লাইসেঙ্কোইজম

অভিজি রায়

ইমরান হাবিব রুমন নামে এক ভদ্রলোক লাইসেঙ্কোর উপর একটি লেখা পাঠিয়েছেন, তা মুক্তমনায় ছাপাও হয়েছেএটি পড়ে  আমি খুব একচোট হেসে নিলাম।   ভদ্রলোকের লেখা পড়ে আমি বুঝতে পারছি কেন আজকে বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষারএত দুর্গতি লাইসঙ্কোর ভুল মতবাদ যা আজ জেনেটিক্স এবং বিবর্তন বিজ্ঞান থেকে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়েছে আজ নয় - অন্ততঃ পঞ্চাশ বছর আগে,এবং ইতিহাসে তার মতবাদ কুখ্যাত হয়ে আছে লাইসেঙ্কোইজম অভিধায়, আর হঠা করে এতদিন পর  সেই লাইসেঙ্কোকে প্রমোট করতে দেখে হাসি পাওয়ার পাশাপাশি অবাকও হলাম। এ যেন প্রবন্ধ লিখে নতুন করে প্রমাণ করতে আসা কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব নয়, টলেমীর ভূ-কেন্দ্রিক তত্ত্বই সঠিক। এ ধরনের প্রন্ধের উত্তর দিতে গিয়েই কি নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী পাউলি মন্তব্য করতেন -  ‘These theories are so bad that they are not even wrong’?  লাইসেঙ্কো অনেকদিন ধরেই ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছেন এক ‘ঠগ’ বিজ্ঞানী হিসেবে, দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন রাজনৈতিক শক্তির অপব্যাবহারকারী এবং ‘বিজ্ঞানেরর পাঙ্গামারা’ উগ্র কমিউনিস্ট ভাবাদর্শধারীদের দ্বারা চালিত রাষ্ট্রশক্তির এক পতিত ক্রীড়নক হিসেবে।  খুবই হতাশাজনক যে, সেই বহুল-বর্জিত, অপাংক্তেয় লাইসেঙ্কো সাহেবের পরিত্যক্ত এবং  বাতিল তত্ত্বের গুনগান গেতে এসেছেন রুমন সাহেব এই একবিংশ শতকে এসে তথাকথিত আদর্শের নামে। তিনি বলেছেন, ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্য নাকি লাইসেঙ্কো খুবই জরুরী!   তার মতে মেন্ডেলের বংশগতি তত্ত্ব নাকি ছিল ভাববাদী’, আর এই ভাববাদী চেতনার মুলে কুঠারাঘাত করেছিলেন লাইসেঙ্কো!   তাই নাকি?

 

বাংলাদেশে কিছু বাম ভাবধারার লোকজন আছেন যারা আধুনিক বিজ্ঞান সম্বন্ধে একেবারে অক্ষর গোমাংসযারা ভাবেন বিজ্ঞান বুঝি কেবল আদর্শ দিয়ে চালিত হয়এরা সুযোগ পেলেই অমুক বিজ্ঞান ভাববাদী, তমুক বিজ্ঞান বুর্জোয়া ইত্যকার বিশেষনে বিশেষিত করে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে খাটো করে প্রমাণ করতে চান তার চেয়ে নিজেদের নিজ নিজ মতাদর্শ বিজ্ঞানের থেকে অনেক উন্নততর  কখনো এরা বিজ্ঞানকে ছুঁড়ে ফেলতে ধর্মের কোলে আশ্রয় নেন, কখনো বা আশ্রয় নেন  অন্য বস্তাপঁচা বাতিল হয়ে যাওয়া আদর্শের কিংবা অপবিজ্ঞানের। এ যুগে এসে পতিত  লাইসেঙ্কোকে নিয়ে রুমন সাহেবদের মাতামাতি আমার সেরকমই মনে হয়েছে।  এরা বোঝেন না, বিজ্ঞান কোন আদর্শ দিয়ে চালিত হয় না। বিজ্ঞান টিকে আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। মোটা দাগে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদ্ধতির অনুক্রমটি হল এরকম –

 

১) প্রকৃতিক ঘটনা বা প্রপঞ্চের পর্যপেক্ষণ করা

২) প্রপঞ্চের কারণ অনুমান করে একটা সাময়িক বা অস্থায়ী ব্যাখ্যা বা অনুকল্প প্রদান ।

৩) কৃত্রিম পরিবেশে পরীক্ষা করা। পরীক্ষা থেকে পাওয়া যায় ডেটা বা উপাত্ত।

৪)  প্রাপ্ত উপাত্ত পূর্বোক্ত অনুকল্প বা অনুসিদ্ধান্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপুর্ণ কিনা তা যাচাই করা।

