তখন ও এখন
গীতা দাস
(৫)
আমাদের সময় গ্রাম বাংলার লোকজ জীবন ছিল সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে । ধর্মীয় অনুষ্ঠান ধর্ম নির্বিশেষে আর্থিক স্বচ্ছলতার নিয়ামক ছিল । উদাহরণস্বরূপ --- ইয়দ আলী গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত গৃহস্থ। হিন্দুদের বারো মাসের তেরো পার্বণে খুব খুশি। কারণ পূজা পার্বণে দুধের চাহিদা বাড়ে। দুধ বেচে দামও বেশি পায়। আর গাভী প্রতিপালন করে দুধ বেচার টাকা তার সংসারের একটি বড় আয়ের উৎস।
গোঁসাই দাসকে ঈদ আসলে প্রচুর পরিশ্রম করতে হত। পরিশ্রম অবশ্য গায়ে লাগত না। কারণ পয়সাও আসত। ধোয়া ও ইস্ত্রি করা কাপড় পড়ার জন্যে আশে পাশের সবাই তার দোকানের শরণাপন্ন হত। তার আফসোস ঈদ মাত্র বছরে দু’বার কেন?
তখন পূজায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় ছাড় দিয়ে বাজনা বাজানোর হুকুম আসত না। অবশ্য হিন্দু মুসলিম পাড়া আলাদা ছিল।
সারা গ্রামের নারী পুরুষই সবাই ছিল কাকা, চাচা, ভাই, ভাবী, দাদা, বৌদি,কাকী চাচী ইত্যাদি সর্ম্পকে আবদ্ধ।
এখন হিন্দু পাড়ার ভিতরে প্রচুর মুসলিম পরিবারের বসতি গড়ে উঠেছে। তবে রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় সংখ্যাগুরু (মুসলিম) লোকালয়ে রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় সংখ্যালঘু (হিন্দু) একটি পরিবারও বসতি স্থাপনের সাহস পায়নি। অথচ রাষ্ট্রীয় সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী একটি একক পরিবারও রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘু লোকালয়ে শুধু বসতি স্থাপন করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, আধিপত্য বিস্তার --- বেদখলদারির অপতৎপরতায় মেতে উঠছে। এভাবে বহু ধর্মীয়, জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুর বাস্তভিটা থেকে উৎখাত হবার ভুরি ভুরি কাহিনী রয়েছে।
গ্রামে বিচার সালিশ বসলে দেখতাম ধূপ দীপ জ্বালিয়ে দিতেন মহিলারা। প্রবাদ ছিল --- দশজন যেখানে পরমেশ্বর সেখানে। দশজন মানে বেশির ভাগ লোক যেখানে পরমেশ্বর সেখানে। পরম ঈশ্বর ---- মানে ভগবান। বেশির ভাগ জনগোষ্ঠির মধ্যে --- বৃহত্তর জনগনের মধ্যেই ভগবানের প্রতিকৃতি ---- তাদের মতামতেই ভগবানের ইচ্ছার প্রতিফলন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি কি গভীরতম শ্রদ্ধাবোধ! ঐসব বিচার সালিশে বেশির ভাগ লোক যে মতামত দিত তা - ই রায় হিসেবে বিবেচিত হত। তাই তো গণতন্ত্রের প্রতি লোকায়ত জীবনের বিশ্বাসী উচ্চারণ ---- দশজন যেখানে পরমেশ্বর সেখানে। মাটির মানুষকে ভগবান ভাবতে কোন দ্বিধা বা সংকোচ ছিল না। ছিল না কোন ধর্মীয় গোঁড়ামি। এজন্যে কেউ ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে দোষারোপও করেনি।
তবে গ্রাম্য কোন বিচার সালিশে কোন নারীর বসার অধিকার তখন ছিল না, বিচারক হিসেবেও নয় --- অপরাধী হিসেবেও নয়। নারী অপরাধী হলেও উঠানের বিচার সালিশের বলয়ের বাইরে ঘরের কোন এক কোনায় বসে থাকত। নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত বলে জানতে পারি যে এখন সংখ্যায় কম হলেও নারীরা গ্রাম্য কোন কোন বিচার সালিশে বিচারকদের সাথে বসার অধিকারটুকু আদায় করতে পারছে।
আমাদের হিন্দুপাড়ার বিচারে মুসলিম পাড়া থেকে সব সময়ই আবু তাহের মিঞা --- বাবার বন্ধু – আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় তাবু কাকা থাকতেন। ঊনার কথা সবাই মানত। তবে উনি কখনো একা রায় দিতেন না। গ্রাম্য সালিশে রায় দেয়ার আগে বেশ বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা হত। সাক্ষী প্রমাণ বেশ বলিষ্ঠ্য হতে হত। যুক্তি থাকতে হত।
‘যা না দেখি নিজ নয়নে তা বিশ্বাস করি না গুরুর বচনে’। লোকায়ত দর্শনে যুক্তিবাদের স্বপক্ষে এই সাহসী বিশ্বাস বিবেচনায় নেয়া হত রায়ের বেলায়। বৈজ্ঞানিক তথা শক্ত তথ্য প্রমাণ ছাড়া কোন কিছুতে বিশ্বাস করতে নারাজ ----সে কথা গুরু বললেও।
এখন প্রায়ই শুনি অমুক তমুকের নামে থানায় মামলা করেছে। তমুকের ছেলে অমুকের ভয়ে বাড়িতে থাকতে পারছে না। গ্রামের দশজনে এখন আর আস্থা নেই।
আগের টোল ও মক্তবের খোলামেলা শিক্ষাদানের সাথে আজকের ধর্মীয় শিক্ষার পরিবেশ মিলানো কষ্টকর। আর শহুরে জীবনের ও লেবেল এবং এ লেবেল শিক্ষার্থীদের দ্বারা ভবিষ্যত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, দেশ, সমাজ,অর্থনীতি, রাজনীতি পরিচালনার চিত্রটি কল্পনা করে তো তাদের কথায় কথায় বিস্ময়কর অনুভূতি প্রকাশের ভাষা আমাকেও ব্যবহার করে বলতে হচ্ছে --- হাউ !!!!
