আত্মা নিয়ে ইতং-বিতং (১ম পর্ব)
(উৎসর্গ: গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী – আত্মায় অবিশ্বাসী একজন পরিপূর্ণ ইহজাগতিক মানুষ)
ভুমিকা : সঞ্জীবদার সাথে আমার প্রথম পরিচয় আশির দশকের শেষভাগে, ড. ম. আখতরুজ্জামানের বাসায়। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকতাম। ম. আখতারুজ্জামানের ছেলে সুমনের সাথে আমার ছোটবেলা থেকেই বন্ধুত্ব। সে সূত্রেই তাদের বাসায় আমার হর হামেশা যাওয়া আসা চলত। একদিন বাসায় গিয়ে দেখি সুমনের ঘরে এক একহারা গরণের মোচ-ওয়ালা লোক আনমনে গীটার বাজাচ্ছে আর গুন গুন সুরে গান গাইছে –
Listen to the pouring rain
Listen to it pour,
And with every drop of rain
You know I love you more
Let it rain all night long,
Let my love for you go strong,
As long as we're together
Who cares about the weather?...শুনেই বুঝলাম হোসে ফেলিসিয়ানোর গান। আমি তন্ময় হয়ে শুনলাম ভদ্রলোকের গান। অবাকও হয়েছিলাম খুব। আমি ভাবতাম সুমন কিংবা আমি আর হয়ত কিছু মরা ধরা শ্রোতা ছাড়া ফেলিসিয়ানো কেউ শুনে না। কিন্তু সেদিন হোচট খেয়েছিলাম।
সঞ্জীব চৌধুরী। সুমন ডাকছিল সঞ্জীবদা বলে। আমিও তাই ডাকা শুরু করলাম। উনি তখনো দলছুটের বিখ্যাত সঞ্জীবদা হননি। ভোরের কাগজে সাংবাদিকতাও শুরু করেননি। স্রেফ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ একজন কর্মী। সাধারণ বললাম বটে, কিন্তু প্রথম দর্শনেই বুঝলাম লোকটার ভিতরে লুকিয়ে আছে অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। মোহনীয় আকর্ষনী ক্ষমতা। হাল্কা রসিকতায় ঢূকতে পারেন গভীর দর্শনে। বয়সের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও বন্ধুবৎসল এ মজার মানুষটির সাথে আমার বন্ধুত্ব হতে সময় লাগলো না। এর পর আরো কয়েকবারই সঞ্জীবদার সাথে দেখা হয়েছে। বরাবরই অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে গল্প করেছেন কথা বলেছেন। মজার মজার কিছু স্মৃতি আছে তার সাথে তবে সেগুলো এখানে লিখবার নয়। হয়ত অন্য কোনো দিন বলা যাবে।
এখানে যেটি বলতে চাই তা হল, অনেকেই সঞ্জীবদাকে নিয়ে লিখেছেন, লিখছেন। লিখছেন তার পান-প্রিয়তার কথা, লিখছেন তার বোহেমিয়ান জীবন-যাপনের কথা। কিন্তু যে কথাটি লেখা হয়নি তা হল জীবন নিয়ে তার স্বচ্ছ দৃষ্টিভংগীর কথা। স্বর্গের লোভ তার ছিল না, ছিল না কাউকে তোয়াজ করে চলবার খায়েশ। সম্পূর্ণ ইহজাগতিক মানুষ ছিলেন তিনি। জীবনকে ভালবেসেছেন। জীবনকে উপভোগ করেছেন পরিপূর্ণভাবে। এর মধ্যেই মানুষের জন্য করেছেন, গানের মধ্য দিয়ে মানুষকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু অনেকেই তা বোঝেনি, হয়ত কড়া নেড়ে গিয়েছেন ‘ভুল দরজায়’।
