তখন ও এখন
(১৩)
ছোটবেলায় দেখতাম গৃহিণীদের মধ্যে ঝগড়ার আড়ম্বর। চোপা করা। পাল্টাপাল্টি। প্রতিযোগিতা চলত কে কাকে কত বেশি এবং কত উচ্চস্বরে বকাবকি, গালিগালাজ করতে পারে এবং খোটা দিতে পারে। পাড়ার সবাই জানত অমুকের বউ তমুকের মায়ের সাথে কাইজ্যা লেগেছে। এ সব কাইজ্যায় প্রচুর প্রবাদ ও প্রবচন ব্যবহৃত হত এবং তা বাংলার লোক সাহিত্যকে কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করেছে। কারণ এ পাল্টাপাল্টিতে সৃজনশীলতারও স্বাক্ষর ছিল। কাইজ্যায় নোংরা ও অশ্লীল শব্দ ও বাক্য চয়নও চলত অবলীলায় --- অনায়াসে।
অন্যদিকে এখন যার সাথে ঝগড়া সেই বুঝে না। ইগো, স্টেটাস, মর্যাদা, ভদ্রতাবোধ আমাদের কণ্ঠকে আড়ষ্ঠ করে রাখে। এ আড়ষ্ঠতার কি খুব প্রয়োজন রয়েছে? হয়তো রয়েছে। তবে আশংকা জাগে যখন তা ছাই চাপা আগুনের মত থাকে। সুযোগ পেলে কিন্তু পুড়িয়ে উজার করে দেয়। বোমা ফাটিয়ে দেয়, পাহাড় ধ্বসিয়ে দেয় সম্পর্কের মাঝে।
যাহোক, তখনকার নারীর অবস্থা ও অবস্থান ও প্রতিফলিত হত এ সব কাইজ্যায়। যেমনঃ
‘রাঢ়ী মাগী পাইলে কে না বলে
ছাড়া বাড়ি পাইলে কে না হাগে’।
ছাড়া অর্থাৎ পরিত্যক্ত বাড়ির মতই রাঢ়ী মানে বিধবার অবস্থা। পরিত্যক্ত বাড়িতে যেমন যে কেঊ পায়খানা করতে তোয়াক্কা করে না, তেমনি বিধবাকে যে কেঊ যে কোন কটু কথা বলতে পারে, কারণ পরিত্যক্ত বাড়ির মতই বিধবার কোন মালিকানা বা তত্ত্বাবধায়ক নাই। অভিভাবকবিহীন নারী। অসহায় নারী। অন্যদিকে নারী মানেই তার অভিভাবক থাকতেই হবে।
এখানে বলা প্রয়োজন যে আমার তখনকার যুগে গ্রামের সব বাড়িতে সেনিটারী ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা ছিল না। কোন লোকালয়ে পরিত্যক্ত বাড়ি থাকলে যে কেঊ সুযোগ পেলেই পায়খানা হিসেবে ব্যবহার করত। তেমনি বিধবা যে একজন মানূষ। সে যে স্বচালিত হতে পারে এ ধারণা সৃষ্টি হয়নি। বিধবা মানেই সে যে পুরুষের অধীনে ছিল সে মারা গেছে। কাজেই পুরুষবিহীন নারীকে যাচ্ছেতাই বলার অধিকার সামাজিকভাবে স্বীকৃতই।
এখনও কি আমাদের খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে? হয়নি।
নারী শিক্ষার হার বাড়ছে। নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। নারীর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। নারীর অবস্থানের উন্নতি হচ্ছে কী?। জাতীয় সরকারে ও স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণ আনুপাতিক হারে কী বাড়ছে?