বৃহত্তর জনগোষ্ঠির দোহাই দিয়ে সমাজকে ধর্মীয়করণের অপপ্রয়াস বাংলার লৌকিক যাপিত জীবন সমর্থন করত না। আর তাই লোক চেতনা আরোপিত মতবাদকে প্রত্যাখান করেই আসছিল।
তারা বিশ্বাস করত ---
‘জিজ্ঞেস কর গুরু গোঁসাইর কাছে
এক গাছের গোটানি লাগে আরেক গাছে’।
অর্থাৎ বাইরের ইজম, নীতি, মতবাদ, জীবনাচার, সংস্কৃতি চর্চা, খাদ্যাভ্যাস এদেশীয় জীবন যাপনের সাথে খাপ খায় না। এক গাছের গোটা অর্থাৎ ফল যেমন অন্য কোন গাছে লাগে না তেমনি চাপিয়ে দেয়া ভিনদেশী সংস্কৃতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা এদেশে লাগসই নয়। এখন এসবের ভারে ন্যূব্জ হয়ে যাচ্ছে লোকজ জীবন। তখন এসব প্রত্যাখান করার মত গ্রামে সাহসী --- শক্তিশালী ---- মুরুব্বী ছিল। নেতা ছিল। এখন! সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই।
দাদুর অনেক গল্পের বিষয় ছিল সর্বজনীন ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী। উনি বলতেন – হিন্দু মুসলিম – সবাই একজনকেই ডাকে। শুধু যে যার মত করে। যে যেমন----তেমন করেই বিশ্বাস করে। এ প্রসঙ্গে দাদুর বলা একটা গল্প ছিল --- ‘গ্রামের মেঠো পথের পাশে একটি বড় গাছে বসে একটি পাখি আপন মনে ডাকছে। ঐ গাছের নীচ দিয়ে গ্রামে যে সুটকেস রঙ করে সে রঙওয়ালা যাচ্ছে, এক মাছওয়ালা যাচ্ছে, এক পেঁয়াজ রসুন বিক্রেতা, এক বাউল, এক বৈষ্ণবী, এক গরু বেপারী, এক সুতার (কাঠ মিস্ত্রি) যাচ্ছে। প্রত্যেকে নিজের মত করে পাখিটির ডাকের ব্যাখ্যা দিচ্ছে---
রঙওয়ালার মতে পাখিটি বলছে --- লাল নীল সাদা
মাছওয়ালার মতে পাখিটি বলছে --- রুই কাতল ভেদা
পেঁয়াজ রসুন বিক্রেতার মতে পাখিটি বলছে --- পেঁয়াজ রসুন আদা
বাউলের মতে পাখিটি বলছে --- আল্লাহ হরি খোদা
বৈষ্ণবীর মতে পাখিটি বলছে --- হরে কৃষ্ণ রাধা
গরু বেপারীর মতে পাখিটি বলছে --- গরু ঘোড়া গাধা
সুতারের (কাঠ মিস্ত্রি) মতে পাখিটি বলছে---- হাতুরি বাটাল রান্দা (রান্দা হল কাঠ চাঁছার যন্ত্র)
দাদুর এসব গল্প – বাবা কাকাদের হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সামাজিক বলয়ের পরিধি – আমার গ্রামের মানুষের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ও আচার- আচরণ আমাদের বেড়ে উঠাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। আমার ভাইবোনদের মধ্যে অবচেতনভাবেও কখনোই সাম্প্রদায়িক চেতনা জেগে উঠেনি। তাই তো অনেক সময় রক্তীয়দের চেয়ে আত্মীয়দের (আত্মার সম্পর্ক যাদের সাথে) জন্য ধর্ম নির্বিশেষে টান অনুভব করি।
বাংলাদেশের মানুষের যাপিত জীবন ও জীবিকা --- জীবনাচার --- সংস্কৃতি --- সভ্যতা সবই যে এ দেশের মাটি ও জলবায়ুর সাথে সম্পৃক্ত ---- গ্রাম নির্ভর, তা আমরা প্রায়শঃই ভুলে যাই। বিস্মৃত হই নিজের শিকড়। বিশ্বায়নের যুগে ---- আধুনিকায়নের জোয়ারের প্রবল স্রোতের মুখে গ্রামীণ সংস্কৃতি ---লোকজ জীবন প্রণালী নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের সমুজ্জ্বলতা দিন দিন হারাচ্ছে। স্বাতন্ত্র্যবোধের গভীরতায় ও ব্যাপকতায় গৌরবান্বিত আমাদের জীবনবোধ --- জীবনাচার বদলে যাচ্ছে। আমরা কোন দিকে যাছি?
গীতা দাস ঢাকা ২২ চৈত্র ১৪১৪/৫ এপ্রিল২০০৮ [email protected]