মৃত্যুর পরও নিজের দেহটিকে দান করে গেছেন মানুষের কল্যানে, মেডিকেল কলেজে। হয়ত তার মনে ছিল আরজ আলী মাতুব্বরের সেই বিখ্যাত অনুপ্রেরণা - ...আমি আমার মৃতদেহটিকে বিশ্বাসীদের অবহেলার বস্তু ও কবরে গলিত পদার্থে পরিণত না করে, তা মানব কল্যাণে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।‘ পরকালে তার আত্মার কি হবে তা নিয়ে তার ভাবনা ছিল না, ছিল ধর্মীয় মতে পারলৌকিক কৃত্য সম্পন্ন করে হুর পরী পাওয়ার লোভ।
আত্মায় অবিশ্বাসী ইহজাগতিক মানুষটিকে জানাই প্রাণের প্রণতি। আমার এ সিরিজটি সঞ্জীবদার স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত।সবাইকে ইংরেজী নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
৩১ ডিসেম্বর, ২০০৭
আত্মার উৎস সন্ধানে :
আত্মার ধারণা অনেক পুরোন। যখন থেকে মানুষ নিজের অস্তিত্ব নিয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়েছে, নিজের জীবন নিয়ে কিংবা মৃত্যু নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে, জীবন জগতের বিভিন্ন রহস্যে হয়েছে উদ্বেলিত, তার ক্রমিক পরিনতি হিসেবেই এক সময় মানব মনে আত্মার ধারণা উঠে এসেছে। আসলে জীবিত প্রাণ থেকে জড়জগৎকে পৃথক করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহজ সমাধান হিসেবে আত্মার ধারণা একটা সময় গ্রহণ করে নেওয়া হয়েছিল বলে মনে করা হয়১, ৪, ৫, ১৯। আদিকাল থেকেই মানুষ ইট, কাঠ, পাথর যেমনি দেখেছে, ঠিক তেমনিভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে চারপাশের বর্ণাঢ্য জীবজগতকে। ইট, পাথর বা অন্যান্য জড় পদার্থের যে জীবনীশক্তি নেই, নেই কোন চিন্তা করার ক্ষমতা তা বুঝতে তার সময় লাগেনি। অবাক বিস্ময়ে সে ভেবেছে - তাহলে জীবগতের যে চিন্তা করার কিংবা চলে ফিরে বেড়াবার ক্ষমতাটি রয়েছে, তার জন্য নিশ্চয় বাইরে থেকে কোন আলাদা উপাদান যোগ করতে হয়েছে। আত্মা নামক অপার্থিব উপাদানটিই সে শুন্যস্থান তাদের জন্য পূরণ করেছে১৪, তারা রাতারাতি পেয়ে গেছে জীবন-মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার খুব সহজ একটা সমাধান।
চিত্র : ক) নিয়ান্ডার্থালদের মৃতদেহ কবর দেওয়ার সময় পারলৌকিক আচার আচরণ খ) শানিদার গুহায় পাওয়া ফসিলের অবশেষ।এখন পর্যন্ত জানা তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, আত্মা দিয়ে জীবন মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার করার প্রচেষ্টা প্রথম শুরু হয়েছিলো সম্ভবতঃ নিয়ান্ডার্থাল মানুষের আমলে - যারা পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে এখন থেকে প্রায় আড়াই লক্ষ বছর আগে১৯। নিয়ানডার্থাল মানুষের আগে পিথেকানথ্রোপাস আর সিনানথ্রোপাসদের মধ্যে এ ধরনের ধর্মাচরণের কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নি। তবে নিয়ান্ডার্থাল মানুষের বিশ্বাসগুলো ছিল একেবারেই আদিম- আজকের দিনের প্রচলিত ধর্মমতগুলোর তুলনায় অনেক সরল। ইরাকের শানিদার নামের একটি গুহায় নিয়ান্ডার্থাল মানুষের বেশ কিছু ফসিল পাওয়া গেছে যা দেখে অনুমান করা যায় যে, নিয়ান্ডার্থালরা প্রিয়জন