৫) প্রাপ্ত উপাত্তের বিশ্লেষণ অনুকল্পটির সাথে মিলে গেলে বার বার পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করা হয়। এতে কোন ব্যতিক্রম না পাওয়া গেলে অনুকল্পটিকে ‘তত্ত্ব’ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। আর অনুকল্পের সাথে উপাত্তের বিশ্লেষন না মিললে পূর্বের অনুকল্পটি বাতিল করা হয় এবং শুরু হয় নতুন অনুকল্পের অনুসন্ধান। 

৬)  তত্ত্ব থেকে আরো নতুন নতুন অনুসিদ্ধান্তে বা অবরোহে উপনীত হওয়া, পূর্বাভাস প্রদান করা। নতুন পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ দ্বারা বারংবার এগুলো সঠিক বলে প্রমাণিত হলে, প্রপঞ্চটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য কিছু প্রপঞ্চকে তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করতে পারলে, তত্ত্বটিকে প্রকৃতিক আইনের (Natural Law) মর্যাদা প্রদান করা হয়।

 

 কাজেই বিজ্ঞান ভাববাদ কিংবা ভাগ্যবাদের উপর টিকে নেই – টিকে আছে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নির্ভর নিগূঢ় পদ্ধতির উপরে।   বিজ্ঞানে কোন পয়গম্বর নেই, নেই কোন পুরোহিত - পরীক্ষা নিরীক্ষার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ না হলে যে কোন পয়গম্বরের তত্ত্ব এখানে বাতিল হয়ে যায় – তা যতই আদর্শবাদী কিংবা ‘মনোমুগ্ধকর’ ঠেকুক না কেন কারো কারো কাছে।  পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি বলেই ল্যামার্কিজম এবং লাইসেঙ্কোজম একসময় বাতিল হয়ে গেছে, আর মেন্ডেল আর ডারউইনের তত্ত্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই এখন জীববিজ্ঞানে এখন বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে। আজকে যে কোন জীববিজ্ঞানের মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক লেভেলের পাঠ্যবই খুললেই  মেন্ডেলের তত্ত্ব পাওয়া যাবে।  মেন্ডেলের বংশগতি তত্ত্ব খুব গুরুত্ব দিয়ে  দিয়ে ছাত্রদের পড়ানো হয় সব জায়গাতেই, সব দেশেই – তা রুমন সাহেবদের কাছে যতই ‘ভাববাদী’ ঠেকুক না কেন। আর রুমন সাহেবের দীক্ষাগুরু লাইসেঙ্কো নিক্ষিপ্ত হয়েছেন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।

 

যারা লাইসেঙ্কো এবং লাইসেঙ্কোজম সম্বন্ধে সম্যক অবগত নন, তাদের জন্য এর বিবর্তনের ইতিহাস  একটু বয়ান করা যেতে পারে এ প্রসঙ্গে।  ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব একাডেমিয়ায় স্বীকৃত হলেও ডারউইনের সময় পর্যন্ত বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক কিভাবে কাজ করে কিংবা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চালিত হয় তা সম্পের্ক বিজ্ঞানীদের কোন স্পষ্ট ধারণাই ছিলো না ল্যামার্ক ১৭৪৪- ১৮২৯) নামের এক বিজ্ঞানী তত্ত্ব দেন যে,  অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো স্রেফ পরিবেশের ফল। জীবের যে অংগগুলো তার জীবনে বেশি ব্যবহূত হয় সেগুলো আরও উন্নত হতে থাকে, আর যেগুলোর বেশী ব্যবহার হয় না সেগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয় বা বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যায়তার মধ্যে একটা অত্যন্ত জনপ্রিয় উদাহরণ হচ্ছে জিরাফের গলা লম্বা হয়ে যাওয়ার কেচ্ছা কাহিনী। জিরাফের গলা লম্বা হওয়ার ল্যামার্কীয় ব্যাখ্যা হল -  ‘লম্বা লম্বা গাছের ডগা থেকে কঁচি পাতা পেরে খাওয়ার জন্য কসরত করতে করতে বহু প্রজন্মের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে জিরাফের গলা লম্বা হয়ে গিয়েছে’ অর্থা, ল্যামার্কের তত্ত্বের মূল কথা ছিল – অভিযোজনের কারণ হল পরিবেশের প্রত্যক্ষ প্রভাবে দেহের অংগসমূহের পরিবর্তন ঘটা।  ল্যামার্ক আরও বললেন যে, একটি জীব তার জীবদ্দশায় ব্যবহার বা অব্যবহারের ফলে যে বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করে সেগুলো তার পরবর্তী প্রজন্মে বংশগতভাবে সঞ্চারিত হয় কিন্তু এটা কি ঠিক ব্যাখ্যা হল? কিন্তু ডারউইন এটা ঠিকই বুঝে ছিলেন যে, কোন অঙ্গের ব্যবহারের উপর নির্ভর করে জীবের বিবর্তন ঘটে না, প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করার জন্য শুধুমাত্র বংশগতভাবে যে বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মে দেখা যায় তারাই দায়ীযে বৈশিষ্ট্যগুলো আপনি আপনার পূর্বপুরুষের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আপানার দেহে পান নি, তার উপর বিবর্তন কাজ করতে পারে না সেজন্যই মানুষ যতই চেষ্টা করুক কিংবা হাজার কসরত করুক তার পীঠের হাড্ডী পরিবর্তিত হয়ে পাখায় রূপান্তরিত হয়ে যায় না।  আমার পায়ে জুতা পড়তে পড়তে ঠোসা গজালে, আমার বাচ্চার পায়েও ঠোসা গজায় না। 

