না

আদনান লেরমন্তভ  

        ‘না‘ - একটি খুবই ছোট, অথচ অত্যান্ত কঠিন ও শক্তিশালী শব্দ।  এই একটি শব্দের দৃ উচ্চারণ ও সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে, একজন বিদ্রোহী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে জন্ম দিতে পারেন প্রবল বিদ্রোহের।   সবকিছু চুপচাপ মেনে নিতে নিতে, একদিন একজন হঠা করেই না বলে ফেলেন; এবং এই শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথেই এত দিনকার হয়তো অত্যান্ত তুচ্ছ একজন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারি হয়ে ওঠেন।  কিন্তু সব কালে সবার পক্ষে এই না বলার ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব নয়।  খুব বেশি নয়, শুধূ কখনো কখনো, গড়ে দুই এক শতক পর পর এই না বলার ক্ষমতা সম্পন্ন দুই একজন মানুষ জন্মগ্রহন করেন।  বাংলাদেশে আধুনিক চিন্তাপ্রেমি ও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ সৃষ্টির জন্য, এই না বলার ক্ষমতা সম্পন্ন একজন মানুষের এখন বড়ই প্রয়োজন।   

          বিংশ শতাব্দীর আগের সকল শতাব্দীতে যতজন বিজ্ঞানী জন্মিয়েছেন, তার থেকে বহুগুন বেশি বিজ্ঞানী জন্ম নিয়েছেন এই শতকটির এক একটি দশকেই।  কিন্তু বিজ্ঞানীর সংখ্যা বাড়লেও, আধুনিক চিন্তাপ্রেমি ও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুব একটা বাড়েনি, যার ফলে এই বিষ্ময়কর শতকটিও ব্যর্থ হয়েছে বহু আকাংক্ষিত সুখ ও শান্িতর সন্ধান দিতে।  একবিংশ শতাব্দীও যে এর থেকে ভীন্ন কিছু আমাদেরকে দেবে, প্রথম দশকটিতে আমরা এখনও পর্যন্ত তার কোন প্রমান দেখছি না।  কিছু মানুষ আছেন যারা বিজ্ঞানের ব্যাপারগুলো ঠিকমতো বা একদমই বোঝেন না।  আমি এদেরকে ক্ষতিকর মনে করিনা, কেননা এদের রয়েছে সুযোগের অভাব অথবা এরা হয়তো ব্যর্থ শিক্ষা ব্যবস্থার শিকার।  কিন্তু এক শ্রেনীর মানুষ আছেন যারা বিজ্ঞানের ব্যাপারগুলো একেবারে না বুঝেও বোঝার ভান ধরেণ।  আমি বিজ্ঞান বুঝি, এটা বলে অনেক কিছু অর্জন সম্ভব; আবার আত্মগর্বে অন্ধ হওয়ার একটা সুখও পাওয়া যায়, আর অসুখের এই পৃথিবীতে সুখ কে হাতছাড়া করতে চায়।  এরা খুবই ক্ষতিকর, কারণ এদের অধিকাংশের হাতেই রয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিকাংশ ক্ষমতা।  তবে যে শ্রেনীটি সবচেয়ে ক্ষতিকর সেটি হলো বিজ্ঞানমনষ্কতাহীন বিজ্ঞানীর দল।  এরা আধুনিক চিন্তার প্রেমে পড়ে জ্ঞান সাধনা করেন না, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে এদের ধর্মের দিকেই খেয়াল বেশি।  আমি নিশ্চিত যে তারা ধর্মের ব্যাপারগুলোও ঠিক মতো বোঝেন না।  কতজন মানুষ তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুলো তাদের নিজের ভাষায় পড়েছেন ও সঠিকভাবে বুঝেছেন এই প্রশ্নটির উপর ভিত্তি করে একটি স ও সঠিক জরিপ চালালে (প্রথাগতের মতে) অনাকাংখিত ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।  সত্যের সন্ধানে আছেন এমন কেউ হয়তো সাহস করে এমন একটা উদ্যোগ নিয়ে আমাদেরকে ধন্য করবেন 