মারা গেলে তার আত্মার উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করতো। এমনকি তারা মৃতদেহ কবর দেয়ার সময় এর সাথে পুষ্পরেণু, খাদ্যদ্রব্য, অস্ত্র সামগ্রী, শিয়ালের দাঁত এমনকি মাদুলীসহ সব কিছুই দিয়ে দিত যাতে পরপারে তাদের আত্মা শান্তিতে থাকতে পারে আর সঙ্গে আনা জিনিসগুলো ব্যবহার করতে পারে। অনেক গবেষক (যেমন নিলসন গেসছিটি, রবার্ট হার্টস প্রমুখ) মনে করেন, মৃতদেহ নিয়ে আদি মানুষের পারলৌকিক ধর্মাচরণের ফলশ্রুতিতেই মানব সমাজে ধীরে ধীরে আত্মার উদ্ভব ঘটেছে১৬।
আত্মা নিয়ে হরেক রকম গপ্প:
জীবন মৃত্যুর যোগসূত্র খুঁজতে গিয়ে আত্মাকে ‘আবিস্কার’ করলেও সেই আত্মা কি করে একটি জীবদেহে প্রাণসঞ্চার করে কিংবা চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটায় তা নিয়ে প্রাচীন মানুষেরা একমত হতে পারেনি। ফলে জন্ম নিয়েছে নানা ধরনের গাল গপ্প, লোককথা আর উপকথার। পরবর্তীতে এর সাথে যোগ হয়েছে নানা ধরনের ধর্মীয় কাহিনীর। জন্ম হয়েছে আধ্যাত্মবাদ আর ভাববাদের, তারপর সেগুলো সময়ের সাথে সাথে আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিলে মিশে এমনভাবে একাকার হয়ে গেছে যে আত্মা ছাড়া জীবন-মৃত্যুকে সংজ্ঞায়িত করাই অনেকের জন্য অসম্ভব ব্যাপার। আত্মা নিয়ে কিছু মজার কাহিনী এবারে শোনা যাক।
জাপানীরা বিশ্বাস করে একজন মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন তার ভেতরের আত্মা খুব ছোট পতঙ্গের আকার ধারণ করে তার হা করা মুখ দিয়ে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। তারপর যখন ওই আত্মা নামক পোকাটি ঘুরে ফিরে আবার হামগুড়ি দিয়ে মুখ বেয়ে দেহের ভিতরে প্রবেশ করে তখনই ওই মানুষটি ঘুম থেকে জেগে উঠে১, ৪। মৃত্যুর ব্যাখ্যাও এক্ষেত্রে খুব সহজ। মুখ দিয়ে বেরিয়ে পোকাটি আর যদি কোন কারণে ফেলে আসা দেহে ঢুকতে বা ফিরতে না পারে, তবে লোকটির মৃত্যু হয়। অনেক সময় ঘুমন্ত মানুষের অস্বাভাবিক স্বপ্নদেখাকেও আত্মার অস্তিত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতেন প্রাচীন মানুষেরা১৫, ১৬। তারা ভাবতেন, ঘুমিয়ে পড়লে মানুষের আত্মা ‘স্বপ্নের দেশে’ পাড়ি জমায়। আর তারপর স্বপ্নের দেশ থেকে আবার ঘুমন্ত মানুষের দেহে আত্মা ফেরত এলে মানুষটি ঘুম থেকে জেগে উঠে। আত্মা নিয়ে এধরনের নানা বিশ্বাস আর লোককথা ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকায় ছড়িয়ে ছিল।
আত্মার এক ধরণের প্রাগৈতিহাসিক ধারণা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী অ্যাবরোজিনসদের মধ্যে প্রচলিত ছিল৭। প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে অ্যাবরোজিনসরা অস্ট্রেলিয়ার মূল ভুখন্ডে আসার পর অনেকদিন বাইরের জগতের সাথে বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে তাদের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল চারপাশের পৃথিবী থেকে একটু ভিন্নভাবে। তাদের