এলোমেলো করে দে মা লুটেপুটে খাই
গীতা দাস
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা পাঠ্য পুস্তকে প্রথম গল্পটিই পড়েছিলাম --- ‘অনেক অনেক দিন আগের কথা। আরবের লোকেরা তখন মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দিত............... ইত্যাদি ইত্যাদি’। গল্পটির নাম সম্ভবত ছিল মহানবীর কথা। আর গল্পটির সারমর্ম ছিল মহানবীর চলার পথে এক বুড়ি কাঁটা দিয়ে রাখত। একদিন পথে কাঁটা না দেখে তিনি বুড়ির বাড়ি গিয়ে দেখেন সে অসুস্থ। মহানবী তার সেবা করেছিলেন। পরে সেই বুড়ি সুস্থ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
এখন একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মত একট স্বাধীন দেশের মাটিতে ‘অনেক অনেক দিন আগের কথা। আরবের লোকেরা তখন মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দিত’ এর বদলে লিখতে হবে “ আজকালকার দিনের তৎনগদ কথা। বাংলাদেশের কিছু আলেম ওলামা বেশধারী, মুসল্লী নামধারী ইসলামের নামে নারীদের সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য জিহাদ ঘোষণা করেছে। আর তাদের ভয়ে সরকার ৮ মার্চ, ২০০৮ ঘোষিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি পর্যালোচনা করতে রাজি হয়েছে । এ সব কীর্তিকলাপ তত্কালীন আরবদেশীয় বর্বরতাকেও হার মানায়’। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিকে জীবন্ত কবর দিতে চাওয়ার মধ্যে রয়েছে অনেক অনেক দিন আগের আরবদের মনোবৈকল্যের আবাস।
ন্যায্যতা একটি আপেক্ষিক শব্দ। ন্যায্যতা শব্দটির অধিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন। ন্যায্যতা সম্পর্কে আলেম ওলামাদের ধারণা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। ন্যায্যতার সীমিত সংজ্ঞায় আলেম ওলামারা নারী অধিকারকে আটকে রাখতে চায়। ন্যায্যতার প্রয়োজন সমতার জন্য। নারীবাদীরাও সমতার আগে ন্যায্যতা চায়। সমতার পূর্বশর্ত হল ন্যায্যতা। অর্থাৎ বেশি চায় --- ন্যায্যতা চায় সমান না হওয়া পর্যন্ত। আর কাজেই এখন আমরা --- নারীরা সব কিছুতে বেশি চাই। পিছিয়ে আছি বলে ন্যায্যতা চাই। কোটা প্রথা চাই --- অগ্রাধিকার চাই জীবিকার সর্বত্র। যখন সমান হয়ে যাব তখন সমান চাইব। পুরুষের সমান হবার পর সমান সমান ভাগ। এখন নয়। আলেম ওলামারা সমতার আগের সিঁড়িতেই নারীদের আটকে রাখতে চায়। ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাকে ঠকাবে আর আমরা তা মেনে নেব এমন ধর্মীয় ব্যবস্থা একবিংশ শতাব্দীতে তো কল্পনা করাও আহাম্মকি। আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে যারা জিহাদ ঘোষণা করেছে তাদের ঘরের খবর কী! ঘরের নারীদের কী করে বুঝায় যে তারা দু’জন সমান নয়? তার পরিবারে ছেলে ও মেয়েটি সমান নয়। এটি কি অনেক অনেক দিন আগের আরবের লোকদেরকে বর্বরতাকেও হার মানায় না? অবশ্য আমার ধারণা যারা রাস্তায় নেমেছিল তাদের দশভাগও জাতীয় নারী নীতি পড়েইনি।
‘এলোমেলো করে দে মা লুটেপুটে খাই’ প্রবাদের মতই আকাংঙ্ক্ষা। বাংলাদেশের অরাজকতার মূলেও রয়েছে এ দর্শন। ঘোলা জলে মাছ শিকার করার প্রবণতা। নিজেরাই বিশৃংখলা সৃষ্টি করে সুবিধা লুটে নেয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে যেমন সামরিকবাহিনীর সুবিধা, তেমনি অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অসাধু ব্যবসাসায়ীদের লাভ। সামাজিক পরিস্থিতির অবনতিতে খুনী বদমাশরা সুযোগ পায়। কাজেই একশ্রেণীর লোক --- সুযোগ সন্ধানীরা চায় অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হোক সমাজ জীবনের সর্বত্র। পরিবারে --- কর্মক্ষেত্রে --- রাস্তাঘাটে --- রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় --- সবখানে বিরাজ করুক এলোমেলো অবস্থা লুটেপুটে খাওয়ার জন্য।
এ লুটেপুটে খাওয়ার মানসিকতা থেকেই জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে বিরোধিতা। সবচেয়ে বড় ফন্দি যুদ্ধপরাধীদের বিচার থেকে জনসাধারনের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া। যখন তাদের বিচারের ইস্যুটিতে সারাদেশ সোচ্চার ঠিক তখনই একটা অজুহাত পেল। সবচেয়ে অবাক দুটো কান্ড ঘটেছে। প্রথমত, কেবিনেটে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি অনুমোদন দেয়ার পর চার উপদেষ্টার এ বিষয়ে প্রকারান্তরে আলেম ওলামারাদের সাথে একমত হওয়া। দ্বিতীয়ত, বায়তুল মোকারমের খতিব একজন সরকারী চাকরিজীবী হয়েও কীভাবে সরকারিভাবে ঘোষিত জাতীয় নারী নীতির বিরোধিতা করে!
