বাংলা ব্লগ

বিবর্তনের আর্কাইভ

বিবর্তন ব্লগ

মুক্তমনা কি?

প্রজেক্ট

ইবই

সাহায্য


  বিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন

 

নূহের মহাপ্লাবনের পর কেমন করে জীব-বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হলো?

 

নূহের মহাপ্লাবন একটি পৌরাণিক কাহিনি, বাস্তবতা নয়।  বাইবেল অনুযায়ী -

 

মানব সভ্যতার এক পর্যায়ে নুহ নবীর সময়ে পৃথিবীর সকল মানুষ পাপে নিমজ্জিত হয়, ভুলে যায় ঈশ্বরকে ঈশ্বর ক্রোধান্বিত হয়ে নুহকে একটি নৌকা বানানোর হুকুম দেন সেই নৌকায় নির্বাচিত কয়েকজন মানুষ এবং পৃথিবীর সকল ধরনের প্রজাতির এক জোড়া তুলে নেওয়া হয় বাকিদের মহাপ্লাবনের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয় পাপের দায়ে ধ্বংস করা হয় মহাপ্লাবনের আগের রাতে জন্মগ্রহণ করা শিশুকেও (জেনেসিস ৭-)

 

এই ধরণের গল্প কোরানও সমর্থন করে (কোরান, ২৩:২৭, ১১:৩৭- ১১:৪০ ইত্যাদি) । মজার ব্যাপার হলো, মহাপ্লাবন সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনি উপরে উল্লেখিত ধর্মগ্রন্থগুলোতে প্রথমবারের মতো বর্ণিত হয়নি এই গল্পের শেকড় খুঁজতে গিয়ে আমরা সবচেয়ে পুরাতন যে ভাষ্য বা বর্ণনা পাই সেটা ২৮০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়কার ঘটনা সুমেরিয়ান পুরাণে এমন এক বন্যার বর্ণনা পাওয়া যায় যার নায়ক ছিল রাজা জিউশুদ্র, যিনি একটি নৌকা তৈরির মাধ্যমে একটি ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে অনেককে রক্ষা করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৮০০-এর মধ্যে বিখ্যাত ব্যাবেলনিয়ান পৌরাণিক চরিত্র গিলগামেশ তার এক পুরুষের য়ুতনাপিসটিমের কাছ থেকে একই রকম এক বন্যার কথা শুনতে পান সেই গল্পানুসারে পৃথিবীর দেবতা আ (Ea) রাগান্বিত হয়ে পৃথিবীর সকল জীবন ধ্বংস করে ফেলার অভিপ্রায়ের কথা য়ুতনাপিসটিমকে জানান তিনি য়ুতনাপিসটিমকে ১৮০ ফুট লম্বা, সাততলা বিশিষ্ট এবং প্রতিটি তলায় নয়টি কক্ষ থাকবে এমন একটি নৌকা তৈরি করে তাতে পৃথিবীর সকল প্রজাতির এক জোড়া করে তুলে নেওয়ার আদেশ দেন[1]

 

গিলগামেশের এই মহাপ্লাবন মিথটিই লোকে মুখে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে আব্রাহামিক গডের আবিষ্কারক এবং পূজারী হিব্রুরা প্যালেস্টাইনে আসার অনেক আগে থেকেই সেখানকার মানুষদের কাছে এই গল্প প্রচলিত ছিল আর সেই গল্পের প্রভাবই আমরা দেখতে পাই, পরবর্তীকালে হিব্রুদের গড অব আব্রাহামের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ তৌরাত, বাইবেলে আর এই তৌরাত, বাইবেলের গল্প থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছে আরবের ইসলাম ধর্মের কোরানের নুহের মহাপ্লাবন কাহিনি

 

একটা সংস্কৃতিকে এর ভৌগোলিক অবস্থান বেশ প্রভাবিত করে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি সংস্কৃতি যাদের ভৌগোলিক অবস্থান নদ-নদী বিধৌত, যেগুলো প্রায়শই বন্যা ঘটিয়ে জনপদ গিলে ফেলে, সেসব সংস্কৃতিতে নদ-নদী সম্পর্কিত কিংবা বন্যা সম্পর্কিত বিভিন্ন গল্প চালু থাকে সুমেরিয়া এবং ব্যাবেলনিয়া জনপদ টাইগ্রিস এবং ইউফ্রাটিস নদী দিয়ে আবৃত ছিল এসব অঞ্চলে প্রায়শই বন্যা হতো এখন এর মানে কি এই তৌরাত, বাইবেল, কোরানের সকল গল্প মিথ্যা? অবশ্য এই প্রশ্ন করা মানেই পৌরাণিক কাহিনির সত্যিকারের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করা জোসেফ ক্যাম্পবেল (১৮৮৮, ১৯৪৯) তাঁর সারাজীবন অতিবাহিত করেছেন এই বৈশিষ্ট্য সঠিকভাবে মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করতে[2] তাঁর মতে, মহাপ্লাবন সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনিগুলোকে আমরা যেভাবে দেখি তার থেকে এর অনেক গভীর মর্মার্থ রয়েছে পৌরাণিক কাহিনি কোনো ঐতিহাসিক সত্য কাহিনি নয়, এটি হলো মানব সভ্যতার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সংগ্রাম প্রতিটা মানুষের মনেই তার জন্মের উদ্দেশ্য, সে কীভাবে এলো, কেমন করে এলো এমন প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আর এই প্রশ্ন থেকে মুক্তি পেতে সে বিভিন্ন উত্তর দাঁড় করায় আর তা থেকেই জন্ম নেয় পৌরাণিক কাহিনির পৌরাণিক কাহিনির সাথে বিজ্ঞানের বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু ধর্ম এসে এই শাশ্বত কাহিনিগুলোকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে একে বিজ্ঞান বলে প্রচার করেছে এটা বিজ্ঞান এবং পৌরাণিক কাহিনি দুটির জন্যই অপমানজনক সৃষ্টিবাদীরা পৌরাণিক কাহিনির চমকার সব গল্পকে গ্রহণ করেছে, তারপর সেটাকে ধ্বংস করেছে

