বাংলা ব্লগ

বিবর্তনের আর্কাইভ

বিবর্তন ব্লগ

মুক্তমনা কি?

প্রজেক্ট

ইবই

সাহায্য


  ভ্রান্ত ধারণা

 

ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব

১) বুদ্ধিদীপ্ত অনুকল্প বা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন মূলতঃ কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণার অংশ নয়, কোন বৈজ্ঞানিক জার্নালেই তাদের কোন গবেষণার প্রতিফলন দেখা যায় না। রিচার্ড ডকিন্স এবং জেরী কোয়েন ২০০৫ সালে  সেপ্টেম্বর মাসে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত 'One Side can be wrong' প্রবন্ধে তাই লিখেছেন ১৪:

‘আইডি যদি একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হত, তবে বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলোতে এ নিয়ে গবেষণার প্রতিফলন আমরা দেখতে পেতাম। আমরা তেমন কোন কিছুই এখনো দেখিনি। এমন নয় যে বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলো আইডি সংক্রান্ত গবেষণা ছাপতে চায় না। আসলে আই ডি নিয়ে ছাপার মত কোন গবেষণারই অস্তিত্ব নেই। আইডির প্রবক্তারাও এটি বোঝেন। তাই তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ জনগণের কাছে আর সুচতুর সরকারী কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।’

 

২) ‘ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন’ বা বুদ্ধিদীপ্ত অনুকল্পের দুটি ভাষ্য পাওয়া যায়। একটি ভাষ্য পাওয়া যায় জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, যেটি বলে আমাদের এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড এমন কিছু চলক বা ভ্যারিয়েবলের সূক্ষ সমন্নয়ের (Fine Tuning) সাহায্যে তৈরী হয়েছে যে এর একচুল হের ফের হলে আর আমাদের এ পৃথিবীতে কখনই প্রাণ সৃষ্টি হত না। অর্থা, পরবর্তীতে প্রাণ সৃষ্টি করবেন এই ইচ্ছাটি মাথায় রেখে ঈশ্বর (কিংবা হয়ত অন্য কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বা) বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড তৈরী করেছিলেন, আর সে জন্যই আমাদের মহাবিশ্বঠিক এরকম; এত নিখুঁত, এত সুসংবদ্ধ।  

আর ওদিকে ‘ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন’এর জীববিজ্ঞানের ভাষ্যটি বলছে ঠিক তার উলটো কথা। জীববিজ্ঞানের আইডি প্রবক্তা ‘ফাইন টিউনার’রা যে ভাবে যুক্তি সাজিয়ে থাকেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের ‘ফাইন টিউনার’রা দেন ঠিক উলটো যুক্তি। জীববিজ্ঞানের আইডির প্রবক্তারা বলেন আমাদের বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড প্রাণ সৃষ্টির পক্ষে এতটাই অনুপযুক্ত যে প্রাকৃতিক নিয়মে এখানে এমনি এমনি প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে না। আবার জ্যোর্তিবিজ্ঞানের আইডি ওয়ালারা উলটো ভাবে বলেন, এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড প্রাণ সৃষ্টির পক্ষে এতটাই উপযুক্ত যে এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড প্রাকৃতিক নিয়মে কোনভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। একসাথে দুই বিপরীতধর্মী কথা তো সত্য হতে পারে না ১৫। 

 

৩) ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বে ব্যবহৃত শব্দগুলো পরিস্কার করে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি “ডিজাইন” সাধারণত যে অর্থে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, বুদ্ধিদীপ্ত অনুকল্প বা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বে সেই অর্থে ব্যবহার করা হয় না কোন এজেন্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোন কিছু সাজালে তাকে ডিজাইন বলেন ডেম্বস্কি ডিজাইনকে নিয়মানুবর্তিতা এবং চান্স বা আপতনের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন, যার কারণে তাঁর ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্ব “আরগুমেন্ট ফ্রম ইনক্রেড্যুলিটি” বা অবিশ্বাসপ্রসূত বিরোধীতায় রুপান্তরিত হয়েছে

