মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?*
(উৎসর্গ : স্ট্যালিন জামানায় নির্যাতিত দার্শনিক সলঝনেৎসিনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে)
মুক্তমনায় সম্প্রতি প্রকাশিত শঙ্কর রায়ের অত্যন্ত সুলিখিত ‘মার্ক্সবাদ, বিজ্ঞান ও ধর্ম’ শীর্ষক লেখাটি পড়বার থেকেই এ নিয়ে কিছু লিখবার তাগিদ বোধ করছি। কার্ল মার্ক্স উনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ বিশেষজ্ঞ। শ্রেণীহীন শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিল একসময় বিশ্বের বহু মুক্তিকামী মানুষকে। ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সুস্থ আলোচনা আজো তাই প্রাসঙ্গিক। লেখাটি মিঃ রায় মুক্তমনার সাম্প্রতিক সংকলন গ্রন্থ ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়?’-এ অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রদান করেছেন। এ প্রবন্ধটি বইয়ে আলাদা উপযোগ তৈরী করবে নিঃসন্দেহে।
ছবিঃ কার্ল মার্ক্সমার্ক্সের দর্শনে তিনটি সমকালীন ধারণার প্রভাব ছিলো। একটি হচ্ছে হেগেল, কান্ট এবং ফয়েরনেখের জার্মান দর্শন – যা মার্ক্সকে দিয়েছিলো তার দ্বন্দিক বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তি, অন্যটি হচ্ছে উনবিংশ শতকের ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডোর অর্থনৈতিক তত্ত্ব – যা মার্ক্সকে অনুপ্রাণিত করেছিলো তার অর্থনৈতিক তত্ত্ব সাজাতে আর সর্বোপরি ফরাসী বিপ্লবের চিন্তাধারা তাকে দিয়েছিলো তাকে বাৎলে দিয়েছিলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব নির্মাণের পথ। মার্ক্স বলতেন, ‘এতদিন ধরে দার্শনিকেরা পৃথিবীকে কেবল ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল কাজ হল একে পরিবর্তন করা।’ মার্ক্স তার জীবদ্দশায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আর্থসামাজিক বিন্যাস লক্ষ্য করেন।
এই পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শোষণমূলক এবং মানবতাবিরোধী রূপ দেখে তিনি ব্যথিত হন –আর এ থেকে সাধারণ বঞ্চিত মানুষকে উদ্ধারের জন্য উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। তার জীবদ্দশায় পৃথিবীর আর্থ সামাজিক বিন্যাসের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে মানব ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার ভিত্তি খুঁজে নেন, এবং তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের শোষণ মুক্ত সমাজ গঠনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন মার্ক্স। মার্ক্স ধারণা করেছেন, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একদিকে যেমন শোষিত শ্রেনী নিদারূণভাবে শোষিত এবং নিপিড়ীত হবে, তেমনি তাদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে তারা যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে সামিল হবে, আর তাতে তাদের বিজয় হবে অনিবার্য। জনগন প্রবেশ করবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। তিনি মনে করেন এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানায় পরিচালিত হবে এবং তাই এই উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যে উদ্বৃত্ত মূল্য বা ‘সারপ্লাস’ ভ্যালু তৈরি হবে, তা সমাজের স্বার্থেই পুনর্বিয়োগ করা হবে। এর পরবর্তী পর্যায়ে ‘বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী’ সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যা মানব সমাজের সর্বোচ্চ রূপ। কার্ল মার্ক্স তার এই চিন্তাধারাকে প্রয়োগ সম্পর্কিত দর্শন বা ‘ফিলোসফি অব প্র্যাক্টিস’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই উপলব্ধিটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান বলে অনেকেই মনে করেন। আর সেজন্যই একটা সময় মার্ক্সের ধারণা সারা বিশ্ব জুড়ে অগনিত চিন্তাশীল মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলো।
