প্রকাশিত বই এর অপ্রকাশিত কথা
প্রদীপ দেব
১
প্রত্যেক সৃষ্টির পেছনেই কিছু না কিছু ভূমিকা থাকে। কখনো কখনো হয়তো সেই ভূমিকা প্রকাশিত হয়, কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই তা অপ্রকাশিত থেকে যায়। লেখকের সযত্নে অযত্নে বেড়ে ওঠা সৃষ্টিগুলো যখন ‘বই’ আকারে প্রকাশিত হবার অপেক্ষায় থাকে তখন বই এর শুরুতে একটা ‘ভূমিকা’ জুড়ে দেয়া হয় অনেক সময়। এই ভূমিকায় বই সম্পর্কে বা বইটার ‘বই’ হয়ে ওঠার কিছু নেপথ্য কারণ বর্ণনা করা হয়। তার সাথে এ প্রক্রিয়ার সহযোগীদের ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা ইত্যাদি জানানো হয়। কিন্তু সৃষ্টির প্রসব যন্ত্রণাটুকু সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়। নতুন সৃষ্টিকে আলোর মুখ দেখাবার আনন্দটুকু রেখে কষ্টগুলোকে চেপে রেখে দেয়া হয় মনের ভেতর। আমার নিজেরও সামান্য বেদনা আছে। বই প্রকাশের বেদনা। দিব্যি ভুলে ছিলাম। কিন্তু অভিজিৎ রায় তাঁর ‘বইমেলায় আমাদের লেখা ক’টি বই’ লিখে মনে করিয়ে দিলেন যে আমারও ‘কিছু কহিবার আছে জনাব, যদি অভয় দেন তো নিবেদন করি’।
২
লেখালেখি বিষয়ে ইমদাদুল হক মিলনের এক লেখায় পড়েছিলাম তিনি নাকি ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার লোভেই লেখা প্রকাশ করেন। আর নিজের লেখা প্রকাশিত হয়ে যাবার পর ওটা আর পড়ে দেখেন না। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখতে আমারও খারাপ লাগে না। বলা যায় লেখকের খাতায় নাম লেখানোর একটা লোভ তো ছিলই। সে লোভ আরো বেড়ে যায় সাপ্তাহিক ‘যায় যায় দিন’ এর কল্যাণে। সেখানে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয় এবং মজার ব্যাপার হলো সেখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সম্মানীবাবদ কিছু টাকাও পাওয়া যায়। তখন লেখালেখির ব্যাপারটাকে বেশ মজার মনে হতো। ১৯৯৫ সালের বইমেলায় যায় যায় দিন ভালোবাসা সংকলন বের করে। বইটিতে আমারও একটি লেখা স্থান পায়। অনেক লেখকের ভীড়ে আমার লেখাটি আমি ছাড়া আর কারো নজরে পড়ার কথা নয়। কিন্তু নিজের একটি লেখা একটি বইতে স্থান পেয়েছে - অথচ সেটা কারো নজরে পড়ছে না। ব্যাপারটা মেনে নেয়া খুব কষ্টকর। সে কষ্ট কিছুটা কমাবার লক্ষ্যে বইটির কয়েকটি কপি কিনে কয়েকজনকে উপহার দিলাম। লজ্জার কারণে বলতে পারিনি যে ওটাতে আমার একটা রচনা আছে। তারপর কয়েকদিন ধরে অনেক আশা নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। যদি কিছু বলে। জিজ্ঞেস করি বইয়ের রচনাগুলো কেমন। উত্তর পাই একটি মাত্র শব্দে, ‘ভালো’। শেষে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করি,
- আমার লেখাটি কেমন লেগেছে?