আত্মার ধারণাও ছিল বাইরের পৃথিবী থেকে ভিন্ন রকেমের। তাদের আত্মা ছিল যোদ্ধা প্রকৃতির। তীর-ধনুকের বদলে বুমেরাং ব্যবহার করত। কোন কোন অ্যাবরোজিন এও বিশ্বাস করত যে, তাদের গোত্রের নতুন সদস্যরা আত্মাদের পুনরায় ব্যবহার করতে পারত। ঠিক একইভাবে প্রায় বার হাজার বছর আগেকার আদিবাসী আমেরিকানদের মধ্যেও আত্মা নিয়ে বিশ্বাস প্রচলিত ছিল, যা প্রকারন্তরে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধ্যান ধারণার অভিযোজনকেই তুলে ধরে। আফ্রিকার কালোমানুষদের মতে সকল মানুষের আত্মার রং কালো রং-এর। আবার মালয়ের বহু মানুষের ধারণা, আত্মার রঙ রক্তের মতই লাল, আর আয়তনে ভুট্টার দানার মত। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অনেকের ধারণা আত্মা আসলে তরল। অস্ট্রেলিয়ার অনেকে আবার মনে করে আত্মা থাকে বুকের ভিতরে, হৃদয়ের গভীরে; আয়তনে অবশ্যই খুবই ছোট ২১ । কাজেই এটুকু বলা যায়, আত্মায় বিশ্বাসীরা নিজেরাই আত্মার সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞার ব্যাপারে একমত নন। আত্মা নিয়ে প্রচলিত পরস্পর-বিরোধী গাল-গপ্পগুলো সেই সাক্ষ্যই দেয়।
ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, হিব্রু, পারশিয়ান আর গ্রীকদের মধ্যে আত্মা নিয়ে বহুধরনের বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। প্রথম দিকে - অন্ততঃ খ্রীষ্টপূর্ব ছয় শতক পর্যন্ত তো বটেই- হিব্রু, ফোয়েনিকানস আর ব্যবলনীয়, গ্রীক এবং রোমাদের মধ্যে মৃত্যু-পরবর্তী আত্মার কোন স্বচ্ছ ধারণা গড়ে ওঠেনি ১, ৪। তারা ভাবতেন মানুষের আত্মা একধরনের সজ্ঞাবিহীন ছায়া সদৃশ (shadowy entity) অসম্পূর্ণ সত্তা, পূর্ণাংগ কিছু নয়। গবেষক ব্রেমার আত্মা নিয়ে প্রাচীন ধারণাগুলো সম্বন্ধে বলেন, ‘মোটের উপর আত্মাগুলো ছিল চেতনাবিহীন ছায়া ছায়া জিনিস, পূর্ণাংগ সত্তা তৈরি করার মত গুণাবলীর অভাব ছিল তাতে’ ১৬।
সম্ভবতঃ জরথ্রুস্ট্র ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যার আত্মা সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনা আধুনিক আধ্যাত্মবাদীদের দেওয়া আত্মার ধারণার অনেকটা কাছাকাছি। জরথ্রুস্ট্র ছিলেন খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০ বছর আগেকার একজন পারশিয়ান। তার মতানুযায়ী, প্রতিটি মানুষ তৈরি হয় দেহ এবং আত্মার সমন্বয়ে, এবং আত্মার কল্যানেই আমরা যুক্তি, বোধ, সচেতনতা এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে পারি। জরথ্রুস্ট্রবাদীদের মতে, প্রতিটি মানুষই নিজের ইচ্ছানুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ কর্ম করার অধিকারী, এবং সে অনুযায়ী, তার ভাল কাজ কিংবা মন্দকাজের উপর ভিত্তি করে তার আত্মাকে পুরষ্কৃত করা হবে কিংবা শাস্তি প্রদান করা হবে। জরথ্রুস্ট্রের দেওয়া আত্মার ধারণাই পরবর্তীকালে গ্রীক এথেনীয় দার্শনিকেরা এবং আরো পরে খ্রীষ্ট ও ইসলাম ধর্ম