রান্ত ধারণা

মহাবিশ্ব  জীবনের জন্য সূক্ষ্ম–ভাবে সমন্বিত

 

 

) প্রতিনিয়ত অন্ধ, খোঁড়া, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, রোগ শোক, মহামারী থেকে শুরু হাজারটা উদাহরণই চোখের সামনে আছে যা জীবনের জন্য সূক্ষ্ম –ভাবে সমন্বিত এই ধারণার বিপরীতেই যাবে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় লক্ষ কোটি প্রজাতি টিকে থাকার সংগ্রামে হেরে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি - বিবর্তনের ইতিহাসে শতকরা ৯৯ ভাগ প্রজাতিই কোন না কোন সময় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কাজেই প্রকৃতির তথাকথিত ডিজাইন কিংবা ফাইন টিউনিং – এগুলো তাদের জন্য কোন কাজেই আসেনি। অসংখ্য মানুষও বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে বলি হয়ে যেমন বিভিন্ন রোগে কিংবা দুর্যোগে মারা গিয়েছে। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের তলদেশে ভূসঞ্চরণের কারণে ধেয়ে আসা সুনামিতে লক্ষ লক্ষ নিষ্পাপ নর-নারী আর শিশু মারা গেছে। এ উদাহরণগুলো খুব কমই প্রকৃতির সূক্ষ্ম-সমন্বয়ের দিকে ইংগিত করে, বরং নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোন সূক্ষ্ম-সমন্বয়ক এ ভুলভ্রান্তিগুলো দূর করায় সচেষ্ট হলে এই ব্যাপক প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব ছিল।

 

২) ফাইনটিউনিং আর্গুমেন্টের মধ্যেই রয়েছে নানা পরস্পরবিরোধিতা। জীববিজ্ঞানের ‘ফাইন টিউনার’রা যে ভাবে যুক্তি সাজিয়ে থাকেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের ‘ফাইন টিউনার’রা দেন ঠিক উলটো যুক্তি। জীববিজ্ঞানের  সূক্ষ্ম-সমন্বয়ের প্রবক্তারা বলেন আমাদের বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড প্রাণ সৃষ্টির পক্ষে এতটাই অনুপযুক্ত যে প্রাকৃতিক নিয়মে এখানে এমনি এমনি প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে না। আবার জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম-সমন্বয়ের প্রবক্তারা উলটো ভাবে বলেন, এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড প্রাণ সৃষ্টির পক্ষে এতটাই উপযুক্ত যে এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড প্রাকৃতিক নিয়মে কোনভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। একসাথে দুই বিপরীতধর্মী কথা সত্য হতে পারে না[1], [2]

 

৩) মহাবিশ্বের চলকগুলো একটু হের ফের হলেই পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ঘটতো না – এই সজ্ঞাত ধারণাটি প্রাণের খুব সংকীর্ণ সংজ্ঞার উপর নির্ভরশীল। বহু বিজ্ঞানীই প্রাণের এই ধরনের ‘সঙ্কীর্ণ’ সংজ্ঞার সাথে একমত পোষণ করেন না। তারা বলেন, আমরা ওই ধরণের ‘সর্বোত্তম’ পরিবেশে বিকশিত হয়েছি বলে আমরা মনে করি প্রাণের উপত্তির জন্য ঠিক ও ধরণের পরিবেশই লাগবে। যেমন, বাতাসে সঠিক অনুপাতে অক্সিজেন, চাপ, তাপ ইত্যাদি। এগুলো ঠিক ঠিক অনুপাতে না থাকলে নাকি জীবনের বিকাশ ঘটবে না। এটি একটি সজ্ঞাত ধারণা, প্রমাণিত সত্য নয়। অক্সিজেনকে জীবন বিকাশের অন্যতম উপাদান বলে মনে করা হয়, কিন্তু মাটির নীচে এমন অনেক ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের জন্য অক্সিজেন শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, রীতিমত ক্ষতিকর। ষাটের দশকে আমেরিকান জীববিজ্ঞানী টমাস ব্রক এবং তার সহকর্মীরা ওয়াইওমিং এর ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের ১৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার উষ্ণ প্রস্রবণে এক ধরনের সরলাকৃতির অণুজীব আবিষ্কার করেন। কোন বহুকোষী জীবই সাধারণতঃ এই তাপমাত্রায় টিকে থাকতে পারে না। সমুদ্রের গভীর তলদেশে এমনকি কেরোসিন তেলের ভিতরের বৈরী পরিবেশেও প্রাণের বিকাশ ঘটেছে এমন প্রমাণ বিজ্ঞানীদের কাছে আছে - যে পরিবেশের সাথে আসলে আমাদের সংজ্ঞায়িত ‘সর্বোত্তম পরিবেশের’ কোনই মিল নেই। যে সমস্ত ‘প্রাণ’ এই ধরনের ভয়ংকর বৈরী পরিবেশে টিকে থাকতে পারে তাদেরকে বলা হয় চরমজীবী। পৃথিবীতে বেশ কয়েক ডজন চরমজীবীর অস্তিত্ব রয়েছে বলে মনে করা হয়[3] সম্প্রতি ন্যানো হ্রদে আর্সেনিক-ভিত্তিক প্রাণের অস্তিত্বের কথাও মিডিয়ায় উঠে এসেছে, যাদের ডিএনএ-এর গঠন প্রকৃতি আমাদের পরিচিত কার্বন-ভিত্তিক প্রাণের  থেকে ভিন্ন

