তখন ও এখন
গীতা দাস
(৯)
ছোটবেলায় সুর করে গাইতে হত –
পাকিস্তান জিন্দাবাদ
পাকিস্তান জিন্দাবাদ
পাকিস্তান জিন্দাবাদ
জিন্দাবাদ
আমরা কয়জন এর প্যারোডি গাইতাম ----
পাপীর স্থান জিংলার বাঁশ
পাপীর স্থান জিংলার বাঁশ
পাপীর স্থান জিংলার বাঁশ
জিংলার বাঁশ
জিংলার বাঁশ মানে চিকন বাঁশ । আশা করি এর অর্থের জন্য ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
পাকিস্তান জন্ম থেকেই জ্বলছে। কিছু জ্ঞান পাপী, বিলাসী ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতাদের পাপের প্রভাবে পাপীর স্থানেই পরিণত হয়েছিল পাকিস্তান। এখনও কি এর চেয়ে উতরাতে পেরেছে ? বালুচরা তো এখনও ইসলামাবাদ সরকারের প্রকট বৈষম্যের শিকার।
পাকিস্তান ভ্রমণের জন্য ভিসা পাওয়াও এখন এক দুর্লভ বিষয়। বর্হিবিশ্বের কাছে নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা।
পাকিস্তানের জনগণের কিছু বিষয়ে এখনও মোহাচ্ছন্নতা রয়েছে। এ মোহাচ্ছন্নতায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে নৈশ প্রহরী পর্যন্ত আক্রান্ত।
পাকিস্তানের সিন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব উইমেন ডেভলপমেণ্ট স্টাডিস আয়োজিত ২১ মে ২০০৮ জেন্ডার মেইনষ্ট্রিমিং(Gender Mainstreaming)বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে আমার অংশগ্রহণ করার সুবাদে যে অভিজ্ঞতা এতে মনে হয়েছে ভুট্টো পরিবার বিশেষ করে ‘মহতারমা’ বেনঞ্জীর ভুট্টো তাদের দেবী। জেন্ডার মেইনষ্ট্রিমিং বিষয়ে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের ঊদ্বোধনী ছিল বেনঞ্জীর ভুট্টোর বায়োগ্রাফি থেকে পাঠ সহ তার স্তুতি বন্দনায় ভরপুর।
আমরা পাকিস্তান আমলে কোটিপতি বাইশ পরিবারের কথা জানতাম। তারা শুধু সম্পদশালীই ছিল না, তাদের প্রভাব ছিল সর্বত্র। এখনও পাকিস্তানীরা খানদানের ভক্ত। পরিবারতন্ত্রের মোহে আচ্ছন্ন যা রাজতন্ত্রেরই আধুনিক সংস্করণ। নৈশ প্রহরীও মনে করে বেনঞ্জীর তনয় বিলওয়াল দেবী পুত্র। জন্মসূত্রেই সে রাজ্য ভার গ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। উল্লেখ্য যে, ভুট্টো পরিবারের বসবাস সিন্ধ প্রদেশে।
আমার দেশও কি নেতা পরিবারের উত্তরাধিকারের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে?
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দু’এক বছর পরের কথা। আমাদের গ্রামের এক বৃদ্ধ বলতেন --- বৃটিশরা করেছে শাসন, পাকিস্তানীরা করেছে শোষণ আর শেখ মুজিব দেয় শুধু ভাষণ। শাসন বলতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো ব্যাখ্যাই দিতেন। শাসন বলতে সুশাসন – আইনের শাসন এবং শাসকের ভূমিকাও বুঝাতেন। গ্রামের অনেক বয়োজ্যেষ্ঠদেরই দেখতাম বৃটিশদের কিছু দোষের সাথে অনেক গুণের কথা বলতেন। পাকিস্তানীদের শোষণ ছিল সর্বজনস্বীকৃত সত্য। আর শেখ মুজিবের ভাষণে উদ্ধুদ্ধ হয়ে জনগণ স্বাধীনতা আনলেও চুয়াত্তুরের খাদ্যাভাব তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধায় একটু হলেও টান পড়েছিল বৈ কি !
