তখন ও এখন
(১৮)
বর্ষাকালে পোকা মাকড়ের উপদ্রব অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশিই থাকত। পাশের পাট খেত থেকে কদম ফুলের রঙের ছেঙ্গা আসত পিলপিলিয়ে। আমার গা রি রি করত ঐ পোকাটা দেখলে। কারও পায়ের চাপা লেগে গলে গেলে আরও বিদঘুটে, একটু পিত রঙ্গের পেটা বের হত যা আমার বমির উদ্রেক করত। আমি পারত পক্ষে বর্ষায় পাট খেতের আশেপাশে যেতাম না।
এখন এমন বহু বিদঘুটে, গা ঘুলানো বিষয় হজম করতে হয়। বমি উদ্রেককারী সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনার অক্ষম ও নীরব দর্শক বা শ্রোতা সাজতে হয়। যেমনঃ দুর্নীতির ছলবলিয়ে চলা চলছে প্রবলবেগে। কখনও কখনও চাপে পড়ে দুয়েক জনের পেট গলে গেলেও বাকিরা কিন্তু সাময়িকভাবে থমকে গেলেও থেমে থাকেনি। ভালই চালাচ্ছে। তাই তো ২০০৮ এর ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল এর প্রতিবেদনে আসে বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেনি, বরং বেড়েছে।
আরেক ধরনের পোকা ছিল লাল খয়েরি রঙের। লম্বায় চার থেকে ছয় আঙ্গুল। অনেকগুলো পা। নাম ছিল কেরা। একটু ছোঁয়া লাগলেই গোল হয়ে যেত। কেউ কেউ বলত কাঁচা টাকার মত, অর্থাৎ এক টাকার কয়েনের মত। কোন এক সময়ে এক টাকা রূপার হত বলে কাঁচা টাকা বলা হত। পরবর্তী সময়ে রূপার পরিবর্তন হলেও নামের পরিবর্তন হয়নি। আমি স্বজ্ঞানে কখনো এ কেরাকে ছুঁইনি। তবে অনেকেরই খেলা ছিল কেরাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গোল বানিয়ে রাখা। বেশ খানিকক্ষণ পরে কেরাটি আবার সোজা হয়ে পিলপিলিয়ে চলতে শুরু করত। আমার কাছে এ হেন আচরণকে অস্বাভাবিক মনে হত। অনর্থক জীব জগতে একটা ছোট্ট প্রাণীর স্বাভাবিক চলায় বাধার সৃষ্টি করা।
কেরার তুলনায় মানুষেরা ডাইনোসরের মত আকার ও ক্ষমতার দিক থেকে অনেক বড়। তখন দেখতাম --- কেরার স্বাভাবিক পদচারনায় বাধার সৃষ্টি করে তাদের চলমান জীবনকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য করত। এখন দেখি ডাইনোসরের মত কিছু পুরুষ মেয়েদের স্কুলে যাবার পথে, কর্মক্ষেত্রে আসা- যাওয়ার পথে প্রতিনিয়ত উত্যক্ত করে, একটু ছুঁয়ে দিয়ে, চুলের বিনুনীতে বা ওড়নায় টান দিয়ে তার স্বাভাবিক জীবনযাপন গুটিয়ে রাখতে বাধ্য করে। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে নারীরা কেরার মত একটু পরে আবার চলতে শুরু করতে পারে না, যদিও করা উচিত। এমনকি এর ফলে অনেক নারী আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। ঢাকার মহিমা আর খুলনার রুমী এর উদাহরণ। এছাড়া শুধু ছুঁয়ে দিয়ে নয়, নারীকে ধর্ষন করে তাকে সারাজীবন সামাজিকভাবে পঙ্গু করে রাখার মত ঘটনাও তো অহরহই ঘটছে।
বর্ষাকালে পিঁপড়ার উপদ্রব ছিল। আমাদের বাড়িতে আশ্রিত পঙ্খির মা মাটিতে বিছানা করে ঘুমায় বলে বর্ষাকালে পিঁপড়ার ভয়ে স্নানের পরে মাথায় তেল দিত না।
বলত ---- পিরপায় কারমাইব। অর্থাৎ পিঁপড়ায় কামড়াবে। শব্দে ড় এর স্থান নির্বাচনে উলট পালট করত।
আমরা সাথে ড় উচ্চারণ নিয়ে আরো কিছু বলে ভেঙ্গাতাম। যেমনঃ পঙ্খির মা, উড়বা খাব। ( খইয়ের মোয়া), উড়বা খেয়ে ধাড়মাই যাব। ধাড়মাই এ আছে পিরপা। আর পিরপায় খালি কারমায়। অর্থাৎ খইয়ের উবরা খেয়ে ধামরাই ( ঢাকা জেলার একটি একটি স্থানের নাম) যাব। আর ধামরাইয়ের পিঁপড়ায় কামড়াবে।