          অতীতের শতাব্দী গুলোতে এক অঞ্চলে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার সাথে, অন্য অঞ্চলে ঘটা অন্য একটি ঘটনার সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা ছিলো খুবই কম।  কিন্তু এখন আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যে বা অষ্ট্রেলিয়ায় ঘটা একটি ঘটনার সাথে যশোরের একটি কুকুরের সুখ/শান্িতর সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।  মার্কিন-ইরাক যুদ্ধের সময় আমি শীতের সকালে অনেক কুকুরের বাচ্চার গলায় বুশের ছবি ঝুলতে দেখেছি।  এই অমানবিক কাজটি কি একটি যুদ্ধের থেকে কম অমানবিক আমরা বিশ্বাস করি আর নাই করি, অথবা বিশ্বাস করতে চায় আর নাই চায়, পৃথিবী এখন খুবই ছোট।  আমাদের ব্যত্তিগত বিশ্বাস/অবিশ্বাসের সাথে সমগ্র বিশ্ব, সমগ্র মানবজাতি ও মানবধর্মের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে; কেননা মানুষ শুধু বিশ্বাস বা আবিশ্বাস করেই বসে থাকে না, সে যা কিছু করে, তার সাথে তার বিশ্বাস/অবিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।  তাই অতীতের শতাব্দী গুলোতে অনেক হেলাফেলার মধ্য দিয়েও জীবন চলেছে; কিন্তু সে সময়ের শেষ হয়েছে, এখন গোটা পৃথিবীটা একটি হূপিন্ডের মতো, আর হূপিন্ডের কোন রোগই সামান্য বা তুচ্ছ নয় 

          ধর্মিয় বিশেষজ্ঞরা, পৃথিবীর বিভিন্ন কোন থেকে, ধর্মের বিভিন্ন বিভ্রান্িতমুলক ব্যাখ্যার (কোন কোন ক্ষেত্রে হয়তো তা ইচ্ছাকৃত নয়) মাধ্যমে মানুষকে একটা ধাঁধাঁর মধ্যে ফেলে দেন।  আপাতদৃষ্টিতে এই বিভিন্ন বিভ্রান্িতমুলক ব্যাখ্যাকে ধর্মের একটি ত্রুটি বলে মনে হলেও, আসলে এই বৈশিষ্ট্যই ধর্মের এক বিশাল শক্তি।  এই বিভ্রান্িতকরণ ধর্মের পক্ষেই (পক্ষ বলতে এখানে ধর্মের প্রসার, প্রচার, বিধি/বিধানের প্রয়োগ ক্ষমতা ইত্যাদিকে বুঝান হয়েছে) কাজ করে; বিভিন্ন ব্যাখ্যা মানুষকে বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত করে, এবং মানুষের একতা ও বোধের বিলুপ্তি ঘটায়।  আর ধর্মিয় বিষেষজ্ঞদের বিভ্রান্িতমুলক ব্যাখ্যা নয়, প্রতিটি মানুষকে তার নিজ নিজ ধর্মকে বুঝতে হবে।  শুধু আদেশ পালন জন্ম দিতে পারে কৃতদাশের।  আর যারা শুধুই মেনে নিতে শেখে, তাদের পক্ষে শুধু ধ্বংসই সম্ভব, সৃষ্টি নয়।  প্রতিটি মানুষকেই তার পবিত্র ধর্মগ্রন্থটি খুব ভালো করে পড়ে দেখতে হবে; পড়ায় কোন ক্ষতি নেয়, পড়ে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন সম্ভব, ক্ষতি অন্ধবিশ্বাসে।  ধর্মগ্রন্থগুলো পড়া থাকলে অস ও নষ্ট ধর্মগুরুরা আর আমাদেরকে ধোকা দিতে পারবেন না।  মানুষকে এতটা নির্বোধ ভাবার কোনো কারণ নেই; তার জীবনের দায়িত্ব নিতে প্রয়োজনে তাকে সাহায্য করতে হবে।  মানুষকে সন্দেহ, প্রশ্ন ও সীমালঙ্ঘনের অধিকার দিতে এতো ভয় কেনো সন্দেহ, প্রশ্ন ও সীমালঙ্ঘনের সাহায্য নিয়ে বিজ্ঞান নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে যদি ধর্মের ভিত্তি আরো শক্ত করতে পারে, তবে তাতে এত বাধা দেওয়া কেনো সামান্য জ্ঞানেও এটা বোঝা যায় যে ধর্ম যদি সত্য হয়, তবে বিজ্ঞানের পক্ষে ধর্মের কোনরকম ক্ষতি করা সম্ভব নয়, বরং শুধু উপকারই সম্ভব।  ধর্ম চিরকাল শান্িত প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছে, এবং শান্িত প্রতিষ্ঠার কাজে তাকে ব্যর্থ হলে চলবেনা।  কাজেই সন্দেহ, প্রশ্ন ও সীমালঙ্ঘনের মাধ্যমে মানুষ যদি শান্িত পায়, তাতে ধর্মের অশান্ত হয়ে ওঠার কোন কারণ দেখিনা 

