তখন ও এখন
গীতা দাস
(৮)
আমাদের ছোটবেলায় চিঠি সংরক্ষণের একটি বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। মোটা তারে বা গুনায় কাঠের টুকরা লাগিয়ে এটি বানানো। চিঠি মোটা তারে বা গুনায় গেঁথে রাখলে কাঠের টূকরায় তা আটকে থাকত। এটি সাধারনত বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখত। শখের ডাক টিকিট সংগ্রহের সুযোগ বা ধারণা কোনটাই ছিল না। ঐ সব চিঠির ডাক টিকিটিই মাঝে মাঝে দেখতাম।
এক যুগের বেশি হাতের লেখা কোন ব্যক্তিগত চিঠি পাই না। লিখিও না। বিয়ের নিমন্ত্রণ আসলে কার্ডটি দু’একবার দেখে— ডায়েরীতে তারিখটি লিখে --- অথবা নিমন্ত্রণের দিনটি চলে যাবার পর আর্বজনার সাথে ফেলে দেই। ঘর টিপটপ রাখি। এখন চিঠির বিকল্প ই-মেইল আর মোবাইল ফোন। ই-মেইল এর ইনবক্সে কি আর হাতের লেখা জমানো চিঠির আবেগ ---উপলব্ধি ----অনূভূতি পাওয়া যায়!
বাসার গ্যাসের চুলায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্বয়ংক্রিয় চুলা সুইস দিলেই নীচে আগুন ধরে যায়। গ্যাসের চুলার মিস্ত্রি চুলা ঠিক করার সময় একটু নেকড়া চাইল। নেকড়া মানে নরম কাপড়। নেকড়া চিকন তারে পেঁচিয়ে চুলার ভিতরের পরিস্কার করবে। তুলায় হবে না। আঁশ ভিতরে থেকে যেতে পারে। আবিষ্কার করলাম ঘরে কোন নেকড়া নেই। নিজের কাছেও এটি অবাক তথ্যই বটে।
ছোটবেলায় একটু কেটে গেলেই গাঁদা ফুলের পাতা ঘষে লাগিয়ে নেকড়া দিয়ে বেঁধে রাখতাম। নেকড়াকে তেনাও বলতাম।এখন! ব্যান্ডেজ করি। ভাল। আধুনিক হয়েছি।
আমার ছোটবেলায় বিভিন্ন পুরান ---- নরম ---- ছেঁড়া কাপড়ের টুকরা অর্থাৎ নেকড়া, ছেঁড়া শাড়ির পাড় ইত্যাদি একটা বুঁচকায় থাকত এক জায়গায়।
আরও উপলব্ধি হল – এখন জামা কাপড়, শাড়ি ছিঁড়ে না। নরমও হয় না। এর আগেই বাতিল হয়। বছরে কমপক্ষে একবার বাছাই করে লোকজনকে দিয়ে দেই। আগেও আমার মা আমাদের জামা অন্যকে দিতেন, তবে তা নিয়মমাফিক নয়। হঠাৎ কেউ চাইতে এলে দিয়ে দিতেন।
আগে মা কাকিমাদের শাড়ি না ছিঁড়লেও নরম হত। কাঁথা সেলাই হত সে সব শাড়িতে। কাঁথার মাপের পর আশপাশের অংশ থাকত নেকড়া হিসেবে। কাঁথা সেলাই করার সূতা কিন্তু শাড়ির পাড় থেকেই তুলে নিত।