 

এখানেই সমস্যার সমাধান নিয়ে আসেন গ্রেগর মেন্ডেল (১৮২২-১৮৮৪), যিনি ১৮৬৫ সালেই তার মত করে আধুনিক জিনতত্ত্বটি (যদিও তিনি 'জিন' শব্দটি কথাও উল্লেখ করেন নি) প্রস্তাব করেছিলেনতিনি মটর গাছ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে ১৮৬৬ সালে বংশগতির মৌলিক নিয়মগুলো আবিস্কার করেন, যদিও তার কাজের কথা ১৯০০ সাল পর্যন্ত অজানাই থেকে যায়। তিনি মা বাবার দুজনের মধ্যে বিদ্যমান বংশগতির একক বা বৈশিষ্ট্যগুলোকে 'ইউনিট ক্যারেক্টর' বলে আভিহিত করেছিলেন, তবে, পরবর্তীতে ১৯০৯ সালে উইলিয়াম জোহান্সেন একে জিন হিসেবে নামকরণ করেনমেন্ডেল দেখালেন যে, ছেলে মেয়ের প্রত্যেকটা বংশগত বৈশিষ্ট্য মা বাবার কোন না কোন 'ইউনিট ক্যারেক্টর' দিয়ে নির্ধারিত হচ্ছেবাবা মার কোষের ভিতরের এই ফ্যাকটর বা জিনগুলো একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তাদের সন্তানদের মধ্যে প্রবাহিত হয়এখন আমরা জানি যে, জিন হচ্ছে ডিএনএ দিয়ে তৈরি বংশগতির একক, যার মধ্যে কোষের বিভিন্ন রকমের তথ্য বা কোড জমা থাকেবাবা এবং মার যৌন কোষে এই জিনগুলো থাকে, তাদের ছেলে মেয়েরা নিজেদের প্রত্যেকটা বৈশিষ্ট্যের জন্য দুজনের থেকে একটা করে জিন পেয়ে থাকেএই জিনগুলোর মধ্যে কোনরকম কোন মিশ্রণ ঘটে না এবং একটা বৈশিষ্ট্যের জিন আরেকটার উপর কোনভাবে নির্ভরশীল নয়

 

অর্থা, আমার চোখের রং-এর বৈশিষ্ট্যের সাথে নাকের আকারের বৈশিষ্ট্যের কোন সম্পর্ক নেই, প্রত্যেকটা বৈশিষ্ট্যের জিন আলাদা আলাদা - স্বতন্ত্রভাবে কাজ করেউত্তরাধিকার সুত্রে  আমি আমার বাবা বা মার কাছ থেকে কোন একটা জিন  পেলে পাবো, নয়ত পাবো না - এর মাঝামাঝি কোন ব্যবস্থা এখানে নেইএভাবেই, জিনগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ‘ইউনিট ক্যারেক্টার’ হিসেবে প্রবাহিত হয়ে আসছে বিভিন্ন জীবের মাঝে – মিশ্রিত না হয়েইডঃ রিচার্ড ডকিন্‌স খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এই ব্যাপারটাকে -

 

‘একেকটি বিচ্ছিন্ন জিন একে অপরের সাথে 'পুডিং-এর উপাদানগুলোর' মত ভর্তা হয়ে না মিশে বরং তাসের প্যাকেটে রাখা তাসের মত 'সাফল্‌' করে করে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে

 