          আমাদের অনেকেই বিজ্ঞানের প্রগতী দেখতে চান; কিন্তু এই প্রগতীর জন্য আমরা কে কি ও কতটুকু করেছি।  পথের একজন ভিক্ষুককে ২/১ টাকা আমরা সবাই দিয়েছি; উপাসনালয়ে প্রার্থনায় গিয়েও আমরা আমাদের সাধ্যমতো দিয়েছি, কিন্তু বিজ্ঞানের পথে আমরা শেষ কবে কত টাকা ব্যায় বা দান করেছি।  সবকিছুর মতো বিজ্ঞানের প্রগতীর জন্যও প্রয়োজন সমাজ ও রাষ্ট্রের সচেতন দৃষ্টি ও সহায়তা।  অনেকে ধর্ম ও বিজ্ঞান এর মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পান না।  কপটরা অস উদ্যেশ্যে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে চান ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যের পার্থক্য নিঃশেষ করে দিয়ে।  কিন্তু একটু ধ্যানেই ধরা পড়ে এ সত্যটুকু - ধর্ম সন্দেহ, প্রশ্ন ও সীমালঙ্ঘন পছন্দ করেনা; কিন্তু সন্দেহ, প্রশ্ন ও সীমালঙ্ঘন ব্যতিত বিজ্ঞানের প্রগতী অসম্ভব।  ধর্ম ও বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য মানুষের উপকার করা।  ধর্মিয় গোড়ামি ও ধর্মিয় সন্ত্রাস মানুষের কোন উপকার করতে পারে না, কাজেই আধুনিক মানবিক সভ্যতাকে অবশ্যই এ ধরণের ধ্বংসাত্বক শক্তিকে ঘৃনা করতে হবে।  অন্যদিকে মানুষের উপর পারমানবিক বোমার ব্যবহারও মানুষের কোন উপকার করতে পারে না, কাজেই আধুনিক মানবিক সভ্যতা থেকে তাকেও বিদায় নিতে হবে; বিজ্ঞানীদের শুধু গবেষনা করলেই চলবেনা, তাদের মানবতা ও বিজ্ঞানমনষ্কতার পরিচয়ও দিতে হবে।  ধর্ম প্রায়ই ভুলে যায় যে এখন চলছে ব্যক্তিস্বাধিনতার যুগ; ধর্মকে মনে রাখতে হবে তার আধিপত্বের দিন অনেক আগেই শেষ হয়েছে।  সন্দেহ, প্রশ্ন ও সীমালঙ্ঘন এখন আর কারো মৃত্যুদন্ডের কারণ হতে পারেনা, এসব প্রসংসাযোগ্য গুন 