ছোটবেলায় আরও দেখতাম দাদুর (পুরুষদের) বা বুড়োদের সাদা ধূতি কাপড় দিয়ে সলতে পাকানো হত সন্ধ্যে প্রদীপের জন্য। নতুন পাতিলের উলটো পিঠে বা ঊরুতে সলতে পাকানো হত। সলতেগুলো রাখা হত সূতার নকশি করা বাঁশের তৈরি আট দশ ইঞ্চি দুটো খাপে। তখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় ধূপতিতে ধূপ ও পিতলের মুচিতে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো ছিল প্রাত্যহিক দায়িত্ব। এখন অবশ্য সন্ধ্যায় ধূপতিতে ধূপ না জ্বালালেও ধূপকাঠি জ্বালাই। প্রথম প্রথম ঢাকায় এসে ধূপতিতেই ধূপ জ্বালাতাম। কাপড়-চোপড় ধূপের ধূয়ায় নোংরা হয়ে যায় বলে আর ধূপ জ্বালাই না। যদিও ধূপের গন্ধ আমার খু - উ - ব পছন্দ। মাতাল করে দেয়। নাগরিক জীবনের সীমাবদ্ধতা সে মাতাল সুখটুক কেড়ে নিয়েছে বৈ কি।
এখন ছোট ছেলেমেয়েরা সাধারণত সোয়েটার পড়ে। চাদর গায়ে দেয়ার চিত্র সচরাচর দেখা যায় না। আমাদের সময় সোয়েটার গায়ে দিয়ে বিদ্যালয়ে গেলেও বাড়িতে চাদরই গায়ে দিতাম। ছেলেদের ও মেয়েদের চাদর পরার নমুনা বা ধরণেও ছিল পাথর্ক্য। মেয়েরা চাদরটির একটি কোণা অন্য কাঁধে ঝুলিয়ে পরত এবং এখনও এভাবেই পড়ে। আর পুরুষরা দুই কাঁধেই চাদর তুলে রাখে। দুই কাঁধেই চাদরের মাথা উঠিয়ে রাখলে হাত দুটো মুক্ত থাকে। পুরুষদের হাত তো মুক্তই রাখতে হয়। তবে আমি ছেলেদের মত করেই চাদর পড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। ঠাকুরমারা আবার দুই কাঁধের চাদরের মাথা বেঁধে দিতেন। এতে চাদর গায়ে দিয়েও দৌড়াদৌড়ি করা যেত।
শীতকালে অস্বচ্ছল পরিবারে মায়েদের শাড়িই ভাঁজ করে বাচ্চাদের পড়িয়ে দিত।
এখনো আমি দুই হাত মুক্ত রাখতে পছন্দ করি। আমার এ্যাজমাটিক সমস্যা আছে। যে জন্য আমি শীতকালে মোজা ও পায়ের আঙ্গুল ঢেকে থাকে এমন জুতা পড়ি। বাংলাদেশে শাড়ির সাথে সচরাচর কোট না পড়লেও আমি পড়ি। চাদর টানাটানির ঝামেলা নেই। মুক্তভাবে থাকতে পারি। স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি। কোট পড়লে পকেট ব্যবহার করতে পারি। এক কথায় কোট পরা আমি পছন্দ করি। এজন্য আমার বেশ কয়টি কোট রয়েছে। দেশের বাইরে গেলে পছন্দ মত পেলে বোঝা হলেও কোট কিনে ফেলি। শীতকালে পা ও আঙ্গুল ঢেকে থাকে এমন জুতা পরে আরাম অনুভব করি। যাহোক, আমার কোট পরা যে আমার এক উর্ধ্বতন সহকর্মীর পছন্দ নয় তা আমি বুঝি। যেদিনই আমি কোট পরি সেদিনই উনি বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেন। যেমন --- আজকে কি মাইনাস টেম্পারেচার? আপনার পোশাক তো তাই বলছে।
আমি গায়ে মাখি না। হেসে উত্তর দেই – ঠিক তাই? আপনার অবস্থাও দেখছি আমার চেয়েও বেশি। কারণ আপনি কোটের সাথে টাই ও পড়েছেন।
একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতেও নারীর পোশাক নিয়ে মন্তব্যের বাড়াবাড়ি। কথার ঝাড়াঝাড়ি।