 

৩) যে ছয়টি চলক মহাবিশ্বের গঠন তথা জীবনের উদ্ভবের জন্য সূক্ষ্ম-ভাবে সমন্বিত বলে দাবী করা হয়, সেগুলো অন্যান্য অনেক গবেষকদের গবেষণায় সমর্থনযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি। যেমন, জ্যোতির্পদার্থবিদ অধ্যাপক ভিক্টর স্টেংগর তার ‘The Unconscious Quantum: Metaphysics in Modern Physics and Cosmology’ বইয়ে দেখিয়েছেন চলক আর ধ্রুবকগুলোর মান পরিবর্তন করে আমাদের বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের মতই অসংখ্য বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড তৈরি করা যায়, যেখানে প্রাণের উদ্ভবের মত পরিবেশ উদ্ভব ঘটতে পারে[4]। এর জন্য কোন সূক্ষ্ম সমন্বয় বা ‘ফাইন টিউনিং’ এর কোন প্রয়োজন নেই। এছাড়াও ‘Physical Review’ জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে অ্যান্থনি অ্যাগুরি স্বতন্ত্রভাবে দেখিয়েছেন, মহাবিশ্বের ছয়টি প্যারামিটার বা পরিবর্ত্য রাশিগুলো বিভিন্নভাবে অদলবদল করে গ্রহ, তারা এবং পরিশেষে কোন একটি গ্রহে বুদ্ধিদীপ্ত জীবন গঠনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব - কোন ধরনের সূক্ষ্ম  সমন্বয় কিংবা এন্থ্রোপিক আর্গুমেন্টের  আমদানী ছাড়াই[5]পদার্থবিদ ক্রেগ হোগানও স্বতন্ত্রভাবে এ ব্যাপারটি নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং একই ধরণের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন[6]।  

 

৪) অধিকাংশ ফাইন-টিউনারদের বিশ্লেষণই ত্রুটিপূর্ণ[7], কখনো বা এটি গাণিতিক চালাকি বা মিস-ইণ্টারপ্রিটেশন হয়ে উঠেছে[8]। তাদের সবাই মহাবিশ্বের চলকগুলোকে স্থির ধরে কেবল একটিকে পরবর্তনশীল ধরে সিমুলেশন করতে চেয়েছেন।   কিন্তু একটি চলক বদল করলে অন্যগুলোর উপরেও প্রভাব পড়ে, এবং সেগুলোর পরিবর্তনও যে গোনায় ধরতে হবে সেটা তারা বেমালুম ভুলে গেছেন।  কার্বন অণু কিংবা অন্য জৈব অণুর সূক্ষ্ম-সমন্বয়ের ব্যাপারটাও যেটা ফলাও করে বলা হয়, সেটাও আসলে দীর্ঘ পরিসরে বিস্তৃত।   এ ধরণের দশটি বড় ধরণের ভুলের উল্লেখ করা হয়েছে পদার্থবিদ ভিক্টর স্টেঙ্গরের ‘দ্য ফ্যালাসি অব ফাইন টিউনিং’ বইয়ে[9]

 

