তখন ও এখন 

গীতা দাস

(১)


আমার ছোটবেলা আর বড়বেলা। আমার তখন আর এখন। আমার তখনকার ছোটবেলা আর এখনকার ছোটদের ছোটবেলা। আমার এখনকার বড়বেলা আর তখনকার বড়দের বড়বেলা। এ নিয়ে আমার অনুভূতি ---- উপলব্ধি ---- হতাশা --- সুখ --- ক্ষোভ --- বেদনা --- আনন্দের প্রকাশ আমার তখন আর এখনে। তখন আর এখনে পার্থক্য ও ভিন্নতা রয়েছে ---- রয়েছে তথাকথিত আধুনিক জীবন যাপনের সাথে দ্বব্দ্ব --- অত্যাধুনিক জীবনাচারের সাথে আপোষ করার চেষ্টা। স্মৃতি জাগানিয়া আমেজে বিভোর থাকার সুখানুভূতি আমার তখন ও এখনে।
ছোট বেলায় আমার মা কাকিমাদের নিজেদের দৈনন্দিন পড়ার শাড়ি বা পূজাপার্বণের শাড়ি নিজেদের পছন্দ মতই কিনে দেওয়া হত, তবে পছন্দর পরিসর ছিল সীমিত । আমার বাবা ও কাকারা চার পাঁচটি শাড়ি নিয়ে আসতেন। এর থেকে মা কাকিমাদের নিজেদের শাড়ি পছন্দ করে নিতে হত। বাবা কাকারা একবারই একসাথে চার পাঁচটি শাড়ি আনতেন পরে আর বদলা-বদলির প্রচলন ছিল না অথবা মা কাকিমারাও বদলাতেন না বা বলতে সাহস পেতেন না। তবে কেউ বাজারে যেতেন না। তখন কোন মহিলাই বাজারে গিয়ে কাপড় চোপড় পছন্দ করত না। (বাজার বলতে দোকান। আজকালের মত শপিং মল নয়। তখন দোকান সব বাজারে থাকত, জুতার দোকান, কাপড়ের দোকান, মুদির দোকান, সূতার দোকান, রঙের দোকান,সব কাছাকাছি, যা পুরুষদের আনাগোনায় মুখর থাকত।) তবে আমরা- ছোটরা মেয়ে হলেও দোকানে গিয়েই বাবার সাধ্যের মধ্যে নিজের পছন্দ মত ফ্রক জুতা কিনে আনতাম। লিঙ্গ বৈষম্যের প্রকট স্তর তো বয়সের সাথেও সম্পৃক্ত।


আমাদের প্রজন্ম বড় বেলায়ও দোকানে গিয়ে শুধু কাপড় চোপড় নয় ---- মাছ তরকারিও নিজের পছন্দ মত কিনি। কোন মাছে কোন তরকারি খাটবে, কোন মাছে মূলা, কোনটার সাথে ফুলকপি অথবা বেশি দাম হলেও একটু ধনেপাতা কিনেই ফেলি। তবে আমার সময় লেখাপড়া নিজের ইচ্ছা মত বিষয়ে পড়তে পারতো না। যদিও আমি পাশ কোর্স থেকে অনার্সে আসি নিজের ইচ্ছায়---- মাকে পটিয়ে, বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, তবে তা ছিলো নেহায়েতই ব্যতিক্রম ----- নিয়মিত ঘটনা নয়।
কিন্তু আজ কালকের প্রজন্ম নিজের ইচ্ছে মত বিষয় নেয়। আমার মেয়ের নিজের পছন্দের বিষয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেখে চমকিত হলেও আশান্বিতও হয়েছিলাম।


ছোটবেলা আমাদের বাড়িতে পিঁড়ি পেতে বসে খাবারের ব্যবস্থা ছিল। বাবা কাকারা বড় পিঁড়িতে আসন পেতে বসে খেতেন। মা কাকিমারা, ঠাকুমারা ছোট পিঁড়িতে হাঁটু গেড়ে বসতেন। খাওয়া আর রান্নার সময় বসার এক ভঙ্গি আর মাছ তরকারি কাটাকুটির সময় অন্য ভঙ্গিতে বসতেন ---- সামনে বটি নিয়ে। মহিলাদের আসন পেতে বসা ঊচিত নয় বলে ধারণা ছিল। এতে পেটে চাপ পড়ে না। পেট বড় হয়ে যায়। আমরা --- ছোটরা সব ভাবেই বসতাম। তবে ঠাকুমারা বুঝাতে চাইতেন যে মেয়েদের ছোট পিঁড়িতে বসেই খাওয়া ঊচিত। সংগ্রামের সময় বড় বড় সব পিঁড়ি আমাদের বাড়ি ঘরের সাথে লুটপাট হয়ে যাওয়ায় বাবা কাকারা ছোট ছোট পাটি পেতে খেতেন। পরে আবার কয়েকটি বড় পিঁড়ি অবশ্য বানিয়েছিল। তবে মা কাকিমাদের কখনোই পাটি পেতেও খেতে বসতে দেখিনি ছোট পিঁড়িঁতে ছাড়া।


