তখন ও এখন
গীতা দাস
(১০)
খাবার কখনোই কোন ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে জড়িত নয় বলে আমি মনে করি। গরু খেলেই আমার হিন্দুত্ব চলে যাবে বলে আমি মানি না। আবার ছোটবেলা থেকে গরু খাইনি বলে মাংসটি দেখলেই এক ধরনের এলার্জি অনুভূত হয়। বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিক হলেও আমি এ জালে আবদ্ধ।
কিন্তু আমার অন্যান্য মুসলিম সহকর্মীরা শুকরের মাংসের প্রতি এক ধরণের ঘৃণা অনুভব করেন। যদিও আমি শুকরের মাংস খাই না। তবে আমি কোন মাংসের প্রতিই ঘৃণা অনুভব করি না। সবই খাওয়ার জিনিস। আমার ছেলেমেয়ে কোন বিশেষ মাংসের প্রতিই ঘৃণা বা এলার্জি কোনটাই অনুভব করে না।
আমার কর্মক্ষেত্রে অনেক সময় একসাথে লাঞ্চ করার ব্যবস্থা করা হয়। কারও জন্মদিনে বা কোন সুখবর থাকলে। গরুর মাংস ছাড়া মেন্যু হয় না। সে ভুনা খিচুরি হোক বা পিজাই হোক। আমার জন্য যদিও মুরগি আনা হয় কিন্তু আমি স্বস্থি অনুভব করি না। খাবারের প্রতি এলার্জিজনিত কারনে নয় – আমাকে আলাদা করে রাখার জন্য। নিজেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করি। মাসে দু’একদিন অফিসে ধর্মনিরপেক্ষ খাবার ব্যবস্থা করার মত মানসিকতা তাদের নেই, যদিও বৈচিত্র্য (diversity) নিয়ে তাদের ধারণা খুব স্পষ্ট বলে তারা দাবি করে।
বেলা দশটা এগারটায় মাঝে মাঝে সিঙ্গারা খাওয়া হয়। সিঙ্গারার ভিতরেও গরুর মাংসের খেতে হয়। অনেক সময় আমার জন্য আলাদা কিছু আনতে ভুলেও যায়। খাবারের প্রতি লোভে নয় – আমার অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয় ভেবে আরামবোধ করি না। আমিই বা কবে এ সব সংস্কারমুক্ত হব! আর আমার সহকর্মীরাই বা কবে নিজেদের পরিমণ্ডলে অন্যের অস্তিত্বকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে!
রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও সমাজের সবক্ষেত্রে মূলস্রোতে নারীর শক্তিশালী অবস্থানের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে নারী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে। সংখ্যালঘু হিসেবেও মূলস্রোতের বাইরে রাখতে চায় একটি আন্তর্জাতিক কর্ম পরিমন্ডলের ভেতরেও। এ মনোকষ্ট কোথায় রাখি!
ছোটবেলায় ঈদেও বন্ধুদের বাসায় খেতে গেলে গরুর আবাস পাইনি। ঈদুল ফিতরে সাধারণত গরু কোরবানী হত না আর ঈদুল আযহায় কোরবালীর মাংস ঘরে তোলার আগেই আমাদের নিমন্ত্রণ খাওয়া শেষ হয়ে যেত।
আমার বিদ্যালয় ও কলেজ জীবনে ধর্মীয় অনুষ্ঠান সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল। স্বরসতী পুজার কমিটি গঠিত হতো হিন্দু-মুসলিম মেয়েদের সমন্বয়ে। এক সাথে চাঁদা উঠানো, প্রতিমা স্থাপন, প্রসাদ বিতরণ ও খাওয়া চলত। মুসলিম মেয়েরা শুধু মাত্র অঞ্জলি নিত না।
তেমনি মিলাদেও একই চিত্র। মাহফিলের এক কোণায় হাত জোড় করে চুপ করে বসে থাকতাম। মিলাদ শেষ হলে মিষ্টি বিতরণ করতাম ও খেয়ে-দেয়ে বাড়ি ফেরা।
দুর্গাপুজা ও ঈদ দুটো অনুষ্ঠানেই ছিল সবার আনন্দ। উল্লাস। তাইতো এর নাম ছিল সর্বজনীন দুর্গাপুজা ও সর্বজনীন ঈদ। এখন দুটো উৎসব থেকেই সর্বজনীন শব্দটি কেটে দিয়ে ঠোটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখা উচিত।
এখন জনে জনে ভিন্নতা খুব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। আমি কিন্তু ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের কথা বলছি না। এ ভিন্নতার সৃষ্টি জাগতিক হিংসা, দ্বেষ, স্বাথর্পরতা থেকে। কেঊ কেঊ ধর্মকে এর উপলক্ষ্য বানায় মাত্র।
বৈচিত্র্যের মাঝে একতার বোধ সৃষ্টি করতে গেলে উদারতার প্রয়োজন, মনের প্রসারতার প্রয়োজন। নিজের অস্তিত্বের সাথে অন্যের উপস্থিতিকে মিলিয়ে নেয়ার জন্য, মানিয়ে নেয়ার জন্য মনের গভীরতম প্রদেশকে খনন করতে হয়। এ খননে রক্তক্ষরণ নেই, আছে ব্যাপকতার আস্বাদন। আমার দেশের বেশির ভাগ মানুষই সে আস্বাদন থেকে বঞ্চিত । বুঝেও না কী অমৃত থেকে বঞ্চিত তারা!
