একজন গ্যালিলিওর ক্ষমা প্রার্থনা আর হাটু বাহিনীর আস্ফালন
ড: আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশের পুত-পবিত্র সামরিক বাহিনীর কাছে করোজোরে ক্ষমা চেযেছেন। আজকে এটা গরম খবর। সামরিক বাহিনীর হর্তা কর্তারা তাদের বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে, বুক ফুলিয়ে পারলে প্রেস কনফারেন্স করে সেটা জনগণকে জানিয়ে দিয়েছে। আর দালাল পত্রিকাগোষ্ঠির এ মুহূর্তে দুই নম্বর চামচা নাঈমুল তার পত্রিকায় বিশাল ফিচার করে খবরটা পঞ্চ-ব্যাঞ্জন সহকারে পরিবেশন করে আমাদের কৃতার্থ করেছেন। একজন স্বনামধন্য প্রফেসর যিনি সারাটা জীবন এন্টি এস্টাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মহাপ্রভুদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব থেকেছেন, তার মুখ দিয়ে বিঘতখানেক লম্বা আর্মি বন্দনা করাতে হলে কি পরিমাণ শারীরিক আর মানসিক অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাতে হয়, তা হাটু বাহিনী না বুঝলেও আমরা বুঝি। আর্মীর হাঁটুতে নেমে আসার বুদ্ধির বহর দেখে আগে হাসি পেত, এখন স্রেফ করুনা হয়। আরে উজবুক, একজন সম্মানিত প্রফেসর উচ্ছন্নে যাওয়া বেশরম আর্মীর ভেড়ার পালের কাছে করজোরে ক্ষমা চাইল, সেটা তোদের মত বেজন্মা জলপাই বাহিনীদের কাছে “দাঁত কেলানো” গর্বের ব্যাপার মনে হতে পারে, সবার কাছে তা নয়। গান্ধা আর কাকে বলে? জলপাইরা ভেবেছে জলিল ফালুকে যে পাল্লায় মাপা হয়েছে সেই একই পাল্লায় ড: আনোয়ার হোসেনকেও মাপা যাবে, আর জনগন সেটা ‘থ্রি-চিয়ার্স’ ধ্বণি দিয়ে গ্রহণও করবে। এক পা কবরে দেওয়া ঘাটের মরা জলিল জেলে গিয়ে জলপাইদের প্যাদানি খেয়ে “সব দোষ হাসিনার, আমার কোন দোষ নেই’, আর ফালু “ম্যাডাম ঘুষ খেতে বলেছেন তাই খেয়েছি’ মার্কা স্টেটমেন্ট দিয়ে জলপাইদের কৃতার্থ করেছে, ঠিক সেরকম ড: আনোয়ার হোসেনের মুখ দিয়ে ‘জলপাই কত ভাল’ গোছের বাণী বের করে জনগনের কাছে বাহবা কুড়াবে। এই না হলে বুদ্ধির ঢেঁকি!
