তখন ও এখন
গীতা দাস
(৪)
অঘ্রাণ পৌষ মাসে খড়ের উপর লেপ কাঁথা রোদে দিত। এর উপরে বসে ওম উপলব্ধি করার আমেজ তো শহরে আর কম্বলের নিচেও পাই না।
সকালের রোদে বসে খাওয়া। স্ন্ধ্যায় হারিকেনের আলোয় পড়া। বাতাসে হারিকেন নিভে যায় বলে বাতাস আড়াল দেয়া। ঝিমুতেও সুবিধা। আমার চেহারা দেখা যেত না ছায়ার জন্য। অবশ্য মাঝে মাঝে পড়ার বইয়ের ভাঁজে গল্পের বইও পড়তাম মাকে লুকিয়ে। হারিকেনের চিমনি একটু ভেঙে গেলে কাগজ দিয়ে ঢেকে পড়তাম। ভাঙা চিমনি বদলাতে দু’একদিন সময় লাগত। দিনের বেলায় মা কাকীমাদের বলতে মনে থাকত না। বলার পর কাকারাও আনতে দু’একদিন ভুলে যেতেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কিন্তু ভালই লাগত। পড়তে পড়তে ভাঙা জায়গায় কাগজ লাগানোর খেলায় মেতে থাকা যেত। আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছিল।
এখন ছেলেমেয়েদেরকে হারিকেনের চিমনি ভাঙায় কাগজ দিয়ে এর ছায়ায় লুকিয়ে ঝিমুতে হয় না বা গল্পের বই পড়তে হয় না, সরাসরি দরজা বন্ধ করেই যা করার করে।
শীতকালে রোদে ছালা বিছিয়েও পড়ার রেওয়াজ ছিল----- সাথে মুড়ির পোরা ( সাঁজি) নিয়ে। বাড়ির অন্যান্য ঘরের ছেলেমেয়েরা তা করলেও সোনাকাকা আমার বাইরে গিয়ে পড়া সহজে অনুমোদন করতেন না। সকালবেলা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টেবিল থেকে উঠাই ছিল নিষেধ। কারণ বাইরে গিয়ে পড়া হত না। মুড়ি ছিঁটিয়ে কাক আনতাম। শূন্যে দু’একটা করে মুড়ি ছুঁড়ে দিতাম আর কাকেরা ছুঁ মেরে ঠোঁটে নিত মুড়ি মাটিতে পড়ার আগেই। এতে অনেক কাক আর আমার খেলা দুইই জমে উঠত। সাথে দু’একটি শালিক দূরে কিচ মিচ কিচ করত, কাকের ভয়ে কাছে আসত না। আর এখন! শীত সকালের মিষ্টি রোদ পিঠে লাগানোর সুযোগ এবং ফুসরত কোনটাই নেই। কাক শালিক দেখা ছাড়াই দিন --- মাস--- সময় যায়।
ছোটবেলায় ঘুম থেকে উঠে শুধু মুড়ি আর শীতকালে মোয়া লাড়ু মুড়ি খেয়ে পড়তে বসতাম। শীতকালে মোয়া লাড়ু শক্ত থাকত, নরম হত না। গরমকালে নরম হয়ে যেত বলে লাড়ু মোয়া তাই খুব একটা বানাত না। পরে গরম ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম। তিলের লাড়ু, নারকেলের লাড়ু , ছাতুর লাড়ু। নারকেলের লাড়ু আবার হরেক রকমের। মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া। গুড় দিয়েও মুড়ি খাওয়া হত। অথবা খেজুরের রস দিয়ে। ঠাকুমা ও বোন (ঠাকুমার ছোট বিধবা বোন আমাদের বাড়িতেই থাকতেন, তাকে আমরা বোন ডাকতাম এবং আমাদের খুবই আদর করতেন) দাঁতের জন্য মুড়ির ছাতু, যবের ছাতু বা চালের খুদ ভেজে ছাতু করেও খেতেন।
স্কুলে টিফিন ও জল বয়ে নেয়ার রেওয়াজই ছিল । টিফিনের সময় পয়সা (টাকা নয়) দিয়ে আইসক্রীম, ছোলা বা কটকটি কিনে খেতাম। হুড়োহুড়ি করে স্কুলের টিউবওয়েল থেকে জল খেতাম। গ্লাসে নয়। একজন কল চাপত আর অন্যরা খেত। টিউবওয়েলের জলে আর্সেনিকের নাম তো দূরে থাক আইরনের কথাও শুনিনি। কাউকে ওয়াটার ফ্লাস্ক নিতে দেখিনি। বিকেলে বাড়ি এসে ভাত খাওয়া।