আর এই আবিষ্কারটির ফলেই বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এসে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব সম্পর্কে অন্যতম প্রধান বিরোধটির নিরসন হলো।  বিজ্ঞানীরা কেবল তত্ত্ব দিয়েই দেখেননি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও দেখেছেন ল্যামার্কের তত্ত্ব ভুল, মেন্ডেলের বংশগতির তত্ত্বই ঠিক।  যেমন, জার্মান জীববিদ আগস্ট ভাইজমান জন্মের সাথে সাথে সাদা রঙের ছোট জাতের ইদুর ছানার লেজ কেটে দিয়ে বাইশটি প্রজন্মে সদ্য-ভূমিষ্ট ছানার লেজের দৈর্ঘ্য কমে কিনা তা মেপে দেখলেন। দেখা দেল, সদ্যভূমিষ্ট ছানার লেজের দৈর্ঘ্য কমেনি বা বাড়েনি।  এ পরিক্ষা থেকে ভাইজমান পরিস্কারভাবে দেখালেন, জীবদেহে পরিবেশ দ্বারা উপন্ন প্রভাব বংশানুসৃত হয় না। এভাবে তিনি ল্যামার্কবাদের মূল-ভিত্তিটি ধ্বসিয়ে দেন।  ভাইজম্যানের পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করেছিলেন বিজ্ঞানী বস এবং শেফার্ডসও। তারাও যথাক্রমে ইদুর এবং কুকুরের কান কেটে কেটে পরীক্ষাটি চালিয়েছিলেন। তারাও একই রকম ফলাফল পেয়েছিলেন। এরকম পরীক্ষা কিন্তু মানুষ বহুকাল ধরেই করে এসেছে। যেমন, ডোবারম্যান কুকুরের লেজ কেটে ফেলা, ইহুদী এবং মুসলমান বালকদের খনা করা,  চীনদেশে একসময় প্রচলিত প্রথা অনু্যায়ী মেয়েদের পা ছোট রাখার জন্য লোহার জুতো পড়ানো, অনেক আফ্রিকান দেশে মেয়েদের ভগাঙ্গুর কেটে ফেলা, উপমহাদেশে মেয়েদের নাকে এবং কানে ছিদ্র করা ইত্যাদি। কিন্তু এর ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আকাংকিত লক্ষণটির আবির্ভাব হয় নি।  ল্যামার্কের তত্ত্ব সঠিক হলে তাই ঘটার কথা ছিলো।

 

আর অন্যদিকে, গত একশ বছরে জেনেটিক্স এবং মাইক্রো-বায়োলজী বা অনু-জীববিদ্যা এগিয়ে গেছে অকল্পনীয় গতিতে, ক্রোমোসোম, ডিএনএ এবং মিউটেশন থেকে শুরু করে মানুষের জিনোমের পর্যন্ত হিসাব বের করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে মেন্ডেলের তত্ত্বের সার্থকতাডিএনএর আবিষ্কারসহ বংশগতিবদ্যা, জনপুঞ্জ বংশগতবিদ্যা , বা জিনোমিক্সসহ জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যত এগিয়ে গেছে ততই আরও বিস্তারিতভাবে মেন্ডেলের বংশগতি তত্ত্ব এবং বিবর্তন তত্ত্বের সঠিকতা প্রমাণিত হয়েছে মেন্ডেলীয় বংশবিদ্যার কারণেই বিজ্ঞানীরা আজ ‘জিন’ নামে অভিহিত বংশগতীয় দ্রব্যের কাজ, আচরণ এবং প্রকৃতি অনুসন্ধান করতে পারেন, তারা বুঝতে পারেন জিনে হঠা কোন স্থায়ী পরিব্যক্তি বা মিউটেশন ঘটলে তা কিভাবে, কোন নিয়মে বংশানুক্রমিত হয় তা নির্ণয় করতে পারেন, ক্রোমোজমে জিনের অবস্থান, বিন্যাস ও সংযুক্তি বের করতে পারেন।  মেন্ডেলের বংশবিদ্যার গবেষণার কারণেই আজ খুলে গেছে আনবিক বংশগতিবিদ্যার রুদ্ধ দুয়ার।  তৈরি হয়েছে  বংশগতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণার বিভিন্ন শাখা – অনুজীবীয় বংশগতিবিদ্যা, ব্যাকটেরীয় বংশগতিবিদ্যা, ড্রসোফিলা বংশগতিবিদ্যা কিংবা মানব বংশগতিবিদ্যা। জৈবসংগঠনের পর্যায় বা স্তরভেদে এর শাখা আছে – আনবিক বংশগতিবিদ্যা, প্রাণ বংশগতিবিদ্যা, বিকাশীয় বংশগতিবিদ্যা, জনপুঞ্জ বংশগতিবিদ্যা, প্রতিরোধীয় বংশগতিবিদ্যা, পরিবেশ বংশগতিবিদ্যা এবং ইকোলজিকাল বংশগতিবিদ্যা ইত্যাদি।  মেন্ডেলের তত্ত্বের সাফল্য কি কেবল ভাববাদ কিংবা ভাগ্যবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় নাকি ‘বুর্জোয়া বিজ্ঞান’  নামে অভিহিত করে প্রতিরোধ করা যায়?

