তখন ও এখন
(১৫)
ছোটবেলায় আমরা চকে খেলতাম। চক মানে ফসলের পর ফসলের ক্ষেত। এক ফসল উঠার পর পরবর্তী ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময়ে চকেই বিকেলে খেলাধুলা করতাম। চকে দাঁড়িয়ে দুই ঠোঁট বন্ধ করে শ্বাস না ছেড়ে হু উ উ উ করে শব্দ করলে রাজ্যের মশা মাথার উপরে ঘুরপাক খেত। এতে বেশ মজা পেতাম। কে কতক্ষণ শ্বাস না ছেড়ে হু উ উ করে থাকতে পারে আর মশার ঝাঁক কার মাথার উপরে কত বেশি এ প্রতিযোগিতাও ছিল। মশার সাথে শ্বাস না ছেড়ে হু উ উ উ শব্দের নাড়ির কী টান রয়েছে এর কোন জীব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে, যা আমাদের জানা ছিল না, এখনও নেই।
ছোটবেলায় রাতে উঠানে আমি যে দিকে যেতাম চাঁদও আমার সাথে সে দিকে যেত। বাড়ির অন্যান্য ভাইবোনরাও দাবি করত চাঁদ তাদেরকেও অনুসরণ করছে। এ নিয়ে প্রথমে ঝগড়া ও পরে খটকা লাগত আসলে চাঁদ কাকে অনুসরণ করছে?কেউই এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজিওনি, পাইওনি। কোন এক সময় আপনা আপনি সবাই সবার দাবি মেনে নিতাম।
এমনি কত বৈজ্ঞানিক বিষয় যে খটকার সৃষ্টি করে আমাদের জীবনে এর ইয়ত্তা নেই। কোন কারণ না খুঁজে বিষয়টিতে অভ্যস্ত হয়ে যাই। তবে বর্তমান প্রজন্মের কারো কারো যে নিশ্চয়ই জানা আছে তা তাদের সাথে কথা বলেই বুঝা যায়।
কবি সুফিয়া কামাল যথার্থই লিখেছিলেন ----
‘উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরু সব তোমাদের জানা
আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জ্বীণ পরী দেওদানা।’
সবার সাথে নয়, কারো কারো সাথে বললাম এজন্য যে অনেকে বিজ্ঞানকে বিশেষ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হিসেবে পড়ে না, পড়ে পাশ করার জন্য, বেশীনম্বর পাবার জন্য একটি বিষয় হিসেবে।
যাহোক, প্রবীর ঘোষের ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ বই পড়ে অবশ্য অনেক খটকার উত্তর পেয়েছি। এখন মুক্তমনার বদৌলতে জ্ঞানের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টোকা দিচ্ছি যদি অর্গল খোলে!
আমরা রেল লাইন থেকে পাথরের টুকরা এনে গুটি খেলতাম। পাঁচটি পাথরের টুকরা দিয়ে ফুলনা ফুলনা ফুলনা টি খেলার সাথে সাথে মুখে ছড়াও চলত।
একটা করে গুটি তোলার সময় – ফুলনা ফুলনা ফুলনা টি
দু’টি করে গুটি তোলার সময় – এক থেকে দোলনা টি
তিনটি করে গুটি তোলার সময় – তেলনা টি। এভাবে চলত।
কাঁচা অবস্থায় দু’হাতে আর দক্ষ হয়ে উঠার পর এক হাতে গুটি খেলতাম। আরও দক্ষ হয়ে উঠার পর নির্দিষ্ট গুটি তোলার সময় অন্য গুটি ছোঁয়াও নিষেধ ছিল।
সে সব লোক খেলা কি হারিয়ে যাচ্ছে?