আজ গ্যালিলিওর কথা মনে পড়ছে বারে বারে। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে – বাইবেল বিরোধি এই সত্য কথা বলার অপরাধে চার্চ গ্যালিলিওকে অভিযুক্ত করেছিল ‘ধর্মদ্রোহিতার’ অভিযোগে। ১৬৩৩ সালে। গ্যালিলিও তখন প্রায় অন্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অসুস্থ ও বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে জোর করে ফ্লোরেন্স থেকে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়, হাটু ভেঙ্গে সবার সামনে জোড় হাতে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ে বলতে বাধ্য করা হয় এতদিন গ্যালিলিও যা প্রচার করেছিলেন তা ধর্মবিরোধী, ভুল ও মিথ্যা। বাইবেলে যা বলা হয়েছে সেটিই আসল, সঠিক - পৃথিবী স্থির অনড় - সৌর জগতের কেন্দ্রে। গ্যালিলিও প্রাণ বাঁচাতে তাই করলেন। পোপ ও ধর্মসংস্থার সম্মূখে গ্যালিলিও যে স্বীকারোক্তি ও প্রতিজ্ঞা-পত্র স্বাক্ষর করেন, তা বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসে ধর্মীয় মৌলবাদীদের নির্মমতার এবং জ্ঞান সাধকদের কাছে বেদনার এক ঐতিহাসিক দলিল:
আমি ফ্লোরেন্সবাসী স্বর্গীয় ভিন্সেঞ্জিও গ্যালিলিওর পুত্র, সত্তর বৎসর বয়স্ক গ্যালিলিও গ্যালিলি সশরীরে বিচারার্থ আনীত হয়ে এবং অতি প্রখ্যাত ও সম্মানার্হ ধর্মযাজকদের (কার্ডিনাল) ও নিখিল খ্রীষ্টীয় সধারণতন্ত্রে ধর্মবিরুদ্ধ আচরণজনিত অপরাধের সাধারণ বিচারপতিগণের সম্মূখে নতজানু হয়ে স্বহস্তে ধর্মগ্রন্থ স্পর্শপূর্বক শপথ করছি যে, রোমের পবিত্র ক্যাথলিক খ্রীষ্টধর্ম সংস্থার দ্বারা যা কিছু শিক্ষাদান ও প্রচার করা হয়েছে ও যা কিছুতেই বিশ্বাস স্থাপন করা হয়েছে আমি তা সবসময় বিশ্বাস করে এসেছি, এখনও করি এবং ঈশ্বরের সহয়তা পেলে ভবিষ্যতেও করব। সূর্য কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ও নিশ্চল এরূপ মিথ্যা অভিমত যে কিরূপ শাস্ত্রবিরোধী সে সব বিষয় আমাকে অবহিত করা হয়েছিল; এ মিথ্যা মতবাদ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে এর সমর্থন ও শিক্ষাদান থেকে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত থাকতে আমি এই পবিত্র ধর্মসংস্থা কর্ত্তৃক আদিষ্ট হয়েছলাম। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সে একই নিন্দিত ও পরিত্যক্ত মতবাদ আলোচনা করে ও কোন সমাধানের চেষ্টার পরিবর্তে সেই মতবাদের সমর্থনে জোরালো যুক্তিতর্কের অবতারণা করে আমি একটি গ্রন্থ রচনা করেছি; এজন্য গভীর সন্দেহ এই যে আমি খ্রীষ্টধর্মবিরূদ্ধ মত পোষণ করে থাকি। .... অতএব সঙ্গত কারণে আমার প্রতি আরোপিত এই অতিঘোর সন্দেহ ধর্মাবতারদের ও ক্যাথোলিক সম্প্রদায়ভুক্ত প্রত্যেকের মন হতে দূর করবার উদ্দেশ্যে সরল অন্তকরণে ও অকপট বিশ্বাসে শপথ করে বলছি যে পূর্বোক্ত ভ্রান্ত ও ধর্মবিরূদ্ধ মত আমি ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করি। ...