- তোমার লেখা ছিলো নাকি সেখানে? খেয়াল করিনি তো।
৩
১৯৯৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এলাম পড়াশোনা করার জন্য। বিশাল দেশটির কয়েকটি রাজ্য ঘুরে দেখার সুযোগ হলো পরবর্তী কয়েক বছর ধরে। কী দেখলাম, কেমন দেখলাম লিখে জানালাম আমার প্রিয়জনদের। নিজেদের বেড়ালকেও বাঘ মনে হয় অনেক সময়। আমার লেখাগুলোও সেরকম পাত্তা পেয়ে গেলো আপনজনদের কাছে। তারা বললো - বই বের কর। কর্ বললেই যদি করা যেতো। উপাসনা ধর্মে বিশ্বাস থাকলে হয়তো কিছুটা লাভ হতো। বিশ্বাস করতে পারতাম যে, “তিনি বলিলেন - হও। আর সাথে সাথে সব হইয়া গেল”। নানা রকম ঝামেলায় আসলে কিছুই হলো না। ২০০৩ এ পাড়ি দিলাম আটলান্টিক। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করার সুবাদে কনফারেন্স নামক কলা বেচতে বেচতে আমেরিকার অনেকগুলো রাজ্যের রথ দেখা হয়ে গেলো। দেখার সাথে পাল্লা দিয়ে লেখা আর এগোয় না। ভাবনাগুলো মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যেতে থাকে - কোন একদিন লেখা হয়ে যাবার ক্ষীণ আশায়। ২০০৪ সালে মনে হলো অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি স্টেটের ভ্রমণ কাহিনী তো প্রকাশ করা যায়।
পান্ডুলিপি তৈরি করে ফেললাম মহা উৎসাহে। বর্ণসফ্ট আমার ল্যাপটপে দারুণ সব কাজ করে দিলো। আমি তো মহাখুশি। পিডিএফ ফাইল তৈরি করে পাঠিয়ে দিলাম ঢাকায় আমার বন্ধুর কাছে। বন্ধুঅন্ত প্রাণ অজিত। পান্ডুলিপি বগলে নিয়ে বাংলাবাজার চষে ফেলল। কিন্তু কোন প্রকাশককে রাজী করানো গেলো না। লেখক আমেরিকায়, সুতরাং এই বই এর পেছনে প্রকাশকদের পুঁজি খাটানোর কোন ইচ্ছে নেই। কেউ পান্ডুলিপি পড়ে দেখারও কোন আগ্রহ দেখালেন না।
আর কে নারায়ণ তাঁর প্রথম উপন্যাসটি ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন তাঁর বন্ধুর কাছে। কোন প্রকাশক খুঁজে পাওয়া যায় কিনা দেখতে। তাঁর বন্ধুটির অবস্থাও আমার বন্ধুটির মতো হয়েছিলো। আর কে নারায়ণ শেষের দিকে তাঁর বন্ধুকে বলেছিলেন পান্ডুলিপিটি যেন টেম্স নদীতে ফেলে দেয়। ক্ষোভে দুঃখে হতাশায় আমিও আমার বন্ধুকে বললাম পান্ডুলিপি যেন বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়। বাংলাবাজার থেকে বুড়িগঙ্গার দূরত্ব বেশি নয়। অজিত আমার কষ্টে নিজের কষ্ট ভুলে একেবারে মরীয়া হয়ে উঠলো। সে পান্ডুলিপি নিয়ে হাজির হলো বিশিষ্ট লেখক সাদ্উল্লাহ সাহেবের বাসায়। সাদ্উল্লাহ সাহেব লেখাটি পড়লেন এবং ভালোবেসে ফেললেন। ভালোবেসে একটি ভূমিকাও লিখে দিলেন আমার বই এর জন্য।
সকল ভালো লেখকই জনপ্রিয় লেখক হন না। সাদ্উল্লাহ সাহেবের লেখা বই আর কলামগুলো ইসলামী মৌলবাদের মুখোস খুলে দিচ্ছিলো। ইসলামের অপব্যাখ্যা করে যারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে সাদ্উল্লাহ সাহেব তাঁর ক্ষুরধার লেখায় তার জবাব দিচ্ছিলেন। কিন্তু জনকন্ঠের মত পত্রিকাও তাঁর লেখা শেষের দিকে প্রকাশ করার সাহস দেখাতে পারেনি। আর তাঁর বইয়ের প্রকাশকরাও অনেক সময় ভীত হয়ে পড়তেন বলে আমার ধারণা। সাদ্উল্লাহ সাহেব তাঁর প্রকাশককে বললেন আমার বই এর ব্যাপারে। প্রকাশকের অবস্থা খারাপ। সরাসরি ‘না’ও বলতে পারছেন না, আবার ‘হ্যাঁ’ বলাও সম্ভব না। বেশ কিছুদিন ঘুরিয়ে পান্ডুলিপি ফেরত দিলেন প্রকাশক। সাদ্উল্লাহ সাহেব জানতেও পারেন নি।
