তখন ও এখন
(২০)
ছোটবেলায় আমাদের ভাইবোনদের কাউকে লেখাপড়ায় অমনোযোগী দেখলে মা প্রায়শঃই বলতেন ---- একজন হুজুর আরেকজন মজুর হলে চলবে না। এখনকার আহ্লাদ ভবিষ্যতে থাকবে না। একজন আরেকজনকে আজীবন টানতে পারবে না। পারলেও তা কারও জন্যই স্বস্থির হয় না।
হুজুর ও মজুর বলতে মা মনিব ও চাকর বুঝাননি। হুজুর বলতে একটা ভাল চাকরি করা যাতে আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে আর মজুর বলতে আর্থিকভাবে হুজুরের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অস্বচ্ছলতাকে বুঝাতেন।
মায়ের এ কথার প্রমাণ এখন নিজেরসহ চারপাশের আট-দশটা পরিবারের ইতিহাস পর্যালোচনা করে এবং তাদের সাথে কথা বলেই পাই। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের প্রায় পরিবারের ঘটনা বিশ্লেষণ করলেও এ চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। পাঁচ ছয় ভাইবোনের মধ্যে ছোটবেলায় যে দু’একজন মা–বাবাকে লেখাপড়ায় ফাঁকি দিয়েছিল তারা বড় বেলায় এসে টের পায় যে সে নিজের জীবনকে ফাঁকিতে ভরে রেখেছে।
আপন ভাইবোনদের মধ্যে কারও হুজুর আর কারও মজুর হুওয়া মানে উভয়েরই আপসোসে ভরা জীবন। এ এক অমোঘ অভিশাপের মত। একটা সময় হুজুর মজুরকে টানে। ভাইয়ের চেয়ে বোন হুজুর হলে বেশি সময় ধরে টানে। তবে বোন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেয়ে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণত স্বামীর পায়ে ভর করেই বেশি দাঁড়ায়। কাজেই বোনেরা আক্ষরিক অর্থে হুজুর হয় খুব কমই। যে টানে সে স্বস্থি পায় না, যাকে টানে তার তো স্বস্থি নাই-ই। আর হুজুর মজুরের মা বাবার তো শাঁখের করাতের মত অবস্থা। নিজের সন্তানদের অসম অবস্থা ও অবস্থানের চিত্র মা বাবার জন্য বড় বেদনাদায়ক। অস্বচ্ছল সন্তানের জন্য স্বচ্ছল সন্তানের সুখকে প্রাণভরে উপভোগও করতে পারে না।
এক মায়ের সন্তান। এক বিছানায় ঘুমিয়ে বড় হওয়া, এক সাথে স্কুলে যাওয়া, এক পাতে খাওয়া, এক সাথে খেলা, একই দামের কাপড়-চোপড় পরা --- সব – সবই পরিবর্তন হয়ে যায় সময়ের সাথে। আর্থিক অবস্থা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের পার্থক্য গড়ে দেয় অনায়াসে।
তখনকার সময়ে একই পরিবারের ভাইবোনদের মধ্যে আর্থিক অবস্থার পার্থক্য থাকলেও সম্পর্কটা হুজুর ও মজুরের পর্যায়ে যেত না। একজনের আয়ে পরিবারের অন্যান্যদের অধিকার থাকত। এখন একক পরিবার সৃষ্টির ঢেউয়ের ঝাপটায় তা ভেঙে যাচ্ছে। এখন আপন ভাইবোনরা এক শহর বা জেলায় থেকেও লক্ষ যোজন দূরে। যার যার তার তার যুগে যুগে অবতার। অবতারই। তবে কলিযুগের।
বাবার মৃত্যুর পর উপায় না দেখে ঢাকার বাইরে গেছি একটি আধা - সরকারী চাকরি নিয়ে। সাড়ে তিন বছর বরিশাল , ঝালকাঠি ও জামালপুর জেলায় চাকরি করার পর ঐ চাকরি ছেড়ে যোগদান করেছিলাম একটি বেসরকারী সংস্থায় (এন জি ও) । নিজ জেলা নরসিংদীতে পোষ্টিং ছিল। এখন ঐ বেসরকারী সংস্থাটি বিখ্যাত, যদিও কর্মীদের অবস্থা কেমন জানি না, তবে ১৯৮৯- ৯০ সালে ঐ সংস্থাটি পৈত্রিক অফিসের মতই চালাত। বেসরকারী সংস্থার চাকরিতে ইংরেজী জানা না থাকলে কেরিয়ার নেই জেনেই ইংরেজী শেখার শুরু। অর্থাৎ আমার ইংরেজী বিদ্যা যেটুকু আছে তা যদিও নেহায়েৎই কম, তবে সেটুকুই বড়বেলায় শেখা।