কোন সমস্যার সমাধান করতে চাইলে অবশ্যই সেই সমস্যার ধ্রুবকবিশেষকে সম্বোধন করতে হবে, নইলে তা শুধু    অপ্রাসঙ্গিক প্রলাপ হয়ে ওঠে ডিজাইন সম্পর্কে যেকোন তত্ত্বকে অবশ্যই ডিজাইনের এজেন্ট এবং উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করতে হবে, নইলে সেই তত্ত্বকে ডিজাইনের তত্ত্ব বলা যাবে না কোন ডিজাইন তাত্ত্বিক আজ পর্যন্ত্য এরকম কোন প্রচেষ্টা নেননি, এমনকি কেউ কেউ আবার বলেছেন এ কাজ করা অসম্ভব  অপর্যবসিত জটিলতার যুক্তিটাও একারণে বিজ্ঞান নয়- এটিও  অবিশ্বাসপ্রসূত বিরোধীতা এবং ডিজাইন তত্ত্বের সম্পর্কে কিছু বলে না

 

৪) ডিজাইন তত্ত্ব বস্তুনিষ্ঠ নয়, ব্যক্তিনিষ্ঠ। এমনকি ডেম্বস্কিও ডিজাইন কিংবা জটিলতা থাকার পেছনে ডিজাইনার থাকার ব্যাপারটা কিভাবে পরীক্ষালব্ধভাবে প্রমাণ করা যাবে তা পরিস্কার করতে পারেনিনি। ব্যাপারটা ঘোলা করার জন্য তিনি বর্তমানে "apparent specified complexity" বনাম  "actual specified complexity,"  চয়ন করেছেন, যার মধ্যে শেষেরটাই ডিজাইন বা নকশাকে তুলে ধরে বলে তিনি মনে করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য করা একেবারেই সম্ভব নয়।

 

৫) ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন অর্থহীন ভবিষ্যদ্বানী করে  সাদা চোখে দেখলে মাকড়শার বোনা জাল বুদ্ধিদীপ্ত বলেই মনে হবে, ডিজাইন তত্ত্বমতে মাকড়শারও তাহলে বুদ্ধিদীপ্ত হওয়ার কথা  হয় মাকড়শারা বুদ্ধিমান নয়ত ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন একটি দুর্বল শ্রেণীর একাত্মবাদ(deism) ছাড়া কিছুই না, যেখানে মহাবিশ্বের শুরুতেই যত সব ডিজাইনের বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে

 

৬) ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন আন্দোলন কোন বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসেবে প্রস্তাবিত হয়নি এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ফিলিপ জনসন নিজেই বলেছেন এই আন্দোলন ধর্ম এবং দর্শনের সাথে সম্পর্কিত, বিজ্ঞানের সাথে না

 

৭) ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তাদের বিভিন্ন দাবীগুলো ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানীরা খন্ডন করেছেন ১৫ । যেমন, বিহের হ্রাস অযোগ্য জটিলতার” (Irreducible Complexity) যুক্তি কিংবা উইলিয়াম ডেম্বস্কির "তথ্য সংরক্ষণ সূত্র" সবই খন্ডন করেছেন বিজ্ঞানীরা ১৬

 

৮) আইডি আন্দোলনের অগ্রপথিকদের ভাষাতেই পরিস্কার দেখা যায় যে এই আন্দোলনটি স্রেফ একটি সংকীর্ণ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া কিছু না, যেমন, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন প্রবক্তাদের কিছু স্মরণীয় উক্তি -

ক) “এই আন্দোলনের গুরুত্ব নিয়ে মতভেদ আছে আমি সবসময়ই বলি যে এটি স্রেফ কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব না সঠিক প্রশ্নটা হবে: “ঈশ্বর কি বাস্তব নাকি কাল্পনিক?”

