তখন ও এখন
(১৭)
আমার চাকরির দায়িত্ব হিসেবে আমি প্রায়ই জেলা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ভ্রমণ করি। আমার এ কাজে ঘোরাফেরা করতে গিয়ে আমি কর্মসূচির বাইরেও অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করি। এর মধ্যে সাদামাটা, জটিল, অর্থহীন, তাৎপর্যপূর্ণ, কাউকে বলার মত অথবা নিজে নিজেই হজম করে ফেলার মত এমনি রকমারি সব অভিজ্ঞতা। এর মধ্য থেকেই আজকে কয়েকটি বলতে চাই।
তবে বলার দায়িত্ব আমার আর বিশ্লেষণের দায়িত্ব পাঠকের।
এক. ১৮ জুন,২০০৮ তারিখে জিওবি ইউনিসেফ এর পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ক একটি প্রকল্পের অগ্রগতি পরিবীক্ষণ করতে নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার চরবেলাব নামক গ্রামে গেছি। প্রকল্পের মাঠকর্মী একটি কিশোরী দলের সাথে ঋতুস্রাবএর সময় স্বাস্থ্য শিক্ষা (menstrual hygiene) নিয়ে আলোচনা করছেন। ঋতুস্রাব নিয়ে কিশোরীদের ধারণা, জ্ঞান ও চর্চা নিয়ে আলোচনায় জানা গেল এ নিয়ে অনেক ট্যাবু রয়েছে। মাদ্রাসায় পড়ুয়া মণীষা আক্তার নামে একটি চটপটে মেয়ে জানাল ---- মাসিক হলে শুধু কোরাণ শরীফ নয়, আরবী হরফে লিখিত কোন লেখা ছোঁয়া নিষেধ। তবে বাংলা বই ছোঁয়া যায়।
সতের জনের এ কিশোরী দলের সাথে আলোচনার প্রথমেই সবার পরিচয় জেনে নিয়েছিলাম। মণীষা আক্তারের বয়স চৌদ্দ। সে চরবেলাব সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অষ্টম স্রেণীর ছাত্রী। বাবার নাম রবিউল্লাহ। বাবা সার ব্যবসায়ী।
প্রশ্ন করলাম --- পরীক্ষার সময় কী কর?
উত্তরটাও জানা ---- আরবী হরফে আঙ্গুল না ছুঁইয়ে বইয়ের কিনার ধরে ধরে পড়ি।
হাসি সংবরন করে মনে মনে বললাম, সাপও মারে আর লাঠিও ভাঙ্গে না।
অন্যান্য আরও কথাবার্তা বলে বিদায় নেয়ার সময় বললাম, তোমার নামটা খুব সুন্দর মণীষা। কে রেখেছে?
আমার আব্বা রেখেছেন, তবে ক্লাস নাইনে উঠলে নিবন্ধনের সময় স্যারেরা বলেছেন আমার নাম বদলে দিবেন। নাম না বদলালে নিবন্ধন করতে দিবেন না।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম --- কেন?
মাঠকর্মী উত্তর দিলেন ---- মণীষা তো মনসা মনাসা লাগে। হিন্দু নাম।
মণীষার পালটা প্রশ্ন --- মণীষা আর মনসা কি এক?
প্রিয় নাম পরিবর্তনের আশংকায় তার চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ ছিল স্পষ্ট।
আমাদের সময় ঠাকুর দেবতার নাম রাখার রেওয়াজ আর এখন বিধর্মীদের দেবতার নামের শব্দের সাথে কিছুটা উচ্চারণগত মিল দেখে তা বর্জন। একই আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া।
আমাদের সময়ের গ্রামের মেয়েদের থেকে কী আজকালকার গ্রামের মেয়েদের মাসিক নিয়ে ট্যাবু কমেছে? না বেড়েছে? আমার মনে হয়েছে – জানার পরিধি বেড়েছে, তথ্য পৌঁচেছে, তবে মানার বিষয় কিন্তু না বাড়লেও কমেনি। এখনও মাসিক হলে তারা হলুদ ছাড়া নিরামিষ খায়। মাছ খেলে নাকি শরীর থেকে আঁশটে বা মেছুয়া মেছুয়া গন্ধ বেরুবে আর হলুদ খেলে নাকি ব্যবহৃত কাপড়ে হলুদের দাগ লাগবে।
কবে গ্রামে বিজ্ঞান পৌঁছবে আর তা সাদরে গৃহীত হবে?