তাদের দর্শনের অংগীভুত করে নেয়। খ্রীষ্টধর্মে আত্মার ধারণা গড়ে ওঠে সেন্ট অগাস্টিনের হাতে। জরথ্রুস্ট্রের মৃত্যুর প্রায় এক হাজার বছর পর অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মবেত্তা সেন্ট অগাস্টিন খ্রীষ্টধর্মের ভিত্তি হিসেবে একই ধরণের (মানুষ = দেহ + আত্মা) যুক্তির অবতারণা করেন। এই ধারণাই পরবর্তিতে অস্তিত্বের দৈত্বতা (dulaliy) হিসবে খ্রীষ্ট ধর্মের দার্শনিক ভিত্তি প্রদান করে। এর সাথে যোগ হয় পাপ-পূণ্য এবং পরকালে আত্মার স্বর্গবাস বা নরকবাসের হরেকরকেরম গালগপ্প। এগুলোই পরে ডালপালায় পল্লবিত হয়ে পরে ইসলাম ধর্মেও স্থান করে নেয়। সন্দেহ করা হয়, প্রাথমিকভাবে অগাস্টিন জরথ্রুস্ট্রবাদীদের কাছ থেকেই আত্মার ধারণা পেয়েছিলেন, কারণ খ্রীষ্টধর্মগ্রহন করার আগ পর্যন্ত নয় বছর অগাস্টিন ম্যানিকিন (Manchean) গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যাদের মধ্যে জরথ্রুস্ট্রবাদের প্রভাব বিদ্যমান ছিল পুরোমাত্রায়।
হিব্রু এবং গ্রীকদের মধ্যে প্রথম দিকে আত্মা নিয়ে কোন সংহত ধারণা ছিল না । এই অসংহত ধারণার প্রকাশ পাওয়া যায় হোমারের (খ্রীষ্টপূর্ব ৮৫০) রচনায় - সাইকি (Psyche) শব্দটির উল্লেখে। হোমারের বর্ণনানুযায়ী, কোন লোক মারা গেলে বা অচেতন হয়ে পরলে ‘সাইকি’ তার দেহ থেকে চলে যায়১৬। তবে সেই সাইকির সাথে আজকের দিনে প্রচলিত আত্মার ধারণার পার্থক্য অনেক। হোমারের সাইকি ছিল সজ্ঞাবিহীন ছায়া সদৃশ অসম্পূর্ণ সত্তা; এর আবেগ, অনুভূতি কিংবা চিন্তাশক্তি কিছুই ছিল না ১, ৪। ছিল না পরকালে আত্মার পাপ-পূণ্যের হিসাব।
এর মাঝে গ্রীসের অয়োনীয় যুগের বিজ্ঞানীরা বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জীবণ মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করতে প্রয়াসী হন। ভাববাদের কচকচানি এড়িয়ে প্রথম যে গ্রীক দার্শনিক জীবনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হলেন, তাঁর নাম থেলিস (৬২৪-৫৪৭ খ্রী.পূ.)। থেলিসের বক্তব্য ছিল, বস্তু মাত্রই প্রাণের সুপ্ত আধার। উপযুক্ত পরিবেশে বস্তুর মধ্যে নিহিত প্রাণ আত্মপ্রকাশ করে২০। পরমাণু তত্ত্বের প্রবক্তা ডেমোক্রিটাস (৪৬০-৩৭০ খ্রী.পূ.) প্রাণের সাথে বস্তুর নৈকট্যকে আরো বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন। ডেমোক্রিটাস বলতেন, সমগ্র বস্তুজগৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবিভাজ্য কণা দিয়ে গঠিত। তিনি সে কণিকাগুলোর নাম দিলেন অ্যাটম বা পরমাণু। তিনি শুধু সেখানেই থেমে থাকেননি, তার পরমাণু তত্ত্বকে নিয়ে গেছেন প্রাণের উৎপত্তির ব্যাখ্যাতেও। তিনি বলতেন, কাদা মাটি বা আবর্জনা থেকে যখন প্রাণের উদ্ভব হয় তখন অজৈব পদার্থের অনুগুলো সুনির্দিষ্টভাবে সজ্জিত হয়ে জীবনের ভিত্তিভুমি তৈরি করে। ডেমোক্রিটাসের প্রায় সমসাময়িক দার্শনিক লিউসেপ্পাসও (আনুমানিক ৫০০-৪৪০ খ্রী.