৫) মহাবিশ্বের প্রকৃতি বস্তুনিষ্ঠ-ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে এটি কোন নিখুঁত ফাইন টিউন করে বানানো হয়নি। এতে রয়েছে বরং অপচয়-প্রবণতার ছাপ। যেমন, বিগ-ব্যাংয়ের পর নিখুঁত ডিজাইনার কেন নয় বিলিয়ন বছর লাগিয়েছিলেন এই পৃথিবী তৈরি করতে, আর তারপর আরও বিলিয়ন বছর লাগিয়েছিলেন প্রাণ তৈরি করতে, আর তারপরে আরো চার বিলিয়ন বছর লাগিয়েছিলেন পৃথিবীতে ‘মানুষের অভ্যুদয়’ ঘটাতে- এর কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা মেলে না, বরং পুরো প্রক্রিয়াটি অপচয় প্রবণতাকেই তুলে ধরে[10]।  কোটি কোটি বছর পর পৃথিবী নামক সাধারণ একটি গ্রহে প্রাণ সৃষ্টি করতে গিয়ে অযথাই সারা মহাবিশ্ব জুড়ে তৈরি করা হয়েছে হাজার হাজার, কোটি কোটি, ছোটবড় নানা গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণুপুঞ্জ- যারা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের সাহারা মরুভূমির চেয়েও বন্ধ্যা, উষর আর প্রাণহীন। শুধু কোটি কোটি প্রাণহীন আর নিস্তব্ধ গ্রহ, উপগ্রহ তৈরি করেই এই ‘নিখুঁত ডিজাইনার’ ক্ষান্ত হননি, তৈরি করেছেন অবারিত শূন্যতা, গুপ্ত পদার্থ এবং গুপ্ত শক্তি- যেগুলো নিষ্প্রাণ তো বটেই, তথাকথিত   ফাইন-টিউনিং এর উদ্দেশ্যের প্রেক্ষাপটে নিতান্তই বেমানান।  আর মহাবিশ্ব যদি এতো সূক্ষ্মভাবেই সমন্বিত করা হতো, তাহলে জীবনের উদ্ভব এতো বিরল ঘটনাই বা হবে কেন, আর এতো বিশাল মহাবিশ্বের এক ক্ষুদ্র কোনা-কাঞ্চিতেই বা সেটা হতে হবে কেন?

 

৬) মহাবিশ্ব মোটেও আমাদের জন্য ফাইন টিউনডনয়, বরং আমরাই এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডে টিকে থাকার সংগ্রামে ধীরে ধীরে নিজেদেরকে ফাইন টিউন্ড করে গড়ে নিয়েছি[11]

 

৭) যদি মহাবিশ্ব ফাইন-টিউন্ড হয় সেটা শক্তিমান ঈশ্বর থাকার পক্ষে নয়, বরং বিপরীতেই যাওয়ার কথা। কেন একজন শক্তিমান ঈশ্বর তার সৃষ্টিকে ঠিক ছুরির ফালিতে তৈরি করবেন, যে একটু এদিক ওদিক হলেই সেটা বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে?  আর তা ছাড়া,  ঈশ্বর তো যে কোন জায়গাতেই যে কোন  অবস্থাতেই, এবং যে কোন পরিস্থিতিতেই জীবনের উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটানোর ক্ষমতা রাখেন, মহাবিশ্ব ‘ফাইন-টিউন’ করা তার জন্য একেবারেই নিষ্প্রয়োজন।  

 

 

প্রাসঙ্গিক দাবী :

 

  • এই মহাবিশ্ব কিংবা আমদের জীবদেহ দেখলেই বোঝা যায় এগুলো নিখুঁতভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, এরা বিবর্তিত হয়নি’ – এই দাবীর উত্তর

 


 

[1] অভিজি রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, ২০০ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ২০০)

[2] বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর, ২০০৭ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ২০০৮)

[3] বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর, ২০০৭ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ২০০৮)

[4] Victor J. Stenger, The Unconscious Quantum: Metaphysics in Modern Physics and Cosmology, Prometheus Books, 1995

[5] Anthony Aguirre, , The Cold Big-Bang Cosmology as a Counter-example to Several Anthropic Arguments, Journal of Physical Rev, D64:083508, 2001

[6] Craig J. Hogan, Why the universe is just so, Reviews of Modern Physics, 72(2000) :169-71

[7] Victor J. Stenger, The Fallacy of Fine-Tuning: Why the Universe Is Not Designed for Us, Prometheus Books , 2011

[8] Robert Klee, The revenge of Pythagoras: How a mathematical sharp practice undermines the contemporary design argument in astrophysical cosmology. British Journal for the Philosophy of Science 53: 331-354, 2002

[9] Victor J. Stenger, The Fallacy of Fine-Tuning: Why the Universe Is Not Designed for Us, Prometheus Books , 2011

[10] Victor J. Stenger, God: The Failed Hypothesis. How Science Shows That God Does Not Exist, Prometheus Books , 2008

[11] অভিজি রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, ২০০ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ২০০); বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর, ২০০৭ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ২০০৮)

প্রশ্নোত্তরে বিবর্তন