খ) “আমরা মানুষের একটি জনপ্রিয় অন্তর্জ্ঞানকে(ঈশ্বরে বিশ্বাস) বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষায়তনিক ভিত্তি প্রদান করতে চাচ্ছি আমরা স্রষ্টার গ্রহনযোগ্যতার সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতি বাধাটি দূর করতে চাচ্ছি”

গ) “আমরা বিজ্ঞানকে পরিবর্তন করে আইডির প্রতি সহানুভূতিশীল করতে চাই যাতে ঈশ্বর শিক্ষায়তনে এবং বিদ্যালয়ে আসন লাভ করেন”

ঘ) “ফাদারের বচন, আমার পড়াশোনা এবং প্রার্থনা আমাকে ডারউইনবাদকে ধ্বংস করতে উসাহিত করেছে, যেমন করে অন্য Unificationist রা মার্ক্সবাদকে ধ্বংস করার যুদ্ধে নেমেছে ১৯৭৮ সালের একটি পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য যখন ফাদার আমাকে নির্বাচন করলেন, তখনই আমি এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি শুরু করি”

ঙ) “বিজ্ঞানের যে সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গি যীশু খ্রীষ্টকে দৃশ্যপট থেকে বিতারিত করে দিয়েছে সেগুলোকে মৌলিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে দেখতে হবে। যীশুকে বাদ দিয়ে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উপর গভীর ধারণা লাভ করা যায় না।”

জনসন আরও বলেছেন  যে তিনি সহ আইডি আন্দোলনের অধিকাংশই বিশ্বাস করে এই কথিত ডিজাইন বাইবেলের ঈশ্বর

 

৯) আইডি এর উপর অনেক বই যে সমস্ত প্রেস থেকে  প্রকাশিত হয়েছে যারা নিজের সম্পর্কে দাবি করে,

“ আমরা কিরকম বই প্রকাশ করি? আমরা মূলত বাইবেলের উপর গবেষণামূলক এবং খ্রীষ্টান বই ছাপিয়ে থাকি InterVarsity Christian Fellowship/USA এর প্রকাশনা সংস্থান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়, গীর্জা এবং বিশ্বের বিভিন্ন লেখকের বই প্রকাশ করে মানুষকে যীশুর পথে আসতে প্রণোদিত করি”১০

 

Unlocking the Mystery of Life” নামক একটি চলচ্চিত্র আইডির প্রতি বিভিন্ন সমসাময়িক বিজ্ঞানীর সমর্থনের কথা তুলে ধরার দাবি করে এই চলচ্চিত্রটি মৌলবাদী খ্রীষ্টান সংগঠণগুলো দ্বারা প্রযোজিত হয়েছে এবং একমাত্র তারাই এটার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে১১

 

১০) আইডি আন্দোলন তার ধর্মীয় শিকড় লুকানোর জন্য সেকুলার মুখোশ পরিধান করে১২  একারণেই খ্রীষ্টান সংগঠণগুলো তাদের ধর্মীয় সৃষ্টিকল্পকে “ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন” অথবা “প্রগতিশীল সৃষ্টিবাদ” ব্যানারে উপস্থাপন করে১৩

 

১১)   আই.ডির বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় যুক্তি হল এটি সমস্যার সমাধান না করে একটি অনর্থক অসীম ধারার জন্ম দেয়, যা অক্কামের ক্ষুরের লংঘন। আমাদের এই ‘জটিল’ মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে ব্যখার জন্য যদি কোন বুদ্ধিদীপ্ত সত্ত্বার সত্যই প্রয়োজন হয়, তবে সেই বুদ্ধিদীপ্ত সত্ত্বাকে এই মহাবিশ্বের চেয়েও জটিল কিছু হতে হবে। তা হলে সেই জটিল বুদ্ধিদীপ্ত সত্ত্বার অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করবার জন্য ওই একি যুক্তিতে আবার ততোধিক জটিল কোন সত্ত্বার আমদানী করতে হবে, এমনি ভাবে জটিলতর সত্ত্বার আমদানীর খেলা হয়ত চলতেই থাকবে একের পর এক। এ ধরনের যুক্তি তাই আমাদেরকে অনর্থক অসীমত্বের দিকে ঠেলে দেয়, যা বার্ট্রান্ড রাসেল এবং ডেভিড হিউমের মত দার্শনিকেরা অনেক আগেই অগ্রহনযোগ্য বলে বাতিল করে দিয়েছেন ১৭

