ডালিমের লেখার প্রত্যুত্তরে
অভিজিৎ রায়
ডালিমের "প্রসংগ হাসিনা : মুক্তমনার লেখকদের বিরুদ্ধে" লেখাটি হাজারো আবেগময় লেখার ভীরে একঝলক সুবাতাস। অনেক ধন্যবাদ তাকে সাহস করে কিছু সত্য কথা ঠিক সময়ে বলবার জন্য। আপনি যাদের "মুক্তমনা লেখক" বলেছেন, তারা সত্যই মুক্তমনা লেখক কিনা এ নিয়ে আমারও সন্দেহ আছে ভাই। শুধু ফ্রিথিংকারদের ফোরামে লেখালিখি করলেই যে "মুক্তমনা" হওয়া যায় না, তাদের লেখালিখিই বড় প্রমাণ। যে মহিলার শাসনামলে জয়নাল হাজারী, হাজি সেলেমের মত পান্ডারা অবাধে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, যে মহিলা খেলাফত মজলিসের মত উগ্রপন্থি দলের সাথে চুক্তি করে বিন্দুমাত্র লজ্জিত হয়নি, তার জন্য দেখছি কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণে অনেকেরই যেন কমতি নেই। শুধু কি তাই নাকি? বংগবন্ধু বংগবন্ধু বলে কথায় কথায় ফ্যানা তুলে ফেললেও, তার শাসনামলে হাসিনা "জাতির পিতার" হত্যার বিচার করতে ভুলে গেছেন। নিউইয়র্কে গিয়ে হিন্দুদের দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করেছেন ফালু-বাবরদের ভাষাতেই - "ওরা ত ভারতে এক পা দিয়ে বসে থাকে"। তসলিমা নাসরিণকে আভিহিত করেছেন "পর্ণ লেখিকা" হিসেবে। সালমান এফ রহমানের মত ঋণখেলাপিকে মাথায় তুলে মধু ঢেলেছেন। সময় সময় রাজাকার আলবদরদের "সাথে নিয়ে" আন্দোলন করতেও তাঁর বাধেনি, কিংবা লজ্জা লাগেনি গোলাম আজমের কাছে "দোয়া চাইতে"। "মিগ কেলেংকারি" কিংবা প্রবাসী ছেলে এবং মেয়ের কাছে অর্থপাচারের "গুজব" গুলোর কথা না হয় বাদ দেই, শয়ে শয়ে কালোবাজারি, চোরাকারবারি, ঋণখেলাপি, সন্ত্রাসী, ডাকাত-গুন্ডাদের যে টাকার বিনিময়ে নমিনেশন দিয়েছেন (বিগত বাতিল হয়ে যাওয়া নির্বাচনে), তা ত অপ্রকাশিত নয়। একই সময়, এরশাদের মত লম্পটকে কিভাবে বিএনপির চেয়েও কোটি টাকা বেশি দিয়ে কিভাবে নিজ দলে ভিরিয়ে ফেলেছিলেন সেই নাটকও আমরা পত্র-পত্রিকায় পড়েছি। কাজেই চোখ বুজে হাসিনাকে বন্দনা করে যাওয়া "মুক্তমনা লেখক" আপনার না হলেও চলবে, বরং যেমনি ভাবে উল্টো স্রোতে দাঁড় বাইছেন, সেরকমই দাঁড় বেয়ে যান, তাতেই বরং আমরা খুশি। মুক্তমনায় আপনাকে স্বাগতম। ভবিষ্যতে আপনার আরো এরকম লেখা নিয়মিতভাবে আশা করছি।
আপনার লেখার একটি ত্রুটির কথাই বলব। আপনি মুক্তমনা লেখকদের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে হাসিনা-খালেদাকে যেভাবে এককাতারে বসিয়ে দিয়েছেন, তাতে অনেকেই হয়ত একমত হবেন না। একমত হবেন না আপনি যেভাবে আমাদের তত্তাবধায়ক সরকারকে "মহান" বানাতে চাইছেন তার সাথেও। হাসিনা দুর্ণীতি করেছেন, মানুষ মেরেছেন সবই সত্য, কিন্তু তারপরেও আমাদের "বেগম সাহেবা" আর তার লালু-ফালু গ্যাংদের তুলনায় তা ছিল নস্যি। আমি নিজেই আওয়ামীলিগকে পছন্দ করি না একদমই, আর দুর্মুখ হাসিনাকে তো আরও কম, কিন্তু এটাও ঠিক লালু-ফালুদের আমলে হাসিনার উপর বিএনপির প্রত্যক্ষ মদদে যে গ্রেনেড হামলা হয়েছে, যে ভাবে আইভি রহমান আর কিবরিয়ার হাত-পা বিচ্ছিন্ন রক্তাক্ত দেহের ছবি দেখেছি, তাতে আর যে কোন সচেতন মানুষের মতই শিউরে উঠেছি। বিএনপির পাঁচটি বছর ছিল নির্দ্বিধায় বাংলাভাই-শায়খ নামধারী মৌলবাদীদের স্বর্গরাজ্য। লাশ তিন টুকরো করে মাটিতে পুতে ফেলা, বাদশা মিয়াকে মেরে উলটো করে গাছে লটকে দেওয়া, সারা দেশের জেলায় জেলায় বোমাবাজি - কি না হয়েছে সে সময়। আমাদের ম্যাডাম পেছনে পেছনে বাংলাভাইকে মদদ দিয়ে সামনে এসে বলেছে "বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি"। এই পাঁচ বছরে মহারানী খালেদা জিয়া আর তার সুপুত্র তারেক কোকোরা সম্পত্তির পাহাড় গড়েছিল, তা অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে ভেংগে ফেলেছে। অথচ, "নিরপেক্ষ" তত্তাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়াকে এখনও গ্রেফতার করেনি, করল হাসিনাকে। মানুষের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছে, পাঁচ বছরে দেশটাকে চিপে চুষে ছিবড়া বানিয়ে ছাড়ল খালেদা জিয়া আর তার স্যাঙ্গাতেরা, অথচ ধরা পড়লেন হাসিনা। এ কেমন নিরপেক্ষতা?