আর এখন! এখন কী বলতেন তখনকার বয়োজ্যেষ্ঠরা! শাসন --- শোষণ আর ভাষণের পর এসেছে তোষণ। তোষণের নীতিতে চলছে দেশ। নেতা তোষণ । নেত্রী তোষণ। সামরিক শাসক তোষণ। নেতা নেত্রীর উত্তরাধিকারদের তোষণ। ভারত তোষণ। আমেরিকা তোষণ। ধর্ম তোষণ। বর্ম তোষণ। অকর্ম তোষণ। কুকর্ম তোষণ। তোষণের জ্বালায় ঝালাপালা এখনকার জীবন যাপন।
তখনকার গ্রাম আর এখনকার গ্রামে অনেক পার্থক্য রয়েছে। গ্রামে কিনে খাওয়া মানে অস্বচ্ছল অবস্থা বুঝাত। কিনে খাওয়া মানে চাল কিনে খাওয়া। কৃষি নির্ভর সমাজে নিজের খেতের ধানে বছর না খেতে পারা মানেই দুঃশ্চিন্তার কারণ। ছেলেমেয়ের বিয়ের পাত্রপাত্রী খোঁজ খবর নেয়ার মধ্যে একটা মূল বিষয় ছিল পাত্র বা পাত্রীর পরিবার ধান কেমন পায় ? ধানী জমি আর্থিক মানদণ্ডের নিয়ামক ছিল। মর্যাদার পরিচায়ক ছিল। মোটা ভাত মোটা কাপড়ে সন্তূষ্ট ছিল গ্রামীণ জনগোষ্ঠী।
এখন পরিবারের কেউ বিদেশ আছে কি না তা জানার বিষয়। গ্রামের মানুষও এখন আধুনিক জীবন যাপনের উপকরণ সংগ্রহে তৎপর। বিষয়টিকে নিন্দনীয় হিসেবে দেখার তো প্রশ্নই উঠে না, বরং খুশি হই এই ভেবে যে শহরের মত গ্রামেও আধুনিক জীবন যাপনের সরঞ্জামাদির ব্যবহার করার মত সাধ, সুযোগ ও সাধ্য সবই আছে। বিনোদনের জন্য টিভি, খাবার সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ রয়েছে। বৈদ্যুতিক বাতির আলোর খল খলকানিতে অমাবস্যার রাতেও চোরের উপদ্রব নেই। আমার আকাঙ্ক্ষা এ সবের ব্যবহার থাকবে, মুঠোফোন বাজবে, তবে কীর্তন পুথিঁ পাঠও চলবে। স্যাটেলাইটের বদৌলতে হিন্দি গানের আসর বসাবে না। হিন্দি বাণিজ্যিক, রোমান্টিক, ফ্যান্টাসী ফিল্মের কাহিনীর চেয়ে বুড়োদাদুর পরস্তাপের মর্মকথা হৃদয়ঙ্গম যে বেশি প্রয়োজন।
ছোটবেলায় কৃষি প্রধান বাংলাদেশ আর নদীমাতৃক বাংলাদেশ নামের রচনা শিখেছি। ছোটবেলায় পড়া সেই সবুজ বিপ্লব আর কৃষি বিপ্লব রচনা এখনকার ছোটদের শিখতে হয় না। এখন শিখে টেলিভিশনের প্রয়োজনীয়তা। মুক্তবাজার অথর্নীতি। এখন কৃষিতে বাংলাদেশ ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ অবস্থায় রয়েছে। আজকের খাদ্যসংকটের সময়ে জোর দিয়ে মনে হয় আবার চাই কৃষি বিপ্লব।
আরেকটা বিষয় চোখে পড়ার মত। আগে গ্রামে প্রচুর ছনের ঘর দেখা যেত। এখন আর তা দেখা যায় না। শুধু মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্যই নয়। ছন এখন আর সহজলভ্য নয়। টিনের সাথে তুলনামূলকভাবে সস্তাও নয়। কষ্টে সৃষ্টে মাথার উপর দুটো টিন দিতে পারলে নিশ্চিন্ত বাস। ছনের মত তিন চার বছর পর পর ছাইতে হয় না।
তবে এখন ছনের ছাউনি দেখি ডুপ্লেক্স বাড়ির ছাদে একটু বসার জায়গা তৈরিতে বা টিভির নাটকে দেখি কোন রেস্টুরেন্টের লনে বসার জায়াগায় ছোট্ট ছনের ছাউনি। সৌখিনতার জায়াগায় ছনের ব্যবহার বাহারী লাগে বৈকি!