          সন্তানেরা তাদের মা বাবাকে উপহার হিসাবে দিতে পারে তাদের জীবনের একটি সুন্দর অর্জন, এর বেশিকিছু মা বাবাকে দেওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করিনা; ধর্মেও আমার দাবির পক্ষে যুক্তি পাওয়া যাবে।  মা বাবার ঋণ শোধ সম্ভব নয়, কাজেই তার চেষ্টা করাটাই একটা নষ্টামি।  প্রতিটি মানুষই মনে করে তার জীবনের এই অর্জন বন্দি হয়ে আছে ভবিষ্যতের কোন এক কালে; কিন্তু অর্জনের জন্য কোন নির্দিষ্ট বয়স নেই।  যেকোন বয়সে এই অর্জন সম্ভব; কিন্তু কোন কাজের শুরু না করে শেষ কিভাবে সম্ভব অতীতের ব্যর্থতা আর বর্তমানের হতাশা আমাদের সুন্দর স্বপ্ন গুলোর ভবিষ্যত ধ্বংস করতে পারেনা।  মানুষ চিরকাল বাঁচেনা।  বড়জোর মাত্র একশো বছরের জীবনে মানুষ এত নষ্ট হয় কিভাবে এখনই অর্জনের সময়।  আমাদের মা বাবাকে গর্বিত করার জন্য এত অপেক্ষা করা কেনো আমি আমার মা বাবাকে গর্বিত করতে চাই, আর সে কারনেই ২০০৫ সালে ঝসেসরৈে যলিলা শচডৈৈল অসতরনৈমৈয় ছলুব প্রতিষ্ঠা করা।  জুলফিকার স্যারের নিষ্ঠা, সততা, ত্যাগ, ইচ্ছা, দূরদৃষ্টি এবং নিঃস্বার্থ সহযোগিতা ব্যতিত এই অসতরনৈমৈয় ছলুব এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে আরো অনেক সময় লেগে যেতো।  আমি প্রায়ই ভাবি, আমার মতো একজন উন্মাদের কথায় তিনি কিভাবে রাজী হলেন; কিন্তু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষেরা ভুল করেন না, যেখানে অন্যরা কিছুই দেখতে পান না, তারা দেখতে পান অনেক কিছু।  আমি তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।  আমি অনেক চেষ্টা করেও তাকে আজ পর্যন্ত ঠিক মতো একটা সালাম দিতে পারলাম না, তিনিই আমাকে আগে সালাম দেন।  খোলা মনের অসাধারণ এক মানুষ তিনি 

          নিজ দেশ, জাতি ও ধর্মের জন্য সংগ্রামের দিন, মানুষ স্বীকার করতে অস্বস্তি বোধ করলেও, বহুকাল আগেই শেষ হয়েছে।  এখন সময়, সমগ্র বিশ্ব, সমগ্র মানবজাতি ও মানবধর্মের জন্য সংগ্রামের।  যারা এই সত্যটুকু গ্রহন করতে ব্যর্থ হবে, দুঃখজনক হলেও তারা যে ধ্বংস হয়ে যাবে তা বাজী ধরে বলা যায়।  কিন্তু প্রশ্ন হলো তারা নিজেদের ধ্বংসের সাথে সাথে সমগ্র বিশ্ব, সমগ্র মানবজাতি ও মানবধর্মকেও ধ্বংস করে যাবে কি না অন্যদিকে আমরা যারা এই সত্যটুকু গ্রহন করতে ব্যর্থ নই, তাদের উচি হবে এই ধ্বংসবাদীদের কব্জা থেকে সমগ্র বিশ্ব, সমগ্র মানবজাতি ও মানবধর্মকে মুক্ত ও রক্ষা করা।  আর, অন্য অনেক কারণের সাথে সাথে, এই কারণটির জন্যও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার প্রয়োজন; প্রগতী অলৌকিকভাবে ঘটেনা।  যে হুজুর আমাকে কোরআন পড়িয়েছিলেন, তিনি প্রায়-ই বলতেন, ‘সাহসের সাথে নিজের ভুল প্রকাশ করার মানসিকতার সাথে মানুষের সুখ ও শান্িতর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।  মানুষ ইচ্ছে করে ভুল করেনা, কাজেই ভুল স্বীকার করতে ক্ষতি কি আমরা যারা বিজ্ঞানের প্রগতী চায়, তাদের উচি হবে সব রকম অপবিজ্ঞান, নষ্টামি, ধর্মিয় গোড়ামি ও ধর্মিয় সন্ত্রাসের বিরুন্ধে শান্িতপুর্ন ও মানবিক সংগ্রামে নামা।  চিন্তা করতে ভালো লাগে যে এই সংগ্রামের ভিতর থেকেই হয়তো অসাধারণ একজন, ‘না বলার ক্ষমতা অর্জন করবেন         

          আমার এই আলচনার অধিকাংশ বিষয়ই মৌলিক কোন ধারণা নয়; কিন্তু হয়ত অনেকেরই অজানা।  আর ভন্ড, নষ্ট আর কপটদের কথা না হয় নাই বললাম; কেননা এসব জানার পরও তারা চুপচাপ থাকেন, এবং তথ্য ও সত্য গোপন করেন