তত্বাবধায়ক সরকারকে "মহান" ভাবতে আমারও কোন আপত্তি ছিল না যদি না কিছু সূক্ষ বিষয় আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যেত। আপনি লক্ষ করবেন, খুব কায়দা করে দুর্নীতির অভিযোগ কেবল রাজনীতিবিদ এবং সিভিল জনগণের উপরেই চাপিয়ে দেয়া হ্য়েছে, আর সামরিক "জলপাই বাহিনী" রয়ে গেছে সমস্ত অভিযোগের উর্ধ্বে। এখন পর্যন্ত একজন "জলপাই"কেও দুর্নীতির অভি্যোগে আভি্যুক্ত করা হয় নি। অথচ, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশে এই জলপাই বাহিনীই সবচেয়ে বেশী দুর্নীতি করেছে, ক্ষমতা দখল করেছে, যত পদের লুচ্চামী-লোফারি করা সম্ভব করেছে, রক্তের হলি খেলায় মেতে উঠেছে। অথচ তারা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমাদের এখনকার দায়িত্বপালনরত "দেশপ্রেমিক" জলপাইদের কথা না হয় বাদ দিলাম, এরশাদের মত চরম দুর্ণীতিবাজ থেকে যায় খাঁচার বাইরে। আপনার মনে কোন প্রশ্ন জাগে না, ডালিম হোসেন? জলপাইপ্রীতির মত এ সরকারের সূক্ষ জামাতপ্রীতিও কারো কারো হয়ত চোখ এড়িয়ে যাবে না। জামাত যে "সৎ আদর্শের দল" তা প্রমাণ করতেই বোধ হয় জামাত নেতাদের দুর্ণীতির অভি্যোগে খুব কমই ধরা হয়েছে, অথচ বিগত সরকারের দুর্ণীতির মূল পৃষ্ঠপোষক ছিল জামাত। খুনের মামলা থাকায় হাসিনাকে বিদেশ ভ্রমণ করতে দেওয়া হয়নি, খুব ভাল কথা। কিন্তু একই খুনের মামলা কাঁধে নিয়েই জামাত নেতা আলী আহসান মুজাহিদকে বিদেশ ভ্রমণের সু্যোগ করে দিয়েছে এ সরকার। সরকারের এ ধরনের দ্বিচারিতা কি আপনার বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে জনাব ডালিম? পত্রিকায় নিশ্চয়ই পড়েছেন তত্তাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধেও কিন্তু দুর্ণীতির অভিযোগ আছে। সরকার কিন্তু মইনুল হোসেনের টিকিটিও ধরছে না, বরং এই মইনুল হোসেন এখন তর্জন গর্জন করে দুর্ণীতিবাজদের শায়েস্তা করছেন, সেজেছেন দুর্ণীতির বিরুদ্ধে প্রধান জিহাদী সেনাপতি। 'শর্ষের মধ্যে ভুত' আপনাকে আস্বস্ত করলেও আমাকে করে না, ডালিম।
তারপরেও সাহস করে ভিন্নকথা আমাদের শুনিয়েছেন সেজন্য অজস্র ধন্যবাদ। আর মুক্তমনা লেখক নয়, মানুষ হিসাবে আমার স্ট্যান্ডের কথা আমি আপনাকে জানাতে পারি। হাসিনাকে কেন গ্রেফতার করা হল- এ বলে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে মায়াকান্না আমি কখনই কাঁদব না, এ নিয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। বরং বলব, হাসিনাকে ধরা হয়েছে এবার খালেদার মত মহাচোরকেও ধরা হোক। ধরা হোক জলপাই বাহিনীর হর্তাকর্তাদেরও। ধরা হোক লম্পট-দুর্ণীতিবাজ এরশাদকেও। ধরা হোক মুজাহিদকেও। যারা যারা দুর্ণীতি করেছে, দেশটাকে ছিবড়া বানিয়েছে সব্বাইকে। আর সবশেষে ঐ বাঁচাল মইনুলকেও।
হাসিনাকে ধরে বাদবাকিদের খাঁচার বাইরে রাখলে নিরপেক্ষতা বা মহত্ব কোনটাই প্রকাশিত হয় না। বরং মনের মধ্যে একটা খচখচানি থেকেই যায় - এরা সুঁচ হয়ে ঢুকেছে - এবার হয়ত ফাল হয়ে বেরুবে। প্রত্যাশা করব, আমার আশংকা যেন সত্যি না হয়।আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
জুলাই ২০, ২০০৭