তখন ও এখন
(১৪)
নারীর পেশা নিয়ে রয়েছে অসম চিন্তার পরিচয়। যে কোন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে, অফিসে, বাসে, ট্রেনে যে কোন জায়গায় আলাপচারিতায় নারীমাত্রই তাকে একটি সাধারণ প্রশ্ন শুনতে হয় ----- আপনার সাহেব বা স্বামী কি করেন? প্রশ্নকারী নারী পুরুষ নির্বিশেষেই হয়।
আপনি কী করেন ? --- এ প্রশ্নটি একজন নারীকে সচরাচর করা হয় না।
আমি কারো সাথে প্রথম পরিচয়ে ‘আপনার সাহেব বা স্বামী কি করেন?’ এ প্রশ্নটি শুনা ছাড়া আলাপ সম্পন্ন করেছি বলে স্মৃতি নেই।
আমি আমার স্বামী ও পুরুষ সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করে দেখেছি কেউ কদাচিত্ও এ ধরণের প্রশ্নের সমুঙ্খীন হয় না যে তার স্ত্রী কি করেন? ধরেই নেয়া হয় যে স্ত্রী বা মহিলা মাত্রই গৃহিণী।
আমার বাবা কাকাদের আমলে না হয় এ ধরণের প্রশ্নের প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু এখন? এখনও কি নারীমাত্রই শুধু গৃহিণী? চেতনার তো পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে অনেক পেশাজীবী নারীর মন্তব্য --- গৃহিণী নারী এবং গৃহিণী নারীর স্বামী অন্য নারীকে সচেতনভাবেই এ প্রশ্নটি করেন না যে অন্য নারী বাইরে কর্মরত কি না। কারন তারা হীনমন্যতায় ভোগে।
যদি কখনো বাইরে কর্মরত কোন নারী গৃহিণী নারীকে এবং গৃহিণী নারীর স্বামীকে প্রশ্ন করেই ফেলেন যে তিনি বা তার স্ত্রী কী করেন তবে নির্ঘাত তাকে প্রতিক্রিয়াশীল বাক্য শুনতে হয়।
চাকরি করার সময় কই?
কিংবা চাকরির পয়সার প্রয়োজন নেই।
অথবা চাকরি বাকরি করলে ছেলেমেয়ে মানুষ হয় না। অর্থাত্ যে রাঁধে সে চুল বাঁধতে পারে না।
আমার ছেলেমেয়ের পাঠোন্নতিতে ( দুজনেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী) তো আমার ছেলেমেয়ের বন্ধুর গৃহিণী মায়েরা এবং আমার কিছু আত্মীয় স্বজন আমার অবদান নিয়ে সন্দিহান এবং আমার ছেলে যখন কলেজে পড়ত তখন আমার ছেলের এক বন্ধুর মা তো একদিন বলেই বসলেন ----- আপনি চাকরি করার পরও তো আপনার ছেলেমেয়ে ভালই করছে!
অর্থাৎ চাকরিজীবী মায়ের ছেলেমেয়ে অপদার্থ হবে --- সমাজ কি তা ধরেই নিয়েছে!
আমি তাদেরকে অনেক সময় বলি --- ভাল ফলনের জন্য গাছে সারাদিন জল দিতে হয় না।
তবে আমার ছেলেমেয়ে চাকরিজীবী মায়ের ছেলেমেয়ে হিসেবে কিন্তু গর্বিত।
আবার নতুন প্রজন্মের অনেককেই আফসোস করতেও শুনি--- ইস, আমার মা যদি চাকরি করতেন তবে তো আমি এটি করতে পারতাম, ঐটি দেখতে পারতাম। আমার সমস্যাটি তাড়াতাড়ি বুঝত। ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে সন্তানের সমস্যা বুঝার সাথে যদিও চাকরির সম্পর্ক নেই।
তাদের মত আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে আমার মা যদি চাকরিজীবী হতেন তবে আমার অবস্থান আরও সুদৃঢ় হত। আমার মা যদি আরেকটু লেখাপড়া জানতেন তবে বাবা মারা যাবার পর আমাদেরকে এত অসহায় অবস্থায় পড়তে হত না এবং আমি তার মেয়ে হিসেবে একটু অহংকারী হতাম বৈ কি!