প্রতিবছর বইমেলা এলে প্রকাশকদের কাছে সাংবাদিকরা একটি নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন। তা হলো নতুন লেখকদের বই প্রকাশের ব্যাপারে তাঁদের উৎসাহ কেমন। ২০০৪ সালে যেসব প্রকাশক খুব দামী দামী উৎসাহ সূচক কথা বলেছিলেন তাঁদের কারো কারো কাছে নিয়ে যাওয়া হলো পান্ডুলিপি। আবার নতুন করে জানা গেলো যে সাংবাদিকদের কাছে বলা কথা বেশির ভাগই কথার কথা। খুব প্রতিষ্ঠিত এক প্রকাশক (নাম ঠিকানা জানা আছে। প্রকাশ করছি না। ভবিষ্যতে হয়তো ইনিই আমার বই বের করতে চাইবেন।) পরামর্শ দিলেন ‘উত্তেজক’ বই লিখতে। বললেন, ভ্রমণকাহিনীর মধ্যে জেম্স বন্ডের সিনেমায় যেমন ঘটে সেরকম ‘নারী’ থাকলে এবং সে সংক্রান্ত ‘রগরগে’ বর্ণনা থাকলে পাঠক ‘খায়’ ভালো। পাঠকেরা কষ্ট পাবেন না। প্রকাশকদের মধ্যে সবাই কিন্তু পাঠক সম্পর্কে এরকম ধারণা পোষণ করেন না।
অবশেষে একজন প্রকাশক পাওয়া গেলো। মনন প্রকাশ। শর্ত সামান্যই। আমার বই কেউ কিনবেন কি কিনবেন না - সে ব্যাপারে কোন রিস্ক নিতে রাজী নন প্রকাশক। আমার বই এর একটা নির্দিষ্ট কপি আমাকেই কিনে নিতে হবে যাতে প্রকাশনা খরচটি উঠে আসে। তারপর? বই যদি হাজার কপি বিক্রি হয়! তাহলে লেখকের নাম হবে, প্রকাশকের টাকা হবে। শর্তটা অপমানজনক। কিন্তু সৃষ্টির লক্ষ্যে সৃষ্টিকর্তাকে তো কত অপমানই সইতে হয়।
এবার নতুন ঝামেলা শুরু হলো। বর্ণসফ্টে লেখা পান্ডুলিপি প্রকাশকের কম্পিউটারে পড়া যায় না। তারা ‘বিজয়’ ছাড়া আর কিছু চেনেন না এবং কখনো চিনবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। বন্ধুর কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট আউট নিয়ে সেখান থেকে আবার বিজয় কীবোর্ডে কম্পোজ করা হলো পুরো বই। এবং যা হবার তাই হলো। বানান ভুল হলো, লাইনের মাঝখান থেকে কিছু কিছু শব্দ উধাও হয়ে গেলো, কোন কোন অনুচ্ছেদ থেকে গায়েব হয়ে গেলো কিছু কিছু লাইন।
অবশেষে ২০০৫ এর ১৯ ফেব্রুয়ারি আমার প্রথম বই ‘অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে’ প্রকাশিত হলো। সেই বইমেলায় নাকি বইটার বিশ কপি বিক্রি হয়েছিলো। বিটিভিতে বইমেলার খবরে আমার বইটার একটা রিভিউ প্রচারিত হয়েছিলো। তারপর সব চুপচাপ।
৪
২০০৫ এর শেষে দেশে গেলাম। এবার আমি নিজে নেমেছি মাঠে। হাতে একটি প্রকাশিত বই আর দুটো তরতাজা পান্ডুলিপি। বাংলাবাজারের প্রকাশকদের মাঝে সর্দার শ্রেণীর এক প্রকাশকের কাছে গেলাম। বইমেলা এলেই সংবাদপত্রে প্রকাশকদের পক্ষ থেকে এঁকে কথা বলতে দেখা যায়। নভেম্বরের এক স্নিগ্ধ সকালে পান্ডুলিপি বগলে তাঁর অফিসে হাজির হলাম। যথাসম্ভব বিনয় রেখে নিজের ঢোল নিজে বাজালাম। ভদ্রলোক আমার বাজনায় বিশেষ প্রভাবিত হলেন না। বললেন - অনেক বাঘা বাঘা লেখক দুবছর ধরে পান্ডুলিপি জমা দিয়ে বসে আছেন তাঁর কাছে। বললাম,
- আমি পান্ডুলিপি রেখে যাচ্ছি। আপনি পড়ে দেখেন একবার।
- আমি তো বই বা পান্ডুলিপি কিছু পড়িনা। পড়ার অভ্যাস নাই।
হতেই পারে। বই এর ব্যবসায়ী হলেই বই পড়তে হবে নাকি? বললাম,
- আপনি তো বিজ্ঞানের বই এর পান্ডুলিপি পান না বলে সাংবাদিকদের কাছে আক্ষেপ করেছেন। আমার একটি বই বিজ্ঞান বিষয়ক। আইনস্টাইনের জীবন ও বিজ্ঞান নিয়ে।
- তাহলে রেখে যেতে পারেন। দু’বছর পরে খবর নেবেন।
- দু’বছর পরে প্রকাশিত হবে?