বড়বেলায় শেখা ইংরেজীর দৌড়ে --- শক্তিতেই এখন ইউনিসেফ এ চাকরি করছি।
ছোটবেলায় সোনাকাকার আদেশ মেনে মুখস্থ করেছিলাম --- থার্ড পারসন সিংগুলার নাম্বার ভার্ব এর শেষে এস বা ই এস যোগ করতে হয়। যেমন ------। তখন বুঝে না বুঝে শুধুই মুখস্ত করেছি।
গরু রচনা শিখেছি --- দি কাউ ইজ এ ডোমেষ্টীক এন্ড ফোর ফুটেড এনিমেল ----। গরু শিখে ছাগল রচনা লেখার মত বুদ্ধি পাকেনি। এখনকার শহুরে ছেলেমেয়েদের তো সুনির্দিষ্ট কোন রচনাই বলে দেয় না। অনির্দিষ্ট থেকেই পরীক্ষায় আসে।
ইংরেজীতে দরখাস্তও মুখস্ত চলত, আই বেগ টু স্টেট, আই বেগ টু স্টেট দ্যাট --। অথচ আমার ছেলেমেয়ে বাংলা মাধ্যমে পড়লেও প্রাইমারী থেকেই অনুপস্থিতির জন্য নিজের হাতে ইংরেজীতে দরখাস্ত লিখে আমার বা তাদের বাবার সুপারিশ নিয়ে স্কুলে যেত। আমার ছেলের সেন্ট যোসেফে ও আমার মেয়ের হলিক্রস স্কুলে বাংলায় লেখা দরখাস্ত গ্রহণ করা হত না।
আমাদের সময় থেকে এখনকার শহরে লেখাপড়ার মান অনেক অনেক ভাল হলেও গ্রামের অবস্থা কিন্তু উন্নত হয়নি। আমার মাঝে মাঝে গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের সাথে অভিজ্ঞতা তাই বলে। গ্রামের আর শহরের লেখাপড়ার এ পার্থক্য যে কবে ঘুচবে!
যানজটে আটকে থাকলে দেখি কিছু লোক গাড়িতে টোকা দেয়। মৃদু থাপ্পরও দেয়। শুধু আমারটায় নয়, অন্যান্যদেরটায়ও। এমনকি বাসেও। ড্রাইভার সাহেব বিরক্ত হয় এবং অনেক সময় মুখ খিঁছড়ে মানাও করে। আমি মুখে কিছু না বললেও বিরক্ত হই। হঠাৎ হঠাৎ টোকা বা মৃদু থাপ্পড়ের শব্দও বড় বেশি কানে বাজে। ভিক্ষুকরাও মাঝে মাঝে এমন করে।
এ প্রসঙ্গে ছোটবেলার একটি অভ্যাসের কথা মনে পড়ে। ক্ষেতের আল দিয়ে হাঁটার সময় ধানের ছড়া ছিঁড়ে ধান মুখে দিয়ে খুটতাম। কখনো দুধ বের হত, কখনো বা নরম চাল। যা- ই বের হত তা – ই চিবাতাম। গলায় খসখসে লাগলেও অবচেতনভাবে --- অভ্যাসবশতঃই তা করতাম। এ সব লোকজনও অভ্যাসবশতঃই গাড়িতে টোকা বা মৃদু থাপ্পর দেয়।
কলেজে পড়ার জন্য বেশ উদগ্রীব ছিলাম। যতটা না উচ্চশিক্ষার ধাপে পা রাখার জন্য তার চেয়ে বেশি ছিলাম কেতাদুরস্ত ভাব প্রকাশের জন্য। শুধু একটা খাতা নিয়ে কলেজা যাব। যা দেখতাম আমাদের বাড়ির , পাড়ার ও গ্রামের অন্যান্য কলেজে পড়ুয়াদের। কিন্তু ভর্তি হয়েই সে ভুল ভাঙ্গল। ঘোর কাটল। মহিলা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। মোটামুটি নতুন কলেজ। স্কুলের মতই লেখাপড়া। বিশেষ করে বাংলা ও ইংরেজী বই ছাড়া ক্লাসে বসা নিষেধ। রত্নাদি লজিক বই ও নিতে বলতেন। মনে মনে রাগ থাকলেও উপায় ছিল না। অগত্যা বইয়ের বোঝা বইতেই হয়েছিল এবং যা কলেজে পড়ার আলাদা আবহ ও আমেজটুকু কেড়ে নিয়েছিল।
গীতা দাস
১৬ ভাদ্র, ১৪১৫/ ৩১ আগষ্ট, ২০০৮