 

নূহের মহাপ্লাবন থেকে কেমন করে জীব বৈচিত্র্যের উদ্ভব হলো সেই প্রশ্ন করার আগে মহাপ্লাবনের বাস্তবতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা উচিত। সত্যিকার অর্থে, পৌরাণিক কাহিনিকে বিজ্ঞানে রূপান্তর করার আহাম্মকির উদাহরণ দিতে গেলে নুহের মহাপ্লাবনই যথেষ্ট ৪৫০ (৭৫×৪৫) বর্গফুটের একটি নৌকায় কয়েক কোটি প্রজাতিকে জায়গা দিতে হবে তাদের খাবারের ব্যবস্থা কী হবে? পয়ঃনিষ্কাশন, পানি? ডায়নোসররা কোথায় থাকবে, কিংবা সামুদ্রিক প্রাণীরা এক প্রাণীর হাত থেকে অন্য প্রাণীকে রক্ষার উপায় কী? আর সমুদ্রে থাকা প্রাণীরা বন্যায় মারা যাবে কীভাবে? এই সকল প্রশ্নের উত্তর বিশ্বাসীদের কাছে একটাই ঈশ্বর চাইলে সব হবে তবে সেক্ষেত্রে ঈশ্বরের নুহকে দিয়ে নৌকা বানিয়ে হাত ঘুরিয়ে ভাত খাওয়ার দরকার কী ছিল? তিনি চাইলে তো এক হুকুমেই পৃথিবীর তাব পাপীকে মেরে ফেলতে পারতেন তাতে করে অন্তত আগের দিন জন্ম নেওয়া নিষ্পাপ শিশুগুলো বেঁচে যেতো

 

চিত্র : ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত ইন্সটিটিউট অফ ক্রিয়েশন রিসার্চ মিউজিয়ামে নুহের নৌকার ছবি মানুষকে জোর করে গালগল্প বিশ্বাস করানোর জন্য আলাদা আলাদা কম্পার্টমেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক উত্তরদানের চেষ্টা (!!) করা হয়েছে ছবি সূত্র: বার্নাড লে কাইন্ড জে

 

নৌকার কথা বাদ দিলেও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে পৃথিবীতে এমন কোনো মহাপ্লাবন হয় নি, যাতে করে বাড়িঘর থেকে শুরু করে সকল উঁচু পর্বত ডুবে গিয়েছিল মহাপ্লাবনে সবচেয়ে বেশি জল জমা হলে, তা হতে পারে ২.৫ সেন্টিমিটার গভীর। অর্থা মহাপ্লাবনে পৃথিবীর সব জায়গায় গড়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হলে ২.৫ সেন্টিমিটার জল জমতে পারে। আবার এইটুকু উচ্চতায় জল জমা সম্ভব হতে পারে একমাত্র যদি মাটি এই বৃষ্টির জল শুষে না নেয়। এছাড়াও যদি সত্যি সত্যি মহাপ্লাবনের ফলে পৃথিবীর সকল জীব ধ্বংস হয়ে থাকতো তাহলে মৃত প্রাণীদের জীবাশ্মগুলো সব মাটির একই স্তরে থাকার কথা ছিল (যেহেতু তারা সবাই একই সময়ে মৃত্যুবরণ করেছে)। এমন ধরণের কোনো প্রমাণও খুঁজে পান নি ভূতত্ত্ববিদরা। দেখা যাচ্ছে সৃষ্টিবাদীরা শুধু বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানকে অস্বীকার করছেন না, তারা অস্বীকার করছেন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ইতিহাস, ভূতত্ত্ব, ফসিল বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যাসহ সকল বিষয়কে[3]

 

প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি বছরের বিবর্তনেই জীব বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছে, নূহের মহাপ্লাবনের মতো ঘটনা পৃথিবীর সকল জীবকে একত্রে ধ্বংস করেছে-এটা অলীক কল্পনা, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।


 

[1]     Michael Shermer,Why People Believe Weird Things : Pseudoscience, Superstition, and Other Confusions of Our Time, W.H. Freeman & Company, 1998, পৃষ্ঠা নং ১৩০

[2]     একই বই, একই পৃষ্ঠা

[3] অভিজি রায় এবং রায়হান আবীর, অবিশ্বাসের দর্শন, শুদ্ধস্বর, ২০১১ (দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১২)