 

যতদিন পর্যন্ত না আই.ডি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যুক্তি আর সংশয়বাদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আই.ডি প্রবক্তাদের দাবীকে 'বৈজ্ঞানিক' ভাবার কোন কারণ নেই।  তারা মহাবিশ্ব এবং প্রাণীজগতের ডিজাইনারকে বিনা বাধায় বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষার উর্ধ্বে রেখে দিতে চায়। এই মতবাদের আরেকটি গুরুতর সমস্যা হল এটি বিবর্তন তত্ত্বের কাল্পনিক খুঁত এবং আধুনিক বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাগুলোকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলা করে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে গৃহীত হতে চাইলে এই মতবাদকে অবশ্যই এসব অযৌক্তিক এবং বিশ্বাসপ্রসূত প্রবৃত্তি ত্যাগ করতে হবে।

 

আরো পড়ুন :

সূত্রঃ

১) Dembski, William A., 2002. No Free Lunch. Lanham, MD: Rowman & Littlefield.

২) Elsberry, Wesley R., n.d. What does "intelligent agency by proxy" do for the design inference?

৩) Belz, Joel. 1996. Witnesses for the prosecution. World Magazine 11(28): 18.

৪) Phillip Johnson, "The Search for Intelligent Design in the Universe", Silicon Valley Magazine, 9 Jan. 2000

৫) Phillip Johnson, "Enlisting Science to Find the Fingerprints of a Creator", LA Times, 25 Mar. 2001

৬) Johnson, Phillip. 2003. American Family Radio, Jan. 10, 2003

৭) Wells, Jonathan. n.d. Darwinism: Why I went for a second Ph.D., Unification Church.

৮) William Dembski, Intelligent Design: The Bridge Between Science & Theology, Downers Grove, InterVarsity Press, 1999

৯) Maynard, Steve. 2001. Life's intelligent design. Tacoma News Tribune, May 7, 2001.

১০) IVP Online. n.d. About us. http://www.gospelcom.net/ivpress/info/aboutus/

১১) Evans, Skip. 2003. Who promotes Unlocking the Mystery of Life?

১২) Branch, G. 2002. Evolving banners at the Discovery Institute. Reports of the National Center for Science Education 22(5): 12.

১৩) Morris, John D., 1999. Open letter included with mailing of April 1999 Acts and Facts.

১৪) Dawkins R and Coyne J, 2005, One Side Can be Wrong, Guardian

১৫) অভিজি রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অঙ্কুর, ২০০৫ (পরিবর্ধিত সংস্করণ ২০০৬); বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর, ২০০৭ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ২০০৮)

১৬) A. Stenger, Victor J., 2000 (Dec.). The emperor's new designer clothes. Skeptical Briefs; B. Elsberry, Wesley, and Jeffrey Shallit, 2003. Information theory, evolutionary computation, and Dembski's "complex specified information", Talk Reason.  C. Erik, On Dembski’s Law Of Conservation Of Information, Talk Reason. D. Mark Perakh, Unintelligent Design, Prometheus Books, 2003.

১৭)  ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে কূট কচাল, অভিজি রায়, স্বতন্ত্র ভাবনা (সম্পাদনা: অভিজিৎ রায় ও সাদ কামালী, সভাপতি: অজয় রায়), চারদিক, ২০০৮

 

প্রশ্নোত্তরে বিবর্তন