স্কুল জীবনে আমার বড্ড খটকা লাগতো মেয়েদের নামের বেশভূষা- সাজসজ্জা দেখে। হিন্দু নামের মেয়েদের সাথে সব রাণী। গীতা রাণী দাস, শিপ্রা রাণী সাহা, নিরাশা রাণী মন্ডল, রেখা রাণী মোদক, আর মুসলিম মেয়েদের নামের শেষে বেগম, নেছা। কদাচিৎ সুলতানা। রেবেকা সুলতানা, হালিমা বেগম, সুরাইয়া বেগম, কামরুন্নেছা। এরা সবাই আমার ক্লাসমেট। পুরো বালিকা বিদ্যালয় ও মহিলা মহাবিদ্যালয় জুড়েই--- এলাকা জুড়েই ছিল এমন নাম। ওদিকে পাশের বালক বিদ্যালয়ের নাম বেলায়েত হোসেন, বিদ্যুৎ কুমার দাস, অমুক খান, তমুক ভুঁইয়া।
স্বনামে উজ্জ্বল নক্ষত্র সব। মেয়েরা কারো বেগম-নেছা, কারো রাণী, কারো সুলতানা। পরবর্তী পর্যায় তাই আমি আমার নাম থেকে রাণীটি ছেঁটে ফেলি চুলকাঁটার মত। অধঃস্তন লৈঙ্গিক পরিচয় থেকে নিজেকে মুক্ত করার মানসে। ইদানিংকালে অবশ্য আধুনিকায়ন ঘটেছে। হিন্দু মেয়েদের রাণী তো কানেই শুনি না, চন্দ্র, কুমারও ভেগে গেছে। যেমন ভজন সরকার, অভিজিৎ রায়। প্রদীপ দেব। জাতিগত পদবীও অনেক ক্ষেত্রে উধাও। মুসলিম নামের ক্ষেত্রেও কমে গেছে বেগমের আধিক্য। যেমনঃ নাসরীন জাহান, সেলিনা হোসেন, তসলিমা নাসরিন।
দেব-দেবীর নামে নাম রাখার প্রচলন ছিল খুবই। আমার নামও সে ঐতিহ্য বহন করে। হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থের নামে নাম। মা বাবার প্রথম সন্তান বলেই এ বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার বাকি পাঁচ ভাইবোনের নামে ধর্মীয় কোন বোঝা নেই, তবে পদবীর লেজ দেখে ধর্মীয় পরিচয় পাওয়া যায়।
সাতরং এর নন্দিনী হোসেন এর মত।
অন্যদিকে অনেক নাম শুনে তো কোন ধর্মের তাও বুঝার উপায় নেই এবং আমি মনে করি বুঝা উচিতও নয়। নামের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয় বয়ে বেড়াতে হবে কেন? সাদ্দামের তথ্য মন্ত্রীর নাম ছিল তারিক আজিজ। অমুসলিম । তবে নামে রয়েছে ইরাকী পরিচয়।
আমাদেরও আগে বাঙালী, পরে ধর্মীয় পরিচয়। আমার ছেলেমেয়ের নামই আমি স্ব-ইচ্ছায়---সজ্ঞানে --- স্বজ্ঞানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রকাশ করার মানসে রেখেছি। স্কুলে তাদেরকে কোন ধর্মের ক্লাসে বসাবে তা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে সংশয় ছিল। ভর্তির ফরম দেখে জেনেছে তাদের ধর্ম। কারণ আমার ছেলের নাম স্বাক্ষর শতাব্দ আর মেয়ের নাম প্রত্যাশা প্রাচুর্য (ডাক নাম চর্যামণি)।
মুক্তমনাগোষ্ঠীকে কি নিজেদের প্রজন্মের নামের বেলায় নিদেনপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ নাম রাখার অনুরোধ করতে পারি?
গীতা দাস
ঢাকা
২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪১৫/ ৩ জুন, ২০০৮