মাটির খুড়া বা কাঠের চাড়িতে ভাতের মার গলানোর জন্য টাক দেয়ার দৃশ্য তো এখন আর নিজের ঘরেও দেখি না। এখন চাল মেপে জল মেপে রান্না হয় ভাত। তখন সুতি কাপড়ে তো গলানো ভাতের মার দিয়েই শুকানোর পর ইস্ত্রি করা হত। ভাতের মার গৃহপালিত গরুর জন্য প্রধানতম পানীয়ও ছিল বটে।
আমাদের একটি ইস্ত্রি ছিল যার ভিতরে লাকরির কয়লা ভরে তালের পাখায় বাতাস করে করে তা গরম করা হত। সেই তাপে আমার কাকারা আমাদের সবার কাপড় চোপড় ইস্ত্রি করে দিতেন। আমাদের দিত বাতাস করতে। সবার বলতে আমাদের ছোটদের ও মা কাকিমাদের শাড়ি। কালেভদ্রে বাবা কাকাদের। তাদের পাঞ্জাবী, শার্ট - প্যান্ট সাধারণত ধোপা বাড়ি থেকেই ধূইয়ে ইস্ত্রি করিয়ে আনা হত।
পুরুষদের কাপড় চোপড় ধুপ দোরস্ত না হলে কী চলে? তবে ঐ সময় যেমন কড়া মারের ইস্ত্রি করা কাপড় পড়তে দেখতাম এখন আর তেমনটির চল দেখি না।
সংগ্রামে ঐ ইস্ত্রিটি লুট হয়ে যাবার পর যে ইস্ত্রি কেনা হয়েছিল ঐটি স্টোভে বসিয়ে গরম করে কাপড় চোপড় ইস্ত্রি করা হত। পরবর্তীতে তো বৈদ্যুতিক ইস্ত্রিই চলে এসেছে।
অনেককে দেখতাম রাতে বালিশের নিচে কাপড় ভাঁজ করে রেখে ইস্ত্রি করা সেরে ফেলতেন। তবুও ইস্ত্রি তো ! হায়রে ফ্যাশন!
এখন কিছু ছেলেদের পাঞ্জাবীর সাথে কাঁধে ওড়না আর গলায় সূতার সাথে একটা কিছু ঝুলাতে দেখি। কোন কোন ছেলে ঠোঁটে রঙের কাঠিও ছোঁয়ায় বৈ কি। আগে!ছোটবেলায় অনেক মহিলাদের লিপষ্টিকের বিকল্প হিসেবে একটু সিঁদুর ঠোঁটে বুলিয়ে নিতে দেখেছি। পয়সার অভাবে তো ফ্যাশন বাদ দেয়া যায় না।
গ্রামে লিপিষ্টিক,পাউডার চুড়ি নিয়ে ফেরিওয়ালা আসলে ভিড় লেগে যেত, তবে কেনা হত সে তুলনায় কম। বিনিময় মূল্য শুধু টাকা নয় --- চাল, ধান এসবও সাদরেই ফেরিওয়ালারা নিত। আর বেদেনিরা শুধুই চুড়ি নিয়ে আসত। আমাদের নরসিংদী বাজারেও (শহর নয় তখন শহর বলতে যা বুঝায় তা ছিল না) কসমেটিকসের এত বৈচিত্র্যময় সম্ভার পাওয়া যেত না। এখন তো শুধু নেইল পালিশ আর লিপিষ্টিকের জন্যই অনেক দোকানের একটা অংশ বরাদ্ধ।
গ্রামের মহিলারা গলা খালি রাখত না। সধবা মহিলাদের খালি গলা অলুক্ষুণে বলে ধারণা ছিল। সোনা হোক, রুপা হোক, সুতা হোক পড়ে থাকত। তখন শুধু পুরুষদের মধ্যে অবস্থাপন্ন নতুন জামাইদের আর খুবই সৌখিন পুরুষদের গলায় সোনার চেন পরতে দেখেছি।
সময়ের বিবর্তনে কোনটা সংস্কার আবার কোনটা ফ্যাশন। সংস্কারই ফ্যাশন হয়ে ফিরে আসে অথবা ফ্যাশনই সংস্কারে পরিণত হয়।
ঢাকা
১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪১৫/১৫ মে , ২০০৮