আজকের প্রজন্ম পরিবারে চাকরিজীবী মায়ের অবদান, তাদের যাপিত জীবনকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করবে এবং করে এ প্রত্যাশা আমার বরাবরের মত এখনও অটুট।
আমাদের ছোটবেলায় কলেজে পড়ুয়া মেয়েরাও শাড়ি পড়ত। আমাদের নরসিংদী মহিলা মহাবিদ্যালয়ের ইউনিফর্ম ছিল লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। সেই কৈশোরে আমার পক্ষে শাড়ি পরা কষ্টসাধ্য হলেও বাধ্য ছিলাম। সামলাতে পারতাম না। শাড়ি পরার সেই আনাড়ি ভাবটা এজন্য এখনও কাটাতে পারিনি। আমার অভিজ্ঞতায় ----- অপরিপক্ক বয়সে আনাড়িভাবে কিছু শুরু করলে আর পরিপক্কতা পায় না। তখন মধু কাকিমা শাড়ি পরিয়ে দিতেন। ঐযে শাড়ি পরা নিয়ে পরমুখাপ্রেক্ষিতা – পর নির্ভরশীলতা তা আমার বড় বেলায়ও রয়ে গেছে।
এখন কোন মহাবিদ্যালয়ের শাড়ি ইউনিফর্ম দেখি না। তখন কী আমরা খুব বড় হয়ে মহাবিদ্যালয়ে গেছি? আমার তো মনে হয় না। কলেজে পড়া অবস্থায়ই মেয়েদের বড় বানিয়ে দেয়ার প্রবণতা ছিল। কর্তৃপক্ষ ভাবত মহাবিদ্যালয়ে পড়ুয়া মানেই বড় হয়ে যাওয়া। এখন নিদেন পক্ষে এ ভাবনায় ছেদ পড়েছে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর অনার্স পরীক্ষা পর্যন্ত আর শাড়ি পরিনি। বিয়ের পর আবার শুধু শাড়িই পরেছি এবং দীর্ঘদিন আর ছাড়িনি। বাসায়ও নয়। গত আট দশ বছর যাবত্ দেখি মহিলারা বাসায় মেক্সি পরে আর আমিও চার পাঁচ বছর যাবত্ বাইরে সালোয়ার কামিজ ধরেছি, তবে অফিসে এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে সব সময়ই শাড়ি পরে যাই। বাইরে বলতে বাজারে, বিকেলে হাঁটতে গেলে বা বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডায় সালোয়ার কামিজ পরি। মহিলা সহকর্মীদের সাথে আলাপ করে দেখলাম সবার অভিজ্ঞতাই আমার মত। বিয়ের পর দীর্ঘদিন শুধু শাড়িই পড়েছে। হালে সালোয়ার কামিজ ধরেছে। তবে তারা অফিসেও সালোয়ার কামিজ পরে।
আপাত মনে হয় নারীর চলাফেরায় গতিশীলতা বেড়েছে, নারী তার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারছে, বাইরে বেরুতে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে পারে। শাড়ির কুচি ঠিক করার সময় বাঁচে। সেফটিপিন যোগাড় করা, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ঝামেলা নেই। শাড়ির জন্য পেটিকোট ও ব্লাউজের রং মিলিয়ে কেনা বা বানানোর চেয়ে সালোয়ার কামিজ় ও ওড়নার সেট মেলানো সহজ।
কিন্তু আশেপাশের মহিলাদের সাথে কথা বলে দেখলাম --- দশজনের মধ্যে নয়জনই মনে করে শাড়ির চেয়ে সালোয়ার কামিজ়ে বেশি পর্দা হয়। শরীর ঢেকে থাকে, পেট দেখা যায় না। আরও ভয়ংকর উত্তর হল মধ্যপ্রাচ্যের মহিলারা তো শাড়ি পরে না। মধ্যপ্রাচ্যের মহিলাদের সাথে এক বিলের মাছ হবার আকাংঙ্ক্ষা।
তবে আমি মনে করি --- বিশ্বাস করি --- পোশাক নারীর গতিকে রোধ করতে পারে না। পোশাক নির্ভর করে কাজের ধরণের উপর। উদাহরণস্বরুপ মাটি কাটতে গেলে যেমন শাড়ি পরে কষ্টকর তেমন আবার লুঙ্গি স্বাভাবিকভাবে পরে গাছে উঠা অসম্ভব।
আমার অবশ্য অফিসে শাড়ি পরে এক্সিকিউটিব চেয়ারে বসতে অসুবিধে হয়। শাড়ির কুচি চেয়ারের চাকার নিচে চলে যায়। দু’একটি শাড়ি ছেঁড়ার পর চেয়ার বদলে নিয়েছি, এখনও অফিসে শাড়ি পরা ছাড়িনি।
তাছাড়া সালোয়ার কামিজ পরে কেঊ শাড়ি পরা নারীর চেয়ে এগিয়ে যাবে বা যাচ্ছে – এর কোন আলামত এ পর্যন্ত পাইনি। তবে যারা সহজভাবে চলাফেরার জন্য সালোয়ার কামিজ পরেন তারা সময় ও গতিশীলতার দিক থেকে লাভবান হন বৈকি।
গীতা দাস
ঢাকা
২৬ আষাঢ়, ১৪১৫/ ১০ জুলাই, ২০০৮