তখন ও এখন 

গীতা দাস

(২২)

ঈদের কাপড়-চোপড় কিনতে গিয়ে আমার এক সহকর্মীর মেয়ের সাথে তার খটকা বেঁধেছে। ঊনি পেষ্ট কালারের সালোয়ার কামিজ খুঁজছেন দেখে মেয়ের আপত্তি পেষ্ট কালার নামে সুনির্দিষ্ট কোন রঙ নেই। বাজারে হরেক রঙের পেষ্ট পাওয়া যায়।

সহকর্মীটি তার মেয়েকে বুঝাতে সক্ষম হননি বললে ভুল হবে--- মেয়েটি বুঝতে চায়নি যে পেষ্ট কালার হিসেবে একটি  চিহ্নিত ও নির্দিষ্ট রঙ আমাদের সময়ে পরিচিতি ছিল। তখন টুথ পেষ্ট বলতে বাজারে সাদা রঙের আর সাদার সাথে এক দুই ফোঁটা সবুজ মিশিয়ে যে রঙ সে রঙের পেষ্ট পাওয়া যেত। আমরা ঐ রঙকে পেষ্ট রঙ না বলে পেষ্ট কালার বলতাম এবং এখনো বলি।

সহকর্মীর কথা শুনে এখনকার রঙের বাহারের সাথে আমাদের তখনকার রঙের নামকরণের সীমাবদ্ধতার কথা মনে এলো।

আমরা সাদা বলতে একটা রঙই বুঝতাম। সাদার কাছাকাছি অন্য একটা  ছিল ঘিয়ে ঘিয়ে রঙ। এখন দুধ সাদা, বরফ সাদা।  

গোলাপী বলতে কেটকেটে রঙ বুঝতাম। এখন বুঝি বেবী পিংক, পার্ল পিংক।  

তখন শুধুই খয়েরি ছিল। এখন শালিক খয়েরি। লালচে খয়েরি। কালো খয়েরি। লাল রঙকে যে এখন কত ভাগে চেনানো হয়! এখন আবার রাণী রঙও আছে। আমাদের সময়ে শালু লাল বাদে আর সবই লাল।   

সবুজকে বলতাম পাতা রঙ। পাতার মধ্যে কচি কলা পাতা আর টিয়া রঙকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতাম। আরেকটা ছিল পীত রঙ যা বোতল গ্রীণ নামেও পরিচিত ছিল। আর সবই পাতা রঙ। আমার মা যে কোন সবুজ বা পাতা রঙের শাড়ি পছন্দ করতেন। মায়ের ধারণা ছিল সবুজ বা পাতা রঙ চোখের জন্যে ভাল। চারদিকের সবুজের মত নিজের পোষাকের রঙ সবুজ । এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমি জানি না।  এখন বিভিন্ন মৌলিক রঙের সাথে পরতে পরতে ভিন্ন নামে ডাকা হয়। রঙ এবং এদের নাম তো আর নতুন করে সৃষ্টি হয়নি, শুধু বিভিন্ন রঙকে আলাদা নামে চিহ্নিত করে বলার চর্চা বেড়েছে।

 আমাদের নরসিংদী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের পোষাক ছিল ফিরোজা রঙের জামা । একটু বড় হলে সাথে সাদা সালোয়ার ও ওড়না। সেই তখন থেকেই ফিরোজা আমার একটি প্রিয় রঙ।  আমি সব সময় দুএকটা শাড়ি ফিরোজা রঙের পরিই

এখনও কাজী নজরুলের  কবিতার ---

ঝিঙে ফুল ! ঝিঙে ফুল !

সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে- কূল

ঝিঙে ফুল

লাইন কয়টি মনে মনে আওড়াই  আর চোখে ভাসে আমার বিদ্যালয়ের পোষাক পরা এক ঝাঁক মেয়ে।  

শাড়ি আর ব্লাউজের রঙ মিলাতে অনেককেই দেখি দোকানে দোকানে শাড়ি সাথে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে গলদঘর্ম। ম্যাচিং সেন্টারে গিয়েও যখন রঙ মিলে না তখন হতাশ হতে দেখি। আমাদের সময় আমার মফস্বলে এত রঙ মিলানোর ফ্যাসন ছিল না । 

পায়জামার ডুরি বানাতাম মা কাকীনামাদের পুরানো শাড়ির পাড় ছিঁড়ে বেশ কিছু বছর আগেও পেটিকোটের ডুরি পুরানো শাড়ির পাড় দিয়েই বানানো হত এর জন্য নারীকে --- বালিকাদের কম খেসারত দিতে হয়নি ফট করে রাস্তায় পায়জামা বা পেটিকোটের ডুরি ছিঁড়ে গিয়ে বহু নারী ও বালিকা বহুদিন বেকায়দায় পরেছে অনেকে আমার এ বিষয়ের অবতারণার জন্য আমার নির্লজ্জতায় প্রশ্ন তুলবেন, কেউ ভাববেন আমার আক্কেল নেই কেউ শুনাবেন --- আদৌ আমি ভদ্র কিনা আমি কিন্তু শুধু আমাদের কিছু নারীর অভিজ্ঞতার কথা বলেছি