 

 

পরীক্ষা-নিরীক্ষায়  উত্তীর্ণ না হতে পারায় উনবিংশ শতকের প্রথম দিকেই ল্যামার্কবাদের মৃত্যু ঘটে যায়, আর টিকে থাকে কেবল মেন্ডেলের বংশগতির আলোকে আধুনিক বিবর্তনবাদ।  ব্যাতিক্রম থেকে যায় কেবল ‘মার্ক্সবাদী’ সোভিয়েত ইউনিয়ন।  সেদেশে ত্রিশ চল্লিশের দশকে মার্ক্সবাদী নেতাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন পুঁজি করে ল্যামার্কিজমের ‘ভুডু সায়েন্স’ এর চর্চার নেতৃত্ব দিয়ে যান ত্রসিম দেনিসোভিক লাইসেঙ্কো  (Trofim Denisovich Lysenko)।  আমি ‘মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?’ নামক প্রবন্ধে দেখিয়েছিলাম সোভিয়েত নেতৃত্ব সেসময় জেনেটিক্স বা মেন্ডেলের বংশগতিকে পাত্তা না দিয়ে কেবল ল্যামার্কের পরিবেশ নির্ণয়বাদকে আদর্শ হিসেবে মনে করতেন,  কারণ তা তাদের 'সাম্যবাদের বাণী' প্রচারে সহায়তা করে – সব মানুষ সমান; মানুষের ভাল, খারাপ লোভ লালসা - কেবল  পরিবেশের ফল! আর এ কারণেই মার্ক্স কিংবা তার পরবতী তাত্ত্বিক কমিউনিস্টরা তাদের অনেক বাণীতেই এটাই জোরের সাথে বলেছিলেন যে মানুষের সকল বৈশিষ্ট্যই পরিবেশের কারণ,  এর সাথে বংশের কোন যোগ নেইলেনিন (১৮৭০-১৯২৪) এবং তার সমসামিয়ক নেতারা ভাবতেন, বিজ্ঞানকেও ‘মার্ক্সিজমের ছাকুনি’র মধ্য দিয়ে যেতে হবে, নইলে পরিশুদ্ধ হবে না!  এ প্রসংগে জন গ্রান্ট তার ‘করাপ্টেড সায়েন্স’ গ্রন্থে লিখেছেন –

 

A peasant amateur agronomist called Trofim D Lysenko came upon the scene, and it was the USSR’s considerable misfortune that he did so at a time when earlier foolish ideas of V. I. Lenin that science should be in accordance with such Marxist and Engelian concepts as dialectical materialism were being hardened into political dogma by Stalin. A corollary of Marxism is that human nature can be mounded: such motivation as greed and ambition can be sublimated to serve society as a whole rather than just an individual. The essential madness of Lysenko was in thinking that the basic nature of plants (i.e. their genetic coding) could be mounded in the same way. That he should use Marxism as a guide in this and in much else was not illogical, in a way, because under the Soviets, Marxism was regarded as itself a science! ’।

 

সোভিয়েত ইউনিয়নে লাইসেঙ্কোর উত্থান একেবারে শূন্য থেকে ঘটেনি। তিনি আবার কৃপাধন্য ছিলেন ভ্লাদিমিরোভিচ মিচুরিয়ান নামের আরেক জোচ্চর বিজ্ঞানীর। দার্শনিক এবং রাজনৈতিক কারণে ভ্লাদিমিরোভিচ মিচুরিয়ান বংশগতিকে ঘৃণার চখে দেখতেন। কিন্তু তার মতামত পার্টির মতাদর্শের সাথে ‘সঙ্গতিপূর্ণ’ থাকায় তিনি পার্টির প্রিয়পাত্র ছিলেন।  মিচুরিয়ানের হাইব্রিডাইজেশনের বিভিন্ন পরীক্ষার অসারতা রাশিয়ার প্রখ্যাত জেনেটিক্স জানা বিজ্ঞানীরা তখনই ধরিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু মিচুরিয়ান পার্টির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে সমস্ত বিজ্ঞানীদের ‘মিথ্যুক’ হিসবে প্রতিপন্ন করেন।

 

এই মিচুরিয়ানেরই যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন লাইসেঙ্কো। তিনি ভার্নালাইজেশন নামক একটা প্রক্রিয়াকে প্রমোট করলেন প্রজাতির পরিবর্তনের পেছনে। তিনি দাবী করলেন  ভার্নালাইজেশনের প্রভাবে প্রজাতির চরিত্রও বদলে দেয়া সম্ভব।  তিনি মনে করতেন মেন্ডেলবাদ আর তার বংশগতিতত্ত্ব ভুল। বলতেন, ক্রোমোজম বা তাতে স্থিত জিন নয়, জীবের বৈশিষ্ট নিয়ন্ত্রণ করে আসলে সাইটোপ্লাজম।  আর সাইটোপ্লাজম তা করে থাকে জীবের বিপাকক্রিয়া বা মেটাবলিজম দিয়ে।  এখন বিপাক ক্রিয়া যেহেতু পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, অতএব বংশগতিও পরিবেশ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে। এই হচ্ছে সাদামাঠাভাবে লাইসেঙ্কোর মার্ক্সবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ‘বৈজ্ঞানিক’ তত্ত্ব, যা তিনি তৈরি করেছিলেন ১৯৩৫ সালের দিকে।  তবে তার গবেষণার ফলাফল প্রখ্যাত জার্নালে প্রকাশ না করে নিউজপেপারে পাঠাতেন আর সাধারণ মানুষ আর ক্ষমতালোভী রাষ্ট্রযন্ত্রের পুরোধা শক্তিকে কাজে লাগাতেন নিজের পদ সুরক্ষিত রাখতে (একই ধরনের ঘটনা আজ আমরা দেখি বুশের জামানায় – ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনকে’ বিবর্তনবাদের বিপরীতে প্রমোট করার দুরভিসন্ধিতে)।  লাইসেঙ্কো পরে নিজের মুখপত্র হিসেবে Yarovizatya নামে  একটা বৈজ্ঞানিক জার্নাল কুক্ষিগত করে এর সম্পাদনা শুরু করেন।

