তখন ও এখন
(২১)
ছোটবেলায় আমরা কাউকে আগে থাপ্পড় দিয়ে পরে চিমটি কাটতাম আর মুখে বলতাম -----
‘শুভংকরের ফাঁকি
থাপ্পড় হতে চিমটি নিলে কত থাকে বাকী’ ?
সঠিক উত্তর না দেয়া পর্যন্ত থাপ্পড় আর চিমটি চলত। উত্তর জানা থাকলেও কেউ ব্যথায় উঃ আঃ করতে করতে উত্তর দিতে দেরী করলে আরও দুই তিনবার থাপ্পড় আর চিমটি দেয়া হয়ে যেত। যে নতুন শুনত সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে জানতে চাইত এর মানে কী? তখন হাসতে উত্তর দেয়া হত --- তিন।
স্বাভাবিক প্রশ্ন ---- কীভাবে?
ব্যাখ্যা দেয়া হত ---- থাপ্পড় দেয়া হয় পাঁচ আঙ্গুলে আর চিমটি দিয়ে নেয়া হয় দুই আঙ্গুলে। থাপ্পড় আর চিমটি খাওয়া বন্ধুটি তখন ব্যথা ভুলে বা সংবরণ করে হেঃ হেঃ করে হেসে উঠত। আর জানা বন্ধুরা পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে বা ঢাকতে কপট রাগ দেখিয়ে বলত --- সব সময় এসব ভাল্লাগে না।
বড়বেলায়ও অনেক শুভংকরের ফাঁকিতে পড়ছি। দিচ্ছিও হয়তো বা। দেয়ার সময় খুব মজা পাই আর খাওয়ার সময় সেই ছোটবেলার মত কখনো ব্যথায় উঃ আঃ করি, কখনো কপট রাগ দেখাই আবার কখনো বোকার মত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে প্রশ্ন করি – কীভাবে?
বড়বেলায় এমনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়ার একটি ঘটনা ঘটল এইতো কয়েক দিন আগে। ১৯ জুলাই,২০০৮ এর পর। কবি সমুদ্র গুপ্তের মৃত্যু সংবাদ পত্রিকায় পড়ার পর প্রতিক্রিয়ায় একজন বললেনঃ আগে জানতাম না যে সদ্য প্রয়াত কবি সমুদ্র গুপ্তের আসল নাম আবদুল মান্নান। ইস্ মারা যাবার পর জানলাম।
প্রশ্ন করলাম --- জানলে কী হত?
না, একজন শক্তিমান মুসলিম কবি মারা গেলেন।
ব্যাখ্যা দিলামঃ ---- কবিরা হিন্দু মুসলিম হয় না। তাদের হৃদয়ের মানবিকবোধই বেশি প্রাধান্য পায় --- কোন বিশেষ ধর্মীয় বোধ নয়। তা ছাড়া কবি নিজেও মুসলিম কবি হিসেবে নিজের পরিচিতি চাননি। সমুদ্র গুপ্ত যে শুধুই একজন কবি ছিলেন তা তার সন্তানদের নাম স্বপ্ন সমুদ্র ও নীল সমুদ্র থেকেই বুঝা যায়।
দ্যোদুল্যমান কণ্ঠে, না --- মানে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। তার অসুস্থতা নিয়ে পত্রিকায়ও অনেক খবর ছিল। আমি ভেবেছিলাম তিনি একজন হিন্দুধর্মাবলম্বী কবি।
ক্ষোভের সাথে বললাম ---- তবে কী হিন্দু কোন কবি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলে আমাদের কিছু করার নেই?
তাড়াতাড়ি উত্তরা দিলেন---- আছে। অবশ্যি আছে। তবে ---
তবে কী? এ তবের কোন উত্তর হয় না। হয় কী?
ছোটবেলায় থাপ্পড় হতে চিমটি নিলে শুভংকরের ফাঁকিতে বিয়োগ অংক হত। এখন কবির সাথে মুসলিম বা হিন্দু যোগ করলে এ যোগ অংকের ফলও কিন্তু শুভংকরের ফাঁকি হয়।
প্রাইমারী স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করেছিলাম ---তোমাদের প্রিয় কবি কে?
শতকরা নব্বইজনেরই উত্তর ---- নজরুল ইসলাম।
পুরো নাম বল।
কেউ বলেছে --- কাজী নজরুল ইসলাম।
কেঊ বলেছে ---- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
কেন প্রিয়?