বেশ কিছু বছর যাব বাজারে রেডিমেট পেটিকোটের সাথে ডুরিও দেয়া হয় পায়জামা বা পেটিকোট বানালে দর্জি নিজেই নতুন কাপড় দিয়ে ডুরি বানিয়ে দেন পেশাজীবী দর্জির সেবার মান বেড়েছেএখন অধিক মুনাফা অর্জনের কৌশল হিসেবে রেডিমেটের বেলায়ও পেটিকোটের সাথে ডুরিও কেনা যায়পণ্য বাজারজাতকরণের দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গী আধুনিক জীবন যাপনকে আরামদায়ক করছে, আর এতে এক্ষেত্রে অন্তঃতপক্ষে নারীর যাপিত জীবনে এসেছে স্বস্থি    

ইদানিং গ্রামে গঞ্জে লক্ষ্য করছি কিছু লোকজন শুদ্ধ কথা বলার চেষ্টা করে, তবে কোন একটি বাক্যের মাঝে দুএকটি আঞ্চলিক শব্দ চয়ন করে কানে বিঁধিয়ে দেয় --- শ্রুতিকটূ লাগেশুদ্ধ কথা বলায় অনভ্যস্ততাই এর কারণ যেমনঃ পোস্টারটি বাজারের মাঝখানে কোন এক দেয়ালে আঠা দিয়েলটকাইয়া’ ( টানিয়ে) দিবেনঅথবা মিটিংয়ে কথা বলার সময় হাত আঙ্গাইয়া ( তুলে) কথা বলবেনসুনির্দিষ্টভাবে আমার এ অভিজ্ঞতাটির অর্জন মাস তিনেক আগে নরসিংদী জেলার কোন একটি এন জি ও এর কর্মী সভায় ইংরেজী কম জানা ব্যক্তিরা যেমন কথা বলার সময় শব্দ ভান্ডারের সীমাবদ্ধতায় ভূগেন তেমনি এন জি ও এর  ঐ নির্বাহী পরিচালক শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে গিয়ে শুদ্ধ ভাষার শব্দহীনতায় ভূগছিলেন

আমার পুরো বাক্য আঞ্চলিক ভাষায় শুনতে শ্রুতিকটূ লাগে না, স্বাভাবিক, স্বত্বঃসিদ্ধ ও প্রাকৃতিক লাগে কিন্তু এমন মিশ্র শব্দ চয়ন পরিবেশকেই হাস্যমুখর করে ফেলেআমার উচ্চারণে আমার জন্ম স্থানের সাক্ষী নরসিংদীর আঞ্চলিক টান আসেএজন্য আমি কোন রকম অস্বস্থিবোধ করি নাএ আমার জন্মগত অর্জন আঞ্চলিক টান আর শুদ্ধ বাক্যে আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার এক কথা নয়

অনেকে বাংলা বাক্যের বাঁকে বাঁকে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেনঅথবা ইংরেজী বাক্যের খাপে খাপে বাংলা শব্দ বসিয়ে দেন সামঞ্জস্যতা ছাড়াই করেনযেমনঃ এটি ঘোষণা অব দি বাংলাদেশ গর্ভনমেন্ট

এটা আগেও ছিল, বিশেষ করে বিয়ে বাড়িতে বর পক্ষ আর কণে পক্ষ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা আর বাংলা বাক্যের মাঝে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে কথা বলা চালাযে পক্ষ যত বেশি এভাবে কথা চালাতে পারত সে পক্ষ তত বেশি মর্যাদাসম্পন্ন বলে নিজেরাই মনে করত

শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার কথা বললাম এজন্য যে সাধারণত আঞ্চলিক ভাষায়ই কথা বলার প্রচলন ছিল দুএক জন তাদের পান্ডিত্য জাহির করার মানসেই এ ধরনের বাক্য ব্যবহারের প্রয়াস বা অপপ্রয়াস চালাত যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও ইংরেজী  বলার একটা ইচ্ছেনিজের বিদ্যার বহর যে অনেক লম্বা তা প্রকাশের বেদনায় উন্মূখ ছিল এবং এখনো আছে

আমার অফিসে দুএকজন বাঙালী বাংলা বাক্য উচ্চারণে ইংরেজী বাচনভঙ্গি ব্যবহার করেন ইংলিশ মাধ্যমে পড়ুয়া কিছু ছেলেমেয়ের মধ্যেও এ চর্চা রয়েছে যেমনঃ টুমি বলটে পার না বলে শুনটেও চাও না

আসলে আমি বলতেও চাই না এবং শুনতেও চাই নাবিকৃত এ সব বাংলা উচ্চারণ শুনলে আমার গা জ্বলে উঠে মাতৃভাষা উচ্চারণে এ সব বিজাতীয় ঢং মানতে পারি না

গীতা দাস

অক্টোবর, ২০০৮

[email protected]