তখন ও এখনকার নারীর অবস্থা ও অবস্থানের কতটুকু ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে? আমার ছোটবেলায় ও বড়বেলায় নারীর প্রতি ধারণাগত পাথর্ক্য কি কিছু হয়েছে? প্রাত্যহিক জীবন থেকে দু’একটি উদাহরণ দিলেই বুঝা যাবে যে পুনমুষিকভবঃ।
আমি চাকরি উপলক্ষ্যে অফিসের গাড়িতে ফরিদপুর যাচ্ছি। ফেরিতে নদী পাড়ি দিচ্ছি। একজন ভিক্ষূক এসে ভিক্ষা চাচ্ছে --- ‘আম্মাজান। আল্লার ওয়াস্তে সাহায্য করেন। আল্লায় আপনের সাহেবরে বড় বানাইছে, এর লাইগ্যা এত বড় গাড়ি চড়েন। আল্লায় আপনের সাহেবরে আরও বড় করব’।
ভিক্ষূকের আন্দাজে কুলায়নি যে অফিসের গাড়ি চড়ার মত কোন চাকরি কোন নারী করতে পারে। ভিক্ষুকের হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম---- শুধু সাহেবদের জন্য নয়, আমাদের জন্যও দোয়া টোয়া করবেন।
অন্য আরেক দিন---গাড়ির কাঁচ খুলে ফেরিতে বসে আছি নদীর ঝুরঝুরে সতেজ বাতাস পাওয়ার জন্য। একটি দূর পাল্লার কোচ থেকে কোলে একটি তুলতুলে বাচ্চা নিয়ে এক ভদ্রলোক নামলেন। বাচ্চাটিকে আমি আদরের ইঙ্গিত দিতেই ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। আলাপ হল। উনি পেশায় একজন চিকিৎসক। মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট। কুষ্টিয়ায় বাড়ি। ঢাকায় থাকেন। আমায় প্রশ্ন করলেন --- দাদা কি ইউনিসেফ এ চাকরি করেন? অর্থাৎ উনি ধরেই নিয়েছেন যে, আমি যে গাড়িটিতে বসে আছি তা আমার স্বামীর বদৌলতে। হেসে ভুল ভাঙ্গিয়ে দিলাম। না, আমি নিজেই ইউনিসেফ এ চাকরি করি এবং দাপ্তরিক কাজে ফরিদপুর যাচ্ছি।
হায়রে আমার প্রথাগত ধারণা !একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীর অবস্থান সর্ম্পকে একজন ভিক্ষুক আর একজন চিকিৎসকের ধারণার পার্থক্য ঘটানো যায়নি।
আমার এক নারী সহকর্মী প্রায় দিনই সকালে অফিসে এসে সকালের নাস্তা খায়। বাসা থেকে বক্সে করে নিয়ে আসে বা অফিসে আসার সময় কিনে নিয়ে আসে। এতে আমার আরেক পুরুষ সহকর্মী যিনি একটু উদ্ধর্তন তিনি মোটেই তা সহ্য করতে পারেন না। একদিন পুরুষ সহকর্মীটি বলছেন --- আচ্ছা, সকালে অফিসে এসেই কিসের খাওয়া দাওয়া! বাসা থেকে নাস্তা করে আসা যায় না? আমরা করে আসি না!
নারী সহকর্মীর ঝটপট উত্তর --- আমার তো বৌ নেই, বৌ থাকলে আমিও নাস্তা করেই আসতে পারতাম।
যদিও অফিসে বসে নাস্তা খাওয়া উচিত নয় তবুও কথাটা বহুলাংশে সত্যি। বৌ থাকলে সেও নাস্তা খেয়ে অফিসে আসতে পারত।
একজন নারীর সকালে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি আর আর একজন পুরুষের সকালে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি কোনভাবেই এক নয়। যে দম্পতির দু’জনেই চাকরি করে বাংলাদেশের এমন সাতানব্বই ভাগ সংসারেরই চিত্র প্রায় একই। নারীটি ব্যস্ত সারাদিনের সংসার গুছানোতে আর পুরুষটি ব্যস্ত শুধুই অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতিতে। আর সাথে যদি থাকে বিদ্যালয়ে পড়ুয়া কোন শিশু তবে তো হয়েছেই।
তখনকার সময়ে আমার মা কাকিমারা সকালে ব্যস্ত থাকতেন বাবা কাকাদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার প্রস্তুতিকে আরামদায়ক করতে। পারিবারিক পরিসরের প্রেক্ষাপটে রাজাদের রাজদরবারে যাবার মতই বাবা কাকাদের সকালে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া। বাবা কাকারা চলে গেলে মা কাকিমারা নিজেদের খাওয়া দাওয়া, দুপুরের রান্না ও অন্যান্য কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন । আমাদের খাওয়া নাওয়া গতানুগতিক নিয়মের ভিতরেই চলত। আমাদের দিকটা সাধারণত ঠাকুমারাই দেখতেন। ঠাকুমা ও তার বোন ছিলেন আমাদের তদারকিতে --- তত্ত্বাবধানে সদা ব্যস্ত। এখন শহুরে একক পরিবারের গৃহিণীর চাকরিজীবী পুরুষটির কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার প্রস্তুতিকে আরামদায়ক করতে তো হয়ই, সাথে বাচ্চাদের স্কুলে যাবার প্রস্তুতি, বাচ্চাদের খাওয়া নাওয়ার দায়িত্ব এবং এখন বাচ্চাদের সাথে স্কুলে যেতে হয়। রান্নাবাড়ার দায়িত্ব থেকেও রেহাই নেই।
আধুনিকায়ন, বিশ্বায়ন নারীকে কি দিয়েছে, কতটুকু দিয়েছে এবং কীভাবে এ সবের ফসল ও সুফল নারী পাবে তা ভাববার প্রয়োজন রয়েছে। আর এ ব্যাপারে শুধু নারীকে ভাবলেই চলবে না। তা পরিবারের সদস্য, কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থাপক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারকদেরও ভাবতে হবে।
গীতা দাস
ঢাকা
১৪ আষাঢ়, ১৪১৫/ ২৮ জুন, ২০০৮