আমাদের গ্রামে একজন সরকারী কর্মচারী ছিলেন--- মহকুমা প্রশাসকের দপ্তরের পিওন। তিনি নিজের চাকরি সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন। ইউনিয়ন পরষদের নির্বাচনেও কারো পক্ষে কোন রকম প্রচারে অংশ নিতেন না। উনাকে গ্রাম সম্পর্কে কাকা ডাকতাম। গৌড়া কাকা। তার মতামত ছিল তিনি সরকারি লোক। দেশের চাকরি করেন। দেশের চাকরি করে, রাষ্ট্রের বা সরকারি চাকরি করে সরকারের নীতির বাইরে কিছু করা উচিত নয়। আদর্শবোধে উজ্জ্বলতর পিওনের সংলাপ।
মহকুমা প্রশাসকের দপ্তরের পিওনের চেয়েও বায়তুল মোকারমের খতিবের ঔচিত্যবোধ কম। আদর্শবোধের উজ্জ্বলতা তো কোন ছাড় টিমটিমে সলতের আলোও নেই তার কার্যকলাপে।
আর চার উপদেষ্টা!( ৩০ মার্চ, ২০০৮ ডেইলি ষ্টার) মোল্লাদের সাথে সভা করেছে। এ বিষয়ে ছোটবেলার খেলার কথা মনে পড়ছে।
ছোটবেলা আমাদের গোল্লাছুট বা অন্যান্য খেলায় খেলোয়ার ভাগ করার একটি বিশেষ পদ্ধতি ছিল। প্রথমে দুইজন দলনেতা ঠিক করে দুইদিকে থাকত। অন্যদেরকে জোড়ায় জোড়ায় বেঁধে দেয়া হত। জোড়ার দুইজনে গোপনে প্রত্যেকের একটি করে ছদ্মনাম নিয়ে বলতে বলতে আসত---
ডাক ডাক বেলী
আস না ভাই খেলি
টগর না বকুল ?
একজন দলনেতা যে কোন একটা বলত। যদি বলত বকুল তবে যার ছদ্মনাম বকুল সে ঐ দলনেতার পক্ষে খেলত। তেমনি অন্য আরেক জোড়া বলতে বলতে আসত ---
ডাক ডাক বেলী
আস না ভাই খেলি
আম না কাঁঠাল ?
আগে যে নেতা নেয়নি সে এবার একজনকে নেবে ছদ্মনাম পরিচয়ে। উল্লেখ্য যে আগেই ঠিক করে দেয়া হত এ জোড়া ফুলের নাম, ঐ জোড়া ফলের নাম ইত্যাদি হিসেবে ছদ্ম নাম ঠিক করে আসবে।
আবার আমাদের যে যাকে পছন্দ তার সাথে জোড়া বাঁধতাম না। তাহলে যে নির্ঘাত অন্য দল। আবার কোন একফাঁকে দলনেতাকে গোপনে বলেও যেতাম আমার ছদ্মনাম অমুকটা রাখব। এতে পছন্দের দলের পক্ষে খেলতে পারতাম। এসব লুকোচুরিও চলত। জুচ্চুরিও কি?
এখন উপদেষ্টারাও কি ছদ্মনামে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে খেলতে এসেছেন?এখন আসল নাম প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে।
তা না হলে কি গাঁজা খেয়ে কেবিনেটের সভায় বসে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি অনুমোদন করেছিলেন? এখন কি গাঁজার নেশা ছুটে গেছে? না কি এখন গাঁজার নেশায় বুঁদ? আবার এটি পর্যালোচনা জন্য কমিটির কথা মাথায় আসে কেন?
এসব গাঁজা খাওয়া উপদেষ্টারা অবিলম্বে পদত্যাগ না করলে যে গাঁজার ধোঁয়ায় দেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে। এলোমেলো অবস্থায় লুটেপুটে খাবে ছদ্মবেশী ভন্ডের দল।
সংবিধানে নারী উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিক ফসলইতো জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি।
Millennium Development Goal (MDG) অর্জনে বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ বিষয়ে কেন আলেম ওলামারা নীরব? PRSP নিয়েও তাদের কোন মাথা ব্যথা নাই। PRSP ও MDG দুটোতেইতো নারীর জন্য অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপের কথা বলা আছে। সব কি ইসলামের সাথে খাপ খায়? খায় না।
১৯৬১ সালে আয়ুব খান যখন পারিবারিক আইনে শরিয়া নিয়ম ভেঙ্গে সংশোধন করেছিল তখন যদি মানতে পেরেছিল এখন জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি কেন মানবে না? আসলে সবই রাজনীতি। বৈষয়িক স্বার্থে ধর্মকে নিয়ে টানাটানি।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ এর অনুচ্ছেদের ১-৪ ধারা নিয়ে তখন কেন সোনার চাঁদ পিতলের ঘুঘুরা মাথা তুলেনি? তখন বুঝি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের মাথা এমনিতেই অধোমুখী ছিল পরাজয়ের গ্লানিতে। এখন কি অপরাধ স্খলন হয়ে গেছে? হয়নি। স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে জীবিত অবস্থায় তাদের অপরাধের ক্ষমা নেই। মৃত্যুর পর যদি তাদের আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন সে কথা আলাদা।
আলেম ওলামারা বিভিন্ন সময়ে বলেন যে, একমাত্র ইসলামই নারীকে মর্যাদা দিয়েছে। একি তারই নমুনা! জাতীয় নারী নীতির বিরোধিতাই প্রমাণ করে অন্যান্য ধর্মের মত ইসলামও নারী পুরুষ সমতায় বিশ্বাস করে না।
মণিপুরীপাড়া
ঢাকা- ১২১৫১২ বৈশাখ/১৪১৫/২৫ এপ্রিল ২০০৮