রান্নাঘরের আলমারীর চার পায়া চারটি মাটির বিশেষ এক ধরনের পাত্রের মাঝখানের একটি খোপে রেখে আরেকটি খোপে জল দিয়ে রাখত। এতে চারদিকের জল ডিঙ্গিয়ে পিঁপড়া আলমারীতে উঠতে পারত না। চিনির কৌটা আর গুড়ের বৈয়ামও সাবধানে রাখতে হত।
বর্ষায় ঢাকা শহরের তিন তলায় থেকেও কম হলেও প্রাকৃতিক পিঁপড়ার উপদ্রব থেকে রেহাই নেই। আমার বাসার পাশের বরই গাছটিই পিঁপড়ার উৎস।
তাছাড়া এখন অবশ্য সামাজিক পিঁপড়ার উপদ্রব সব ঋতুতেই রয়েছে। এরা কূট কূট কামড়ায়। বিষবিহীন ছোট ছোট কাল পিঁপড়ার কামড়ানোর শক্তি নেই তবে শুধু শুধু বিরক্তিকরভাবে শরীরে বেয়ে যায়। যেমনঃ অফিস আদালতে, কর্মক্ষেত্রে, ভ্রমণে, সামাজিক অনুষ্ঠানে যেখানে যখন যেভাবে পারে ধর্মীয় প্রলাপ শুরু করে দেয়। যে কোন বিষয়ক সভা ও সম্মেলনে ধর্মীয় গ্রন্থের রেফারেন্স ব্যবহার করে। পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে ধর্মীয় গ্রন্থে রেফারেন্স পাওয়া যাবে বলে দাবি করা হয়।
ছোট ছোট লাল পিঁপড়া যাদের কামড়ে বিষ আছে, যেমনঃ পাড়ায় পাড়ায় মসজিদের কিছু ইমাম ও মোয়াজ্জিনরা।
আরও আছে বড় বড় পিঁপড়া, যাকে ওরলা বলা হয়। ওরলায় কামড় দিলে আর রক্ষা নেই। এর উদাহরণের তো অভাব নেই।
তখনকার সময়ে শ্যাম্পুর বহুল ব্যবহার ছিল না। শ্যাম্পুর মিনি প্যাক গ্রামে গঞ্জে পাওয়া যেত না। এমনকি সুগন্ধি সাবানও সবাই ব্যবহার করত না। নদীর ঘাটে দেখতাম বাংলা সাবান দিয়ে কাপড় কাঁচা, স্নান ও মাথা ধোয়া সবইই হত। বাংলা সাবানের বল সের দরে বিক্রি হত। যার যেটুকু দরকার সে সেটুকু কিনে আনত। অনেকে বড়জোর ৫৭০ সাবান দিয়ে স্নান করতেন। তাছাড়া সোডা দিয়ে কাপড়-চোপড় সিদ্ধকরে ধোয়ার প্রচলনও ছিল।
এখন গ্রামে গঞ্জে শ্যাম্পুর মিনি প্যাক এবং হরেক রকম সুগন্ধি সাবানেরও বিক্রি বেশ ভাল। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সহ বিলাসী ইচ্ছা বেড়েছে। এজন্য হয়ত বৈচিত্র্যধর্মী আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের কৃতিত্বও রয়েছে।
আমাদের স্নানের জন্য বরাদ্ধ ছিল লাইফবয় ও কেবল শীতকালে কসকো সাবান। ছোটবেলায় আজকের মত অন্যান্য হরেক রকম কোম্পানীর সাবানের অস্তিত্বই আমরা জানতাম না। বাবা কাকারা শ্যাম্পু ব্যবহার করতেন, আমার কাছে শ্যাম্পু ব্যবহারের চেয়ে শ্যাম্পুর বাহারী বোতলটি বেশি আকর্ষণীয় ছিল।
আমাদের ছোটবেলায় আরেকটি সাধারণ চিত্র ছিল একটু স্বচ্ছল প্রায় পরিবারেই গরীব আত্মীয় স্বজনের একজন থাকত। সে আত্মীয় অবশ্যই হত মহিলা। অর্থাৎ আশ্রিত মানেই মহিলা---- পুরুষ নয়। আবারও বিশেষ করে বিবাহযোগ্য। তবে তাকে আশ্রিত হিসেবে দেখা হত না। সে ও নিজেকে হয়ত তা মনে করত না। খাওয়া পরায় পরিবারের একজন হিসেবেই গণ্য হত। আমাদের পরিবারেও সোনাকাকার এক শ্যালিকা ছিলেন। আমরা মাসিমা ডাকতাম।
একদিন মা শ্যাম্পুর বোতল দিয়ে আমার সেই আত্মীয়োকে আমাদের সাথে নদীতে পাঠিয়েছেন আমার ও আমার ছোটবোনের মাথার চুল ধুইয়ে দেয়ার জন্য। আমাদের মাথায় বরাবরই ঠাসা চুল আর তখন লম্বায়ও যথেষ্ঠ বড় ছিল। নিজেরা ধুইতে পারতাম না। সাথে বাবার লুঙ্গিও ধোয়ার জন্য দিয়েছেন, তবে সাবান নিতে বলেনলি। মাসিমাও বুঝেননি। অথবা ভুলে নেননি। আমাদের স্নানের পর উনি শ্যাম্পু দিয়ে লুঙ্গি ধুইয়ে নিয়ে এসেছেন। বাড়িতে তা আবিষ্কৃত হবার পর কাকিমা ও তার বোন মাসিমা বেকায়দায় পড়েছিলেন। তবে তাদের অবস্থা রবীন্দ্রনাথের বিন্দু আর তার বোনের মতই হয়েছিল কিনা আজ আর তা স্পষ্ট মনে নেই।
গীতা দাস
১ ভাদ্র, ১৪১৫/ ১৬ অগাষ্ট, ২০০৮