তখন ও এখন 

গীতা দাস

()
 

বিয়ের নিমন্ত্রণে ঢাকার এক কমিউনিটি সেন্টারে এসেছি, হঠা গুঞ্জন। খাবার নেই। কেউ বলছে নিমন্ত্রিতদের চেয়ে নিশ্চয় কম আয়োজন করেছে।

কেবলছে আয়োজন ঠিকই ছিল, অনাহুত অনেক মানুষ খেয়ে গেছে। বরপক্ষ ভেবেছে কনেপক্ষ আর কনেপক্ষ ভেবেছে বরপক্ষ। এ অবস্থায় আরেকজন বলছে পরিকল্পনা ঠিক হয়নি । ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ----- আমার ক্ষুধার্ত মস্তিষ্ক ভাবছে আমার ছোটবেলার কথা। গ্রামে কোন বাড়িতে বিয়ে, অন্নপ্রান বা শ্রাদ্ধে সারা গ্রামে নিমন্ত্রণ দেওয়ার জন্য দু-একজন নির্দিষ্ট লোক থাকত। সে লোক একটি ছড়া বলে নিমন্ত্রণ করতেন। ছড়াটি ছিল-

                             আসছে জন

                             আসবে জন

                             গোমস্তা মহাজন  

                             আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ

অর্থা ঘরের সবার তো বটেই যারা অনুষ্ঠানের দিন বেড়াতে আসবেন এবং বাড়িতে বা খেত খামারে যারা কাজ করে তারাও নিমন্ত্রিত। ঐ দিন একবেলার জন্য রান্না-বান্নার বালাই নেই। খাওয়া হত কলাপাতায়। এখনকার মত দ্বিতীয় সারিতে খেতে বসলে গ্লাস ও প্লেটের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুঁতখুঁতের অবকাশ নেই। কলাপাতার দুটো টুকরো বিশেষ ভঙ্গিতে ভাঁজ করে বসা হত। কারণ এত থালা বাসনের জন্য ডেকোরেশনের দোকান ছিল না। এ ঘর ও ঘর  বা এ বাড়ি বাড়ি থেকে থালা এনে আবাসিক অতিথিদের খাবার চলত

যাহোক, ভেবে পাচ্ছি না তখন কি করে সামলাতো? কি করে পরিকল্পনা করত? আর ঐসব কলাপাতায় তরল ডালও খাওয়া যেত। সে এক চমকার লোকজ, শিল্পিত ও কৌশলী ব্যবস্থা বটে।

উপহার আনায়ও ছিল খোলামেলা বিষয়। এতে কোন রাখঢাক বা লুকোচুরি ছিল না। নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়ার সময় উপহার নিয়ে যাওয়া তো হাতের শোভা। রঙিন --- রঙচঙে ---- ঝলমলে কাগজের মোড়কের প্রয়োজন পড়তো না। উপহার হিসাবে থাকতো শাড়ি, পিতল বা কাঁসার বাসন, যেমন কলস, তাগারি। কাঁচের গ্লাস আর জগও উপহারের তালিকায় থাকত। এর পরবর্তী সময়ে ষ্টিলের বাসনকোসন উপহারের প্রচলন ছিল। আরও থাকত দেয়াল ঘড়ি, টেবিল ল্যাম্প ও এ্যালবাম। বুঝা যেত কে কি নিয়ে এসেছেন। কোথাও কোথাও কয়েকজন মিলে আসবাবপত্র, যেমন, আলমারী, ড্রেসিং টেবিল ইত্যাদিও দিত।

এখন সবই লুকানো, গোপনীয়তা রক্ষার নাগরিক প্রয়াস। শহুরে জীবন মানেই ঢেকেঢুকে চলা। শুধু আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে নয়, ঈদ বা নববর্ষের উপহারও মোড়কে ঢেকে দিতে ও নিতে ভালবাসেন। এ নাকি ভদ্রতা । আধুনিকতা। রুচিবোধের পরিচয়। রুচিবোধের রূপান্তর ঘটেছে  সত্যকে ঢেকে রাখার চর্চায়। আধুনিকতার মোড়ক পড়েছে ঝলমলে রঙিন কাগজে।

গ্রামীণ একটি অন্ত্যজ ও অসংস্কৃত শব্দ হিসেবেই এখনো অনেকের কাছে বিবেচিত হয় ।  এ শব্দটির সাথে শুধুমাত্র ব্যাংক, চেক ও ফোন যুক্ত হয়ে লোকায়ত শব্দটিকে বিশেক্ষেত্রে করে তুলেছে সমাদৃতশব্দটি হয়ে গেছে কোথাও কোথাও আধুনিক, র্ন্তজাতিক ও  আদৃত তো  বটেই।  গ্রামীণ শব্দটি আধুনিক জন জীনের অনুসঙ্গ হিসেবে ক্ষেত্র বিশেষে রূপান্তরিত হলেও গ্রামীণ আচার আচরণ এখনো তথাকথিত শহুরে আধুনিকদের কাছে নিন্দিত, নস্য ও পরিত্যাজ্য