এ বসাবসিতেও লিঙ্গ বৈষম্য যে প্রকট তা ছোটবেলায়ই মাথায় খটকা লেগেছিল। আসন পেতে বসলে আরামদায়ক------ তবে হূট হাট করে উঠা যায় না। কিন্তূ হাঁটু মোড়ে বসলে হুট হাট করে ঊঠা যায় । বাইরে মহিলাদের গতি – চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত হলেও ঘরে পুরুষের চেয়ে দ্রুত গতি সম্পন্ন যে হতেই হবে। পুরুষ তো বাইরে সারাক্ষণ খাটেই, কাজেই ঘরে আরাম পুরুষের জন্য। আর নারীর বাইরে যাওয়া নেই বলে ঘরে পুরুষের আরামের জন্য সে থাকে সদা তৎপর।
এখন? ডাইনিং টেবিলে সবাই একসাথে খাই।


এখন কারও বাসায় (বাড়িতে নয়) নিমন্ত্রণ খেতে গেলে প্রীতি ভোজের পর সে মধ্যাহ্নেই হোক আর রাতেই হোক ডেসার্ট হিসেবে পুডিং, আইসক্রীম, কাস্টার্ড, ফল ইত্যাদি ইত্যাদি থাকে।
ছোটবেলায় আমাদের দৈনন্দিন খাবারের সাথে দুধ থাকত। শুকত,ভাজি, মাছের ঝোল, মুড়িঘন্ট, ডাল এসব খাবারের পর দুধভাত খাওয়া হত। আত্মীয় স্বজন আসলে পায়েস/ মিষ্টান্ন, দুধের সাথে কলা, গ্রীষ্মকালে আম কাঠাঁল ইত্যাদি। গোয়াল ভরা গরু আর বাগান ভরা ফলের প্রভাবই হয়ত বা ছিল খাবারের অভ্যাসের বিশেষত্ব ।


নিজেদের গাভী দুধ ছাড়ান দিলে বাজার থেকে কাইড়া দিয়ে দুধ আনত আমার কাকারা। আমাদের যৌথ পরিবারের কাকারাই দৈনন্দিন বাজার হাট করতেন। আমার ছোটবোন দুধের কড়াইয়ে চাঁছি খেতে খুব পছন্দ করত। সন্ধ্যায় দুধ শেষ হলে ও নিজে বা কাকিমারা কড়াই চেঁছে চুঁছে ওকে খাওয়াতো। ঝিনুক দিয়ে কড়াই চাঁছতো। নিজেদের গরুর দুধ হলে আবার রাতের বেলা আস্তে আস্তে চাঁছতো যাতে গরু এ শব্দ শুনতে না পায়। গরু শুনলে নাকি দুধ কম দিবে। নিজেদের গরুর দুধ হলে মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছে করে ঝিনুক দিয়ে শব্দ করে কড়াই চেঁছে পরদিন দুধের পরিমাব কমে যায় কি না দেখেছি। কমে অবশ্য যেত না। রাতের বেলায় শব্দ দূষণকে প্রতিরোধের অভিনব ঊপায় হয়তো বা। কারণ বেশির ভাগ বাড়িতে নিজেদের গরুর দুধই থাকত। প্রতিদিনি দুধ থেকে সর তোলে জমানো হত। পনের বিশ দিন পর পর দুধের সর থেকে ঠাকুমা খুব ভোরে উঠে ঘি তুলতেন। ঘি বোতলে ঢালার পর যে খাঁঝ জমতো তা দিয়ে মুড়ি মাখা খাওয়া হত।
এখন মিল্কভিটা বা আড়ং দিয়ে অথবা কোন কৌটার দুধ ঘুলে খাওয়া ছাড়া ঊপায় কী!


গীতা দাস
মণিপুরীপাড়া, ঢাকা- ১২১৫

[email protected]