এখন কোন পোড়ামুখীর মুখ পোড়ার জন্য ছন পায় কোথায়? আগে তো কোন নাদুস নুদুস শিশু অসুস্থ হলে বা গায়ে গরমে ফুসকা পড়লেও ভাবা হত মুখ লেগেছে কোন পোড়ামুখীর। পোড়ামুখ মানে নিশ্চিত পোড়ামুখীর। কোন নারীর। পুরুষের নয়। ইউরোপের ও ভারতের ডাইনী ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় কি? তখন আবার কোন ছনের ঘরের তিন কোণা থেকে একটু একটু ছন নিয়ে ভর সন্ধ্যায় তেমাথার রাস্থায় গিয়ে পোড়ানো হত। পোড়ামুখীর মুখে আগুন দেয়া হত প্রতিকীভাবে। এখন ? পোড়ামুখীর মুখ ওষুধে পোড়ে।
তবে পোড়ামুখীর মত সব অমঙ্গলের সাথে নারীকে দায়ী করার রেওয়াজ আজকের অত্যাধুনিক যুগেও রয়েছে। যে জন্য সিডোর নামের সাইক্লোনের আকৃতি নারীর চোখের মত। অন্যটির নাম নার্গিস এবং অত্যাধুনিক দেশের সাইক্লোনের নামও ক্যাটরিনা। সবই নারীর নামে নাম।
১৯৭১ সালে গ্রাম ছাড়ায়ে রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায়নি। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাঙা মাটি আমার মন ভুলাতে পারেনি। কেমন জানি রুক্ষ, রসহীন, কষ কষ মনে হয়েছিল। অথচ রেলগাড়িতে ঢাকা থেকে নরসিংদী যাবার পথে পুবাইলের রাঙা মাটির পথ আমাকে টানত। মন ভুলাত। অনেক বড়বেলায় ঐ পথ দিয়ে বহুবার গেছি। বার বার গেছি। ক্লান্ত হইনি। ঐ পথেই শিক্ষকতা করতে গেছি কয়ের উচ্চ বিদ্যালয়ে। তখন কিন্তু গ্রাম ছাড়ায়ে রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলিয়েছে। শক্তি যুগিয়েছে বাবার অবর্তমানে সংসারের হাল ধরতে।
আরও মনে হয়েছে দেশপ্রেম এক মহানতম উপলব্ধি। নিজের ভূখণ্ডের মাটির সাথে রাবীন্দ্রিক আমেজ যতটা একাকার হয় ভিন দেশের সাথে তা হয় না। এ ও হয়ত আমার চিন্তা চেতনার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু কী করব! নিজস্বতা ছাড়া, নিজ বলয় ছাড়া যে মনের গভীরতম প্রদেশে আলোড়ন তোলে না। উপলব্ধি পরিপক্কভাবে সাড়া দেয় না।
গীতা দাস
ঢাকা
১৩জ্যৈষ্ঠ, ১৪১৫/ ২৭ মে, ২০০৮