পূ.) এধরণের বস্তুবাদী ধারণায় বিশ্বাস করতেন। তিনি বিজ্ঞানে তিনটি নতুন ধারণা চালু করেন –চরম শূন্যতা, চরম শূন্যতার মধ্য দিয়ে এটমের চলাফেরা এবং যান্ত্রিক প্রয়োজন। লিউসেপ্পাসই প্রথম বিজ্ঞানে কার্যকারণ তত্ত্বের জন্ম দেন বলে কথিত আছে ২২ । অয়োনীয় যুগের দর্শনের বস্তুবাদীরূপটিকে পরবর্তীতে আরো উন্নয়ন ঘটান এপিকিউরাস এবং লুক্রেশিয়াস, এবং তা দর্শন ও নীতিশাস্ত্রকেও প্রভাবিত করে। গ্রীক পরমাণুবাদ পরবর্তীকালে বিজ্ঞানকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল। যেমন, প্রথম আধুনিক পরমাণুবিদ গ্যাসেন্ডি তার পরমাণুবাদ তৈরির জন্য ঋণ স্বীকার করেছেন ডেমোক্রিটাস এবং এপিকিউরাসের কাছে। গ্রীক পরমানূবাদ প্রভাবিত করেছিল পরবর্তীতে পদার্থবিদ নিউটন এবং রসায়নবিদ জন ড্যাল্টনকেও তাদের নিজ নিজ পরমাণু তত্ত্ব নির্মাণে।
কাজেই গ্রীসের অয়োনীয় যুগে মেইনস্ট্রীম দার্শিনিকদের চিন্তা চেতনা ছিল অনেকটাই বস্তুবাদী। কিন্তু পরে পারস্য দেশের প্রভাবে আত্মা সংক্রান্ত সব আধ্ম্যাতিক এবং ভাববাদী ধ্যান-ধারনা গ্রীকদের মধ্যে ঢুকে যায়। ভাববাদী দর্শনের তিন পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল। এরা এথেন্সের সন্তান হলেও সে এথেন্স তখন অবক্ষয়ী এথেন্স। তারপরও পরবর্তী আড়াই হাজার বছর তাদের চিন্তা-চেতনা দিয়ে মানব সমাজ প্রভাবিত হয়েছিল। এদের ক্ষমতার কোন সীমা-পরিসীমা ছিল না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মানব ইতিহাসের প্রথম স্বাধীন নগরের বৈপ্লবিক মহত্ব থেকে তারা মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করার মত শক্তিধর হওয়া সত্ত্বেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে ক্ষমতাকে তারা প্রতিবিপ্লবের স্বার্থে ব্যবহার করতেন ২২ । তারা গণতন্ত্রের ভয়ে ভীত ছিলেন এবং গণতন্ত্রের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন। অয়োনীয় যুগের দার্শনিকেরা পলে পলে বস্তুবাদের যে সৌধ গড়ে তুলেছিলেন, তা এই তিন ভাববাদী দার্শনিকদের আগ্রাসনে বিলুপ্ত হয়। বস্তুবাদকে সরিয়ে মূলতঃ রহস্যবাদী উপাদানকে হাজির করে তারা তাদের দর্শন গড়ে তুলেন। প্লেটোর বক্তব্য ছিল যে, প্রাণী বা উদ্ভিদ কেউ জীবিত নয়, কেবলমাত্র যখন আত্মা প্রাণী বা উদ্ভিদদেহে প্রবেশ করে তখনই তাতে জীবনের লক্ষণ পরিস্ফুট হয়। প্লেটোর এ সমস্ত তত্ত্বকথাই পরবর্তীতে খ্রীস্টধর্মের বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থনের যোগান দেয়। প্লেটোর এই ভাববাদী তত্ত্ব আ্যারিস্টটলের দর্শনের রূপ নিয়ে পরবর্তীতে হাজারখানেক বছর রাজত্ব করে। এখন প্রায় সব ধর্মমতই দার্শনিক-যুগলের ভাববাদী ধারণার সাথে সঙ্গতি বিধান করে। আত্মা সংক্রান্ত কুসংসস্কার শেষপর্যন্ত মানব সমাজে ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসে।
২য় পর্ব পড়ুন...
ড. অভিজিৎ রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক। ইমেইল : [email protected]