জাতীয় কবি বলে। ----- শতকরা হিসেব করলে পাঁচজনের এ উত্তর।
আর বাকীদের উত্তর শুনে আৎকে উঠেছিলাম ---- মুসলমান বড় কবি বলে।
আমার ছোটবেলায় যে শ্রেণীর পাঠ্য রচনা বইয়ে প্রিয় কবি হিসেবে যাঁর নাম লেখা ছিল সে শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনিই ছিলেন প্রিয় কবি। কোন কবির কবিতা পড়ে প্রিয় কবি সম্বন্ধে রচনা অবশ্য পরীক্ষায় লিখিনি। তবে ঐ কবির ধর্ম নিয়ে কোন বাক্য শিখেছি বলে স্মৃতিতে নেই। বরং জানতাম কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামী সংগীতের পাশাপাশি অনেক শ্যামা সংগীতও লিখেছিলেন। গ্রাম বাংলার মানুষের সুখদুঃখ চিত্রায়ণে জসীমউদ্দীন অদ্বিতীয়।
তবে বড়বেলায় আমি জেনে শুনে দেখে বুঝেই প্রিয় কবি, প্রিয় উপন্যাসিক বা প্রিয় অনেক অনেক কিছুই নির্বাচন করি ----- রাজনৈতিক মতাদর্শসহ।
ইদানিং কৌতূহলবশত আশেপাশের অনেকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম কার প্রিয় কবি কে? এবং প্রিয় কবির কী কী পড়েছেন।
যাদের প্রিয় কবি কাজী নজরূল ইসলাম তারা নজরুল ইসলামের ভোর হল দোর খোল খুকুমণি ওঠরে কবিতাটির বেশ কয়েক লাইন বলতে পারেন; আর বিদ্রোহী কবিতাটির নাম জানেন কবিতাটির বল বীর বল উন্নত মম শির লাইনটিসহ। আর বড়জোর অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের নাম শুনেছেন (তবে সংখ্যায় খুবই কম)।
রবীন্দ্রনাথের ভক্তরা আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে / বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে --- এ দু’ লাইন মুখস্ত ছাড়া জানে গীতাঞ্জলী লিখে তিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।
জসীমউদ্দীন যাদের প্রিয় তারা কবর কবিতার প্রথম দু’লাইনসহ ‘নক্সীকাঁথা’ না পড়লেও নাম জানেন।
শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’এ লাইনটি ছাড়া কোন কাব্যগ্রন্থ বা তাঁর কবিতার নাম কিছুই না জানলেও তিনিই তাদের প্রিয় কবি। কারন তিনি আধুনিক কবি এবং বাংলা ভাষায় সমসাময়িক কবিদের মধ্যে প্রধান কবি।
এ শুভংকরের ফাঁকি তো গুনণে ভরা। কত গুণ?পরিমাপ করা যায় না।
আমি ছোটবেলায় সাধারণত ছেলেমেয়ে দু’দলের সাথেই খেলতাম। খোলামকুচি, সাত চাড়া , আবার মার্বেল দিয়ে গুল্লি খেলা। জেঠতুত ভাইদের সাথে চলত প্রতিযোগিতামূলক গুল্লি খেলা। জানতে পারলে পিঠের ছাল টের পাবে বলে সোনাকাকাকে ফাঁকি দিয়ে খেলতাম। সোনাকাকা গুল্লি খেলা একদম পছন্দ করতেন না।
গুল্লি খেলায় একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে একটা দাগের ওপারের একটা গর্তে মার্বেল ফেলার জন্যে মারতাম। পরে অপরপক্ষ যে মার্বেলটা চিহ্নিত করে দিত সে মার্বেলে লাগানোই হত লক্ষ্যস্থল। এক্ষেত্রে জটিল অবস্থানে আছে এমন কোন মার্বেল বা দিল্লীরটাতে লাগাতে বলত। দিল্লীরটা মানে সবার দূরেরটা। আমেরিকা, অষ্টেলিয়া, কানাডা বা আফ্রিকা নয়। দিল্লী। তখন দিল্লীই ছিল বহুদূর। অসম্ভব কোনকিছু ঘটানোর জন্যে কারো প্রস্তুতিতে নেতিবাচক কিছু বলতে হলে বলা হত --- দিল্লী বহুদূর। অর্থাৎ লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব নয়।
এখন? এখনকার শিশুদের তো গুল্লি খেলার সময় দূরেরটাকে বলা উচিৎ মঙ্গলগ্রহ বা চাঁদেরটা। নাকি এ দু’টোও আমাদের সময়কার দিল্লীর চেয়েও কাছে?
গীতা দাস
২৬ ভাদ্র, ১৪১৫/ ১০ সেপ্টেম্বর, ২০০৮