কারো কোন আচরণ শহুরে রীতিনীতির সাথে খাপ না খেলে লা হয় গ্রাম্যতাযদিও আর্যতার সংজ্ঞা তাদের জানা নেইকোন জিনিস বা রং পছন্দের বেলায়ও গালি হিসেবে বলা হয় গ্রাম্য পছন্দযদিও নিজেদের বসার ঘরে পাটের শিকা, বাঁশ ও বেতের সরঞ্জামাদি, মাটির হাঁড়ি পাতিল রেখে নিজেকে এদেশীয়  বা গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে প্রমাণ করতে তপর

খাবারের  পছন্দেও কেউ কেউ আধুনিকতা খুঁজে।  স্বাদ আর খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এনে হুরে হিসেবে তথা আধুনিক বলে নিজেকে প্রতীয়মান করতে চায়।

অন্য আরেক দিন এক বিয়েতে ঢাকার এক কমিউনিটি সেন্টারে খেতে বসেছি। দই দিয়ে খাওয়া শেষ। অর্থা খাওয়ার শেষ পদ দই। আমার পাশের জন যিনি উন্নয়ন জগতে স্বনামধন্য একজন নারী তিনি দই দিয়ে পোলাও খাচ্ছেন।  অন্য আরেকজন ফিসফিস করে মন্তব্য করলেন---গেঁয়েমিগাইয়া খাওয়া

আমি হতবাকদই দিয়ে পোলাও খাওয়ায় গ্রাম্যতা কোথায় দেখলেন! কমিউনিটি সেন্টারে এটি খাওয়া কি নিয়মের পরিপন্থী? নাকি কমিউনিটি সেন্টারে বসে খাওয়ার সময় প্রচলিত চর্চার ব্যতিক্রম? আমি হেসে, কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম ---- এতে কি কোন সমস্যা হয়েছে! একদিন বাসায় খেয়ে দেখবেন আর আপনার মুরুব্বীদের কাউকে জিজ্ঞেস করবেন --- কখনো তিনি দই দিয়ে পোলাও খেয়েছেন কি না?

দইয়ের কাপে কাঠি দিয়ে একটু একটু  করে খুঁটে খুঁটে খাওয়াই কি শহুরে সংস্কৃতি? বা তথাকথিত সংস্কৃতিবান? আমি অবশ্য সে সংজ্ঞা জানি না।  

আবার এমন দাওয়াতও পাই যেখানে হাত দিয়ে খেতে সামাজিক অস্বস্তি অনুভব করি। সবার সাথে চামচের টুংটাংয়ে খেতে হয়। এদিকে আবার হাত দিয়ে না খেলে খাবারের আসল মজা পাই না। মানসিক ও শারীরিক স্বস্তিও পাই না। কোন কোন সময় হাত দিয়ে খেয়ে ফেলি। সাথে আমার মত অনাধুনিক --- চৌকষ নয় এমন দুএকজনকে খুঁজে নেই। ভাতের সাথে ব্যঞ্জন না মাখিয়ে কি আসল স্বাদ পাওয়া যায়?

আমি মনে করি জাপানী, চাইনিজ বা কুরিয়ানরা যেমব কাঠি দিয়ে খায়, ইউরোপীয়ানরা খায় চামচ দিয়ে তেমনি আমার সংস্কৃতিও হাত দিয়ে খাওয়ার। এতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হবার কিছু নেই।

ছোটবেলা --- আমার উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও বাবা কাকারা প্রায়ই ভাত মেখে দিতেন। মাখা ভাত শুধু ঢপাঢপ খেয়ে ফেলতাম। কাঁসার থালায় ভাত মাখানোর পর হাতটা থালার কান্দায় চাঁছির যে স্বাদ তা কি ভুলা যায়?

এখন অবশ্য আমি ঢাকার বাসায় কাঁসার থালায়ই ভাত খাই,। ভাত এটেঁ সেঁটে মাখা যায়। মাখানোর সময় থালা নড়ে না। যদিও কাঁসার থালা বাসা বাড়িতে চকচকে রাখা বড় কঠিন। মাটি ও বাঁশ পাতা অথবা খড়ের সাথে একটু টক মিশিয়ে বা টক জাতীয় কোন পাতা দিয়ে  মাজার সরঞ্জামদির বড় অভাব এ শহরে।

তবে আমার ছেলেকে এখন আর কাঁসার থালায় খাওয়াতে পারিনা। সে এ সব হিপোক্রেসিতে নাকি বিশ্বাস করে না। আমার আধুনিকতার সব জীবনাচার ঠিক রেখে শুধু কাঁসার থালায় খাওয়ার নাম নাকি তথাকথিত ঐতিহ্য লালন করা বুঝায় না। আমি কিন্তু ঐতিহ্য বা হিপোক্রেসি এ সব মাথায় রাখিনি। আমি আমার ভাত খাওয়ার আয়েশটুকু --- সুখটুকু ---হারাতে চাই না। 

গীতা দাস
মণিপুরীপাড়া, ঢাকা- ১২১৫

[email protected]