মা গুটি খেললে রাগ করতেন। তার রাগের কারণ ছিল পাথরের টুকরার গুটি দিয়ে খেললে হাত শক্ত হয়ে যাবে। মেয়েদের শক্ত হাত ভাল নয়।
অবশ্য কতক্ষণ আর মায়ের চোখের সামনে থাকতাম। খেলা চলতই। বরং মনে হত হাত শক্তই করা প্রয়োজন। তা না হলে অন্যকে মারলে তো ব্যথা পাবে না। তখনই আমি আমার জেঠতুতু ভাইদের কিল থাপড় দিলে ওরা টেরও পেতো না, বলত – দে, আরও দে। তুই পাঁচটা দে আমি একটা দেব। অথচ আমাকে আস্তে দিলেও আমি ব্যথায় ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠতাম । তখন ওরা ননীর পুতুল বলে খেপাত। কাজেই হাত যে শক্ত হওয়া প্রয়োজন সে সিদ্ধান্ত আমি মনে মনে নিয়েই ফেলেছিলাম। যদিও মাকে তা বলার সাহস ছিল না।
এখন আধুনিক মায়েরা মেয়েদের কেরাত শিখতে নিয়ে যায় টিকে থাকার প্রয়োজনে। আজকাল অনেক এন, জি ও এখন নারীদের আত্মরক্ষামূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নিয়ে থাকে। হাতেকলমে আত্মরক্ষার বিভিন্ন কৌশল শেখায়। নারীর জীবন যুদ্ধে লড়াইটা যে চালিয়ে যেতে হবে।
ছোটবেলায় ভাতের সাথে সিদ্ধ দিয়ে আলু শিম ভর্তা হত। ভাতের ভাঁপ লাগানো --- মার লাগানো সিদ্ধের স্বাদ ছিল আলাদা। এখন গ্যাস পুড়িয়ে আলু শিম সিদ্ধ করা ভর্তায় তখনকার স্বাদ পাই না। তাছাড়া এখন যে কয়টা ভাত রান্না হয় এতে আলু শিমেই চাল সিদ্ধ করার পালা।
মা কাকীমারা আলু শিম ভাতের সাথে একবারেই সিদ্ধ দিতেন রান্নার সময় বাঁচানোর জন্য বা জ্বালানি সাশ্রয় করার জন্য অথবা সুস্বাদু করার জন্য দিতেন। কিংবা তিনটি কারণই ছিল। শিম একসাথে সূতা দিয়ে বেঁধে দিতেন। ভাত থালায় থালায় বাড়তে বাড়তে আলু খুঁজে নিতেন। বেগুন তখনও পুড়িয়ে ভর্তা হত এখনও। বেগুনের আসলেই পোড়া কপাল।
এখন মাংসও পুড়িয়ে খাওয়া হয় বারবাকিউর নামে। আমরা তখন জ্বলন্ত অঙ্গারের তাপে মিষ্টি আলু ও কাঁঠালের বীচি পুড়িয়ে খেয়েছি। এখন তা খেতে পারি না। গ্যাসের চুলায় লাকড়ির চুলার মত ভাল পোড়া হয় না। পল্লীকবি জসীম উদ্দীনও মটরশুটি পুড়িয়ে খেয়েছেন। তাঁর ‘নিমন্ত্রণ’কবিতায় এর স্বাক্ষর পাই ------
“তুমি যদি যাও সে সব কুড়ায়ে
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে।”
এশিয়া পেসিফিক অঞ্চলের নারী নেতৃত্বের বিকাশ বিষয়ক কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য গত ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে জাপান গিয়েছিলাম দশ দিনের জন্য। ঠান্ডায় শিরদাঁড়ায় ব্যথা লাগত। সংগঠকরা স্টিকার লাগানো এক ধরনের প্যাকেট দিলেন। স্টিকার খুলে কোমড়ের মাঝখানে লাগিয়ে রাখলে পুরো শরীর ওম ওম লাগত। প্যাকেটের ভিতরে কাঠের গুড়ার মত কোন কিছু ভরা মনে হল। আমার ঠাকুমাদের শীতকালে আইল্যা পোহানোর মত। প্যাকেটটিকে আমার আধুনিক আইল্যা মনে হয়েছিল। মাটির এক প্রকার পাত্র যাকে আইল্যা বলা হত। এতে কিছু ধানের তুষ বা কাঠের গুড়া, গাবের ছোলা অথবা গোবরের শুকনো আঁটির উপরে জ্বলন্ত অঙ্গার দিয়ে রাখতেন। আগুন অনেকক্ষণ থাকত। শীতকালে ঠাকুমারা তা কাছে নিয়ে খেতে বসতেন। শীতকালে এমনিতে বসে থাকলেও আইল্যা কাছে নিয়েই বসতেন। তবে আমার কাছে আইল্যার ধোঁয়াটে গন্ধ ভাল লাগত না।
জাপানের সেই ওম সৃষ্টিকারী আধুনিক আইল্যা পেয়ে মনে হয়েছিল যদি শৈত প্রবাহের সময় উত্তর বঙ্গের গ্রামের বৃদ্ধদের সরবরাহ করা যেত!
গীতা দাস
ঢাকা
৫ শ্রাবণ, ১৪১৫/ ২০ জুলাই, ২০০৮