বৃষ্টির সাথে শিল পড়লে তা কুড়িয়ে মুঠো করে ভেতরে সুতা ভরে চাপ দিয়ে বেঁধে রাখতাম। একটু পরেই জোড়া লেগে যেত। সুতাটি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতাম। বলতাম- শিলের মোয়া। আবার চুষে চুষে খেতামও। ফ্রিজের বরফ চেখে দেখার কোন সুযোগ ছিল না। নরসিংদীতে আমাদের পরিচিত বলয়ে কারো বাড়ীতে ফ্রিজ দেখিনি। শিশুদের শিলা বৃষ্টিতে ভিজে শিল কুড়ানোর জন্য অনুমোদন দেয়ার মত বুকের পাটা আজকালের মায়েদের নেই। একালের শিশুরা সব ফার্মের মুরগীর মত লালিত পালিত হয়। যদিও আজকালের শিশুরা ফ্রিজ থেকে বরফ না মিশিয়ে ঠান্ডা পানীয় খেতে চায় না।
বৃষ্টির দিনে বাদাম, সীম বীচি, কাঁঠাল বীচি ভাজা খাওয়া হত। বেশি বৃষ্টি হলে বলত গাদলা করেছে। গাদলায় শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট হত। গাদলায় পাশের বাড়ির পঙ্খির মা ঠাকুমার কাছ থেকে চাল ধার নিতে আসত, এখনও শ্রমজীবীদের একই চিত্র, তবে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত। আশেপাশের বাড়ি (ফ্ল্যাট) থেকে গাদলায় ভুনা খিচুরি আর ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ পাই।
আমাদের টিনের চালের দুটো ঘর ছিল। একটি কাঠের দোতালায় টিনের চাল। আরেকটি চৌচালা। দোতালার বারান্দায় বসে দক্ষিণা বাতাস ও বৃষ্টি দুইই ছিল উপভোগ্য। চৌচালাটিও ছিল খুব বড়। ভেতরে দুটো রুম। প্রশস্ত বারান্দা। সিমেন্টের ওটা। ওটা মানে সিঁড়ি। তিনটি সিঁড়ি ও দুপাশে বসার জায়গা। রাতে পড়ার পর ঐখানে বসে দাদুর কাছে পরস্তাপ শুনতাম। পরস্তাপ মানে গল্প। পরস্তাপ --- পরের জীবনের উত্তাপ। সোনা কাকার ধমক না খাওয়া পর্যন্ত ঘুমুতে যেতাম না। টিনের চালের বৃষ্টির ডুঝুর মুঝুর শব্দ শুনতে শুনতে বোনের সাথে ঘুমিয়েছি। এখনও সে শব্দ শুনতে খুব মন চায়। কিন্তু টিনের চাল পাব কোথায় ? আমার শৈশবের --- কৈশোরের সেই চৌচালায় থাকার সুযোগ নেই। ঢাকায় টিনের চালে বৃষ্টির ডুঝুর মুঝুর শব্দ দূরে থাক টিনের চালের অস্তিত্বই তো নেই। টিন তো দেখি শুধু টিভির বিজ্ঞাপনে। আর বৃষ্টি হলে বদ্ধ জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখা—ছোটবেলায় বোবা সিনেমা দেখার মত।
ধাঁ ধাঁ ধরা ছিল ছোটবলোয় আরেক মজার খেলা। বন্ধুবান্ধব ও ভাইবোনদরে মধ্যে চলত এ প্রতিযোগিতা।
'একলোক হাঁটে যায়
রাস্তায় রাস্তায় চিমটি খায়'
বল তো কে? বা কি?'
উত্তর হল লাউ।
লাউ বেচার জন্য বাজার নেয়ার সময় কচি কি না তা সবাই চমিটি দিয়ে পরখ করে।
উত্তর দিতে পারল যে পক্ষ উত্তর দিতে পেরেছে সে পক্ষ ধাঁ ধাঁ দিত। উত্তর না বলতে পারা পর্যন্ত ধাঁ ধাঁ দেয়ার অধিকার অর্জন করত না।
আরেক লোক হাটে যায় দু’একটা করে থাপ্পর খায়।
বলত কি?
পাতিল। মাটির পাতিল।
মাটির পাতিল থাপ্পর দিয়ে দেখে তবে কিনে। থাপ্পরের শব্দ শুনে বুঝা যায় ভাল পোড়া হয়েছে কিনা। টিকবে কি না।
এমননি 'একলোক টুপ দিয়ে স্নান করে টুপি ভিজে না।'
মানে কি?
মানে কচু পাতা।
'হারালে খুঁজি কিন্তু পাইলে সাথে নেই না'- কি সাথে নেই না ?
পথ। পথ সাথে নেই না। অথচ হারালে খুঁজি।
'এই দেখি এই নাই/ তারা বনে বাঘ নাই'--- তারা বন হল আকাশ আর বাঘ হল বিজলি চমকানো। এই দেখি এই নাই।
আজকালকার অন্তঃক্ষরীর চেয়ে কম আনন্দদায়ক ---- মেধার খেলা ছিল না।
গীতা দাস ঢাকা ১৭ চৈত্র,১৪১৪/৩১ মার্চ,২০০৮ [email protected]