দুই. আমেরিকা ইন্সটিটিউট অব রিসার্চ ও ইউনিসেফ যৌথভাবে একটি গবেষণার কাজ করছে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ছয়টি দেশে। এরই অংশ হিসেবে একটি বেস লাইন ইনস্ট্রুমেন্টস পাইলটিং এর জন্য ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার কুমারগাতার মুন্সিবাড়ি গেছি গত ২৩শে জুন, ২০০৮। এ বাড়ির মহিলারা পাড়ার কারও বাড়িতে গেলেও বোরখা পরে যায়। এমন কি চাতালে ছাগল নাড়তে পাশের চালায় গেলেও বোরখা পরে। শিশুদের অনুসন্ধিৎসা বা কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন ছিল। সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী সাদিয়ার মা মাহমুদা বেগমের কাছে ঊনার মেয়ের অনুসন্ধিৎসা বা কৌতুহল কেমন জানতে চাইলাম।
চারপাশের জগতকে জানার জন্য উনাকে প্রশ্ন করে কি না, করলে কি ধরণের প্রশ্ন করে?
উত্তরে জানালেন, তার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে তার সাড়ে পাঁচ বছরের মেয়ে সাদিয়াই বেশি প্রশ্ন করে। যেমনঃ আম্মা, চোর কেমন? চোর কি আমারে মারবে? আল্লাহ কি বুড়া হয়ে গেছে? আল্লাহ বেটা না বেটি?
আল্লাহ ও চোর সম্পর্কে মেয়েটির সমান কৌতুহল। আমার কাজের সাথে প্রাসঙ্গিক না হলেও জিজ্ঞেস করলাম ---- আপনি কি উত্তর দেন?
এত প্রশ্ন করতে না করি। আল্লাহ নিয়ে প্রশ্ন করা গুনাহ তাও বুঝাই। আচ্ছা আফা, মাইয়্যা মানুষের কি এত প্রশ্ন করা বালা? কথাটি বলেই কেঁদে দিলেন।
কাঁদলেন কেন? চোখ মুছে বললেন, মাইয়্যা মাইনষের কান্দন ছাড়া গতি কী? এই মাইয়্যা বড় হইয়া কী করব গো আফা! আল্লাহ লইয়া প্রশ্ন!
মেয়েদের জীবনে কাঁদা ছাড়া গতি নেই --- এ আশংকায়ই কি মা মেয়ে শিশু চায় না!
আর সাদিয়ার মায়ের এ কান্নার সাথে কি সাদিয়ার ভবিষ্যত জীবনের চিত্র জড়িত?
তাছাড়া আমার শিশুর কৌতূহলকে নিবৃত করার যে কৌশল ছিল আর গ্রামের নিরক্ষর মহিলাটির তার শিশু্র কৌতূহলকে মোকাবেলা করার পদ্ধতিগত যে পার্থক্য তা কীভাবে দূর করা উচিত তা নিয়েও ভাবতে হবে বৈ কী।
আর আল্লাহ নিয়ে প্রশ্ন করা মানা শুধু গ্রামের নিরক্ষর, মুন্সী বাড়ির বৌ সাদিয়ার মায়ের নয় --- এ মানা বিজ্ঞানের কোন বিষয় নিয়ে পি এইচ ডি করা অনেক ব্যাক্তিরও।
তিন. আমাদের আরেকটি প্রশ্ন ছিল আপনার পরিবারের কেউ খুশি হলে, দুঃখ পেলে অথবা রেগে গেলে আপনার শিশু কি বুঝতে পারে? মা হিসেবে এগার জন মহিলার এগার জনই বলেছেন পারে। আমি কাঁদলে বাচ্চা বুঝতে পারে এবং বাচ্চার বাবা রাগলেও বাচ্চা বুঝতে পারে। বাবা রাগলে বাচ্চা বাবাকে কিছু বলে না, তবে বাবার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। মা কাঁদলে মাকে কাঁদতে মানা করে ও কাছেই ঘুরঘুর করে। অর্থাৎ বাবার রাগ করার, মেজাজ দেখাবার অধিকার রয়েছে আর মার কান্না ছাড়া গতি নেই ---- এ ধারণা নিয়েই শিশু বড় হয়। রাগী বাবার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হয় তা ও শিশু রপ্ত করে ফেলে সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
অন্যদিকে দুইজন বাবার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। বাবা হিসেবে দুইজন পুরুষই বলেছেন তারা বিষয়টি খেয়াল করেননি।
বাবাদের বেখেয়ালেই যে শিশুর জন্ম হয় ও বেড়ে উঠে এ আর নতুন কি!
গীতা দাস
ঢাকা
২৬ শ্রাবণ, ১৪১৫/ ১০ অগাষ্ট, ২০০৮