- কথা দিতে পারছি না। না পারলে পান্ডুলিপি ফেরৎ দেবো।
দু’বছর ধরে অনিশ্চয়তায় ভোগা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। গেলাম ঐতিহ্য-র কাছে। তাঁরা আমার পান্ডুলিপি রেখে দিলেন দু’সপ্তাহ। তারপর তাঁদের ব্যবসায়ে সম্প্রতি খুব লোকসান হচ্ছে বলে পান্ডুলিপি ফেরৎ দিলেন। কী করা যায়! শেষে মীরা প্রকাশনের হারুণ ভাই রাজী হয়ে গেলেন। ২০০৬ এর বইমেলায় আমার দ্বিতীয় বই ‘আল্বুকারকি থেকে হলিউড’ ও তৃতীয় বই ‘আইনস্টাইনের কাল’ প্রকাশিত হলো।
‘আল্বুকারকি থেকে হলিউড’ আমার প্রথমবার আমেরিকা ভ্রমণের গল্প। নিউমেক্সিকো, আরিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিলো নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই। সেই ট্রিনিটি সাইট বা গ্রাউন্ড জিরো দেখার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিলো তখন। দুর্লভ বললাম এই কারণে যে এই সাইট এখনো সাধারণের জন্য ‘নিষিদ্ধ এলাকা’। আমেরিকান সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে এই এলাকা। বছরে মাত্র দুদিন সাধারণ জনগণ এখানে যেতে পারেন বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে। বিশেষ অনুমতি দিতে পারেন নিজ নিজ এলাকার সিনেটররা। কেন এত নিয়মের কড়াকড়ি জানিনা। আমরা অনুমতি পেয়েছিলাম ফিজিসিস্ট হিসেবে। আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির কল্যাণে। এসব অভিজ্ঞতা শেয়ার করার তাগিদ থেকেই ‘আল্বুকারকি থেকে হলিউড’ লেখা।
আইনস্টাইনের কাল সম্পর্কে এখানে আর নতুন করে বলার দরকার নেই। বইটা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বলে আমি খুশি। নতুন কিছু লেখার প্রেরণা আবারো পাচ্ছি।
৫
অভিজিৎ রায় তাঁর লেখায় আমার বইটির প্রশংসা করেছেন এটা আমার কাছে পরম পাওয়া বলে মনে হয়েছে। অভিজিৎ রায়ের লেখা আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ি আর ভাবি - মানুষ এত বেশি লেখাপড়া করার সময় পায় কীভাবে? আর এত পড়াশোনার মধ্য থেকে যখন যেটা প্রয়োজন তা এত গুছিয়ে লেখেন কীভাবে! আঁধারের যাত্রীদের আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার কাজটা নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন অভিজিৎ রায়। অভিনন্দন অভিজিৎ।
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮
তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া।
Dr Pradip Deb. Lecturer in Health Physics. School of Human Life Sciences. University of Tasmania, Launceston, TAS 7250, Australia. [email protected].