 

 

জারের আমল থেকেই রাশিয়ায় ডারউইনবাদ আর বংশবিদ্যা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলো। রাশিয়া ছিলো জেনেটিক্সের গবেষনায় শীর্ষস্থানে। কিন্তু লাইসেঙ্কো নামের ঠগ বিজ্ঞানীর আগমনে আর সমাজতন্ত্রের ‘ছাকুনির’ পাল্লায় পড়ে রাশিয়ায় জেনেটিক্সের বারোটা বেজে যায়।  স্বাভাবিকভাবেই যে সমস্ত বিজ্ঞানীরা বংশগতির আধুনিক গবেষণা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন, তারা লাইসেঙ্কোর অবৈজ্ঞানিক মতবাদের বিরোধিতা শুরু করেন। কিন্তু লাইসেঙ্কো সে সমস্ত বিজ্ঞানীদের বুর্জোয়া ‘মেন্ডেল-মগার্নবাদের’ সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের কন্ঠরোধ করে দেন।  ১৯৪৮ সালে সারা সোভিয়েত কৃষিবিজ্ঞান  একাডেমির কংগ্রেসে এ বিষয়ে প্রকাশ্য বিতর্ক হয়। লাইসেঙ্কো এতে নতুন একটি অস্ত্র ব্যবহার করেন। তিনি ঘোষণা করেন,

 

আমার তত্ত্ব অনুযায়ী বসন্তকালীন গমকে শীতকালীন গমে রূপান্তর করা গিয়েছে, এবং এর ফলে উত্তরের শীতপ্রধান যে সমস্ত অঞ্চলে গম চাষ করা যাচ্ছে না, সেখানেও তা করা যাবে। এতে সমস্ত দেশে কৃষিবিপ্লব হয়ে যাবে।

 

আর যায় কোথায়। ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ ধ্বজাধারী  সৈনিকেরা লাইসেঙ্কোর মধ্যে মার্ক্সিজমের জয় জয়কার খুঁজে পেলেন। স্ট্যালিনের উদ্যোগে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি লাইসেঙ্কোর মতের সমর্থনে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সুতরাং লাইসেঙ্কোর তত্ত্ব অফিশিয়ালি ‘মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ’ সম্মত হয়ে যায়।  তাকে মস্কো ইন্সটিটিউট অব জেনেটিক্সের ডাইরেক্টর করে দেয়া হয়।  আর লাইসেঙ্কোর নির্দেশেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত গবেষণা পরিচালনা করা হতে থাকে।  ১৯৪৮ সালে লাইসেঙ্কো খোদ ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের’ বিরুদ্ধেই জিহাদ শুরু করেন, আর বলতে থাকেন এই সমস্ত ‘কম্পিটিশন’, আর ‘সার্ভাইভাল অব ফিটেস্ট’-এর মত ব্যাপার স্যাপার হচ্ছে বুর্জোয়া জিনিস – এগুলো মার্ক্সিজমের ‘সহমর্মিতা’  এবং ‘সহযোগিতা’র সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।  তিনি হরমোনের অস্তিত্বও অস্বীকার করেন এবং হরমোন প্রয়োগে  দেহহত কোন পরিবর্তনকেও  অস্বীকার করতেন।  আর তিনি যা করতেন সবই পার্টি কর্তৃক বাহবা পেয়ে যেত।

 

এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। সোভিয়েত ইউনিয়নে মেন্ডেলীয় বংশগতির চর্চা নিষিদ্ধ হয়ে যায়।  লাইসেঙ্কোর বিপরীত মতের সমর্থক বিজ্ঞানীদের সবাইকে গণহারে চাকুরীচ্যুত করা হয়।  অনেকেই গ্রেফতার হন। এদেরকে নানাভাবে স্ট্যালিনীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়।  এন আই ভাভিলভের (১৮৮৭-১৯৪১) মত বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীকে গুলাগে  ঢুকিয়ে পচিয়ে মারা হয়।  শুধু ভাভিলভ নয়, জি ডি কার্পেচেঙ্কো (১৮৯৯-১৯৪১),  সালোমন লেভিট, ম্যাক্স লেভিন, ইজ্রায়েল এগোল – এমনকি আমেরিকান বংশগতিবিদ এইচজ়ে মুলারের (১৮৯০-১৯৬৭) মত বিজ্ঞানী এবং ‘কমিটেড কমিউনিস্ট’কে  ‘বুর্জোয়া’ আখ্যা দিয়ে  দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়।  কৃষিক্ষেত্রে লাইসেনঙ্কোর ভুল ভাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর স্ট্যালিনীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় এক কোটি লোক মারা যায়।  কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, এত লোকের মৃত্যু দেখেও সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের কোন বোধদয় হয়নি। তারা দুধ কলা দিয়ে বছরের পর বছর লাইসেঙ্কোকে পুষেছেন আর মার্ক্সিজমের মোড়কে পুরে লাইসেঙ্কোজমের চর্চাকে উসাহিত করেছেন।  ‘মার্ক্সিস্ট বিজ্ঞানের’ সাথে বাস্তবতা না মিললে বাস্তবতাকেই ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছেন। 

 

এমনকি স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরও লাইসেঙ্কো প্রথম দিকে নিকিতা ক্রুশ্চেভের (১৮৯৪-১৯৭১) কৃপা পেয়ে গেছেন দেদারসে।  তারপরও কালের করাল গ্রাসে সবকিছুরই একময় শেষ আসে। সমাপ্তি আসে লাইসেঙ্কো জামানারও। মূলতঃ ক্রুশ্চেভের  সময় থেকেই সোভিয়েত নেতৃত্ব বুঝতে শুরু করলেন লাইসেঙ্কোইজমের প্রয়োগে তাদের কৃষিক্ষত্রের বারোটা বেজে যাচ্ছে। লাইসেঙ্কীয় তুক তাক, ঝাড়ফুক আর অপবিজ্ঞান দিয়ে  কৃষিকে আর টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।  পশ্চিমা ‘বুর্জোয়া হরমোন ট্রিটমেন্ট’ (যেটাকে লাইসেঙ্কো অস্বীকার করতেন) করে যে ভেড়ার পালের দৈহিক পরিবর্তন করা সভব – তা রাশিয়ার বিজ্ঞানীরাই দেখিয়ে দিচ্ছিলেন।  ফলে লাইসেঙ্কোর পতন হয়ে উঠে অবশ্যাম্ভাবী।  ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত একাডেমী অব সায়েন্স লাইসেঙ্কো নামক ওঝাকে সরিয়ে এক সত্যিকার বায়োলজিস্টকে এর প্রধান করতে মনস্থ করে।  এর ফলে জেনেটিক্স আবার রাশিয়ায় পুনর্স্থাপিত হয়। লাইসেঙ্কো আর তার ঘি-মাখন খাওয়া সাঙ্গপাঙ্গদের বিভিন্ন পদ থেকে অপসারণ করা হয়।  লাইসেঙ্কোর পতন  হয়ে দাঁড়ায় কেবল সময়ের ব্যাপার।

অথচ, রুমন সাহেব দুঃখ করে লিখেছেন,

 

‘লাইসেংকো আজ জীবিত নেইকিন্তু তাঁর জীবদ্দশাতেই তাকে থামিয়ে দেয়া হয়েছিল ষ্ট্যালিনের মৃত্যুর পরেই ক্রুশ্চেভ নেতৃত্ব লেলিন রিসার্চ সেন্টারের পদ থেকে লাইসেংকোকে অপসারিত করে উক্ত প্রতিষ্ঠানে তাঁর চিন্তাধারার গবেষণার কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়’।

 

আহারে কি দুঃখ! ‘তাঁর জীবদ্দশাতেই তাকে থামিয়ে দেয়া হয়েছিল’ লাইসেঙ্কোর জন্য প্রাণ যেন পুড়ে যাচ্ছে একেবারে! মনে হচ্ছে যেন ষড়যন্ত্র করে লাইসেঙ্কোকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। চিরন্তন বাম ঘরনার চিন্তাবিদদের মত তিনিও সব কিছুতেই ষড়যন্ত্র খুঁজে পাচ্ছেন।  না লাইসেঙ্কোর প্রতি কোন ষড়যন্ত্র করা হয়নি, হয়নি কোন অন্যায়।  তার কর্মকান্ডই তৈরি করেছিলো তার পতনের প্রেক্ষাপট। বরং লাইসেঙ্কো যে বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে এতদিন রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায় টিকে ছিলো সেটাই চরম বিস্ময়।  ১৯৬২ সালেই Yakov Borisovich Zel'dovich, Vitaly Ginzburg, এবং Pyotr Kapitsa  বিজ্ঞানীরা  লাইসেঙ্কোর কাজকে ‘ভুয়া বিজ্ঞান’ বা ‘অপবিজ্ঞান’ আখ্যায়িত করে তাদের সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেন।  ১৯৬৪ সালে নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আদ্রে শাখারভ জেনারেল এসেম্বলি অব সায়েন্সের একটি সভায় প্রকাশ্যেই বলেন –