আমি শপথ করে বলছি যে, আমার ওপর এজাতীয় সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে, এরূপ কোন বিষয় সম্বন্ধে ভবিষ্যতে আর কখনও কিছু বলব না বা লিখব না। এরূপ অবিশ্বাসীর কথা জানতে পারলে অথবা কারও ওপর ধর্মবিরূদ্ধ মতবাদ পোষণের সন্দেহ উপস্থিত হলে পবিত্র ধর্মসংস্থার নিকট অথবা যেখানে অবস্থান করব সেখানকার বিচারকের নিকট আমি তা জ্ঞাপন করব। শপথ নিয়ে আমি আরও প্রতিজ্ঞা করছি যে, এই পবিত্র ধর্মসংস্থা আমার ওপর যে সব প্রায়শ্চিত্তের নির্দ্দেশ প্রদান করবে আমি তা হুবহু পালন করব। এসব প্রতিজ্ঞা ও শপথের যে কোন একটি যদি ভঙ্গ করি তাহলে শপথভঙ্গকারীর জন্য ধর্মাধিকরণের পবিত্র অনুশাসনে এবং সাধারণ অথবা বিশেষ আইনে যেসব নির্যাতন ও শাস্তির ব্যবস্থা আছে তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করব। অতএব ঈশ্বর ও যেসব পবিত্র গ্রন্থ আমি ষ্পর্শ করে আছি এঁরা আমার সহায় হোন। আমি উপরে কথিত গ্যালিলিও গ্যালিলি শপথ গ্রহণ ও প্রতিজ্ঞা করলাম এবং নিজেকে উপর্যুক্তভাবে বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে প্রতিশ্র“ত হলাম। এর সাক্ষ্য হিসেবে স্বহস্তলিখিত শপথনামা যার প্রতিটি অক্ষর এইমাত্র আপনাদের পাঠ করে শুনিয়েছি তা আপনাদের নিকট সমর্পন করছি। ২২শে জুন, ১৬৩৩ খ্রীষ্টাব্দ, রোমের মিনার্ভা কনভেন্ট।”
শোনা যায়, এর মধ্যেও একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ গণিতজ্ঞ-জ্যোতির্বিদ স্বগতোক্তি করেছিলেন- ’তার পরেও কিন্তু পৃথিবী ঠিকই ঘুরছে’। ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ নিয়েই গ্যালিলিওর মৃত্যু হয় ১৬৪২ সালে, নিজ গৃহে, অন্তরীণ অবস্থায় (এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের জন্য আমার লেখা বই “আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী” (অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৫) পড়ুন) ।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! বুদ্ধিহীন উগ্র ধর্মবাদীদের দল প্রতি যুগেই ক্ষমতার শীর্ষে থেকে প্রগতির চাকাকে উল্টো দিকে ঘোরাতে চায় । .........
পোপ ও ধর্মসংস্থার সম্মূখে গ্যালিলিওর স্বীকারোক্তি যেরকম আমাদের বেদনাহত করে ঠিক তেমনি আমাকে বেদনাহত করল আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত আদালতে ড: আনোয়ার হোসেনের অনুতাপ আর তার জলপাই বন্দনার কাহিনী। তাও এই বিংশ শতাব্দীতে এসে। ছাত্রদের গণবিক্ষোভে ইন্ধন যোগানোর ‘অপরাধে’ উর্দি পরা লোকগুলো রাতের আঁধারে টেনে হিচরে জেলখানায় নিয়ে গিয়েছিল আনোয়ার হোসেনেকে। আবার ক’দিন পরেই আদালতে টেনে এনে জলিল-ফালুর মত ক্রিমিনালদের কায়দায় তাঁর মুখ দিয়ে জণগণকে শোনানো হল জলপাই বন্দনা। কিন্তু তাও কি শাক দিয়ে সব মাছ ঢেকে রাখা গেল? বৃদ্ধ গণিতজ্ঞ গ্যালিলিও যেমন স্বগতোক্তি করেছিলেন- ’তার পরেও কিন্তু পৃথিবী ঠিকই ঘুরছে’, তেমনি ড: আনোয়ার হোসেনের মুখ দিয়েও আদালতে শেষ মেষ বেরিয়ে আসলো নগ্ন সত্য –
"আমাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আমার সামনে অন্যদের শারীরিক নির্যাতন করে দেখানো হয়েছে। "
ঐটাই সব কথার শেষ কথা। একটা কথাই কাফি। হাটু বাহিনী কি এই উক্তির তাৎপর্য কোনদিন বুঝবে? বুঝতে পারবে যে, সব জনগনকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা যায় না?
৩০ আগাস্ট, ২০০৭।
ডঃ অভিজিৎ রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক। ইমেইল : [email protected]