 

He (Lysenko) is responsible for the shameful backwardness of Soviet biology and of genetics in particular, for the dissemination of pseudo-scientific views, for adventurism, for the degradation of learning, and for the defamation, firing, arrest, even death, of many genuine scientists.’।

 

 

১৯৬৫ সালের সোভিয়েত মিনিস্ট্রি অব এগ্রিকালচার এবং সোভিয়েত একাডেমী অব সায়েন্স যৌথভাবে একটি প্যানেল নির্মাণ করে  লাইসেঙ্কোর বিভিন্ন দাবীর যথার্থতা পরীক্ষা করতে উদ্যোগী হয়।  সে প্যানেল কিছুদিনের মধ্যেই প্রমাণ পান যে লাইসেঙ্কোর বহু দাবীর পেছনে ছিল আসলে ব্যাপক পরিমাণে জোচ্চুরী (scientific fraud)।  লাইসেঙ্কোকে সোভিয়েত একাডেমী অব সায়েন্স-এর ইন্সটিটিউট অব জেনেটিক্সের ডাইরেক্টর পদ থেকে অপসারণ করা হয় –যেটা তিনি ১০৪০ সাল থেকে একচ্ছত্রভাবে অধিকার করে রেখেছিলেন।  শিক্ষাক্ষেত্র থেকে লাইসেঙ্কোর সমস্ত মতবাদকে অপসারণ করে  সেই ‘পুঁজিবাদী জেনেটিক্স’ -  মেন্ডেলীয় বংশগতিবিদ্যাকে পুনর্স্থাপিত করা হয় অচীরেই। কিন্তু ততদিনে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা জেনেটিক্সের যে শীর্ষস্থানটি হারিয়েছিলেন তা আর ফের পাননি।  ড আখতারুজ্জামান তার ‘বিবর্তনবিদ্যা’ বইয়ে লিখেছেন – ‘কে বলবে পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনে আসলে লাইসেঙ্কোজমের অবদান কতটুকু!’

 

রুমন সাহেব তার প্রবন্ধের শেষে এসে অনাবশ্যক ভাবে আমাকে আক্রমণ করেছেন,  তীর্যক ব্যাঙ্গ করে বলেছেন

 

‘শুধুমাত্র ষ্টালিনের সময়কার বিজ্ঞানী বলেই লাইসেংকো সম্পর্কে বিশিষ্ট (!) বিজ্ঞান লেখক জনাব অভিজি রায়-এর মন্তব্য কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা সহজেয় অনুমেয়’।

 

এই অনাবশ্যক ব্যাঙ্গ এবং শ্লেষের উত্তর দেওয়ারও আমার প্রয়োজন নেই।  আমি কখনই নিজেকে ‘বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক’ ভাবি না। ভদ্রলোককে কি করে বোঝাই, ‘শুধুমাত্র ষ্টালিনের সময়কার বিজ্ঞানী বলেই’  আমি লাইসেঙ্কোর বিরোধিতা করিনি। লাইসেঙ্কোর বিরোধিতা করেছি তার তত্ত্বের মাধ্যমে বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞান প্রমোট করার কারণে, আর সোভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্রীড়নকে পরিনত হয়ে বিজ্ঞানের বারোটা বাজানোর পাশাপাশি বহু নিরপরাধ মৃত্যুর কারণ হওয়ায়।  রুমন সাহেব কি সেটা অনুধাবন করতে পারবেন?

 

লাইসেঙ্কোজমের তত্ত্ব সঠিক বলা মানে কোপার্নিকাসের বিপরীতে টলেমীর ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বকে সঠিক বলার মত শোনায় আজ শুধু আদর্শবাদ দিয়ে মিথ্যে তো ঢেকে রাখা যায় না।  তারপরও যুগে যুগে আদর্শবাদের জাতাঁকলে পিষ্ট হয়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে এগুতে হয়েছে বিজ্ঞানকে নিরন্তর।  স্ট্যালিনের রাশিয়ায়, হিটলারের জার্মানীতে কিংবা বুশের আমেরিকায়  এ দৃষ্টান্ত আমরা হরহামেশা দেখেছি।  বিজ্ঞানকে ভবিষ্যতে মুক্ত হতে হবে এ সমস্ত আদর্শবাদীদের খপ্পর থেকে।  কোন ধর্ম, দর্শন কিংবা  রাজনৈতিক মহল বিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করলে বিজ্ঞানের যে আদপে কোন উন্নতি হয় না – লাইসেঙ্কোর বিয়োগান্তক পরিণতি আমাদের সে শিক্ষাই দেয়।

নভেম্বর ০১,

 


. অভিজি রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজ' গ্রন্থের লেখক সাম্প্রতিক প্রকাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ – ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’। সম্প্রতি 'বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়?' শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত।  ইমেইল : [email protected]