তারপরও কিছু জিনিস আমাদের সবসময়ই মাথায় রাখতে হবে। মার্ক্সের প্রতিটি কথাই কিন্তু অভ্রান্ত নয়। এক সময় তার তত্ত্বের অনুরাগীরা কিন্তু সেভাবেই মার্ক্সকে দেখতেন। তারা ভাবতেন, এই মতবাদ এমন এক ‘সত্যের’ উপর প্রতিষ্ঠিত যা থেকে পদস্খলন কখনোই সম্ভব নয়। ঢালাওভাবে তাঁর সমস্ত বানীকে ‘বৈজ্ঞানিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো। কিন্তু রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ এবং পরবর্তীতে সারা বিশ্বজুরে কমিউনিস্ট বিশ্বের পতনের পর সে সমস্ত বাণীর অভ্রান্ততা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে অনেক আগেই। পৃথিবী জুরে পুঁজিবাদ বা ধণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রের উত্তরোণের যে ‘আমূল ভবিষ্যদ্বানী’ মার্ক্স করেছিলেন, আজকের বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিশ্ল্বেষণে মনে হয় পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি সেভাবে যায়নি। মার্ক্স মনে করেছিলেন যে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনী বুঝি কেবল শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হবে এবং এর ফলে শ্রমিক শ্রেনীর পিঠ ‘দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ায়’ তারা ধণতান্ত্রিক সিস্টেমের পতন ত্বরান্বিত করবে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জায়গায় সফলতা এলেও ধনতন্ত্রের পতন হয়নি, বরং বলা যায় ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদি ব্যবস্থা নিজস্ব সিস্টেমের দুর্বলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে বিবর্তিত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের ‘ওয়েল ফেয়ার স্টেট’ গুলো শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে আজ অনেক বেশী মনোযোগী। বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী বা শ্রমিকেরা আজ কোম্পানির স্টক কিনতে পারছে, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকেরা নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারছে অনেক ভালভাবে - এই পুঁজিবাদী সমাজেই। তারা কিন্তু বিপ্লবের পথে যাচ্ছে না।
ছবিঃ 'দেয়ালে পিঠ' ঠেকে গেলেই যদি বিপ্লব হয়ে যেত, তাহলে বিগত শতকের ত্রিশের দশকে সারা দুনিয়া জুরে অর্থনৈতিক মন্দার সময় কেন পশ্চিমে কেন কোন বিপ্লব হল না?পুঁজিবাদী শোষণের কারণে ‘দেয়ালে পিঠ’ ঠেকে গেলে যদি বিপ্লব হয়ে যেত, তাহলে বিগত শতকের ত্রিশের দশকে সারা দুনিয়া জুরে অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ নেমে এসেছিল তখন কেন পশ্চিমে কোন বিপ্লব হল না সে ব্যাপারটি মোটেই বোধগম্য নয়। এরকম উদাহরণ আছে বহু। মার্ক্স তার তত্ত্বে আদর্শবাদী দৃষ্টিকোন থেকে পুঁজিবাদী সমাজের ধংসের ভবিষদ্বানী করেছিলেন, কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে পুঁজিবাদি ব্যবস্থা ধ্বংস না হয়ে যে
টিকে গেছে – সেই টিকে থাকার পেছনে ‘অন্তর্নিহিত বিবর্তন’টি গোনায় ধরেন নি, কিংবা ধরতে চাননি।
মার্ক্স আরো মনে করেছিলেন পুঁজিবাদী সমাজে ‘ক্লাস পোলারাইজেশন’ তীব্র থেকে তীব্রতর হবে এবং শোষক–শোষিতের (মার্ক্সের ভাষায় বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত) মধ্যে শ্রেনীবৈষম্য প্রবলতর হয়ে উঠবে। কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমরা দেখছি, নানান ধরণের সমস্যার শিকার হয়েও সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীর ক্রয় ক্ষমতা ও দৈনন্দিন জীবনের মান উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে এবং সর্বোপরি মালিক এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে মধ্যবর্তী শ্রেণীভুক্ত মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত আধুনিক বিশ্বের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু সনাতন শ্রমিক এবং কাঁচামালের সংজ্ঞা এবং সম্পর্কই পালটে দিয়েছে। এপ্রসঙ্গে কলকাতার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজতাত্ত্বিক ড. রামকৃষ্ণ মুখার্জির বক্তব্য প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তিনি মনে করেন, ধণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিশীলিত রূপ গ্রহণ করার ফলে শ্রমশক্তির এক উল্লেখযোগ্য অংশ কায়িক শ্রম দানের পরিবর্তে বুদ্ধিজনিত শ্রমদান (মেন্টাল লেবার) করছে এবং তারাই মধ্যবিত্তসূলভ জীবন জাপন করছে। প্রতিবছরই তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে এইচ ওয়ান ভিসায় আমেরিকায় আসছে আজার হাজার ‘মেন্টাল লেবারের’ দল, যারা তৈরি করেছে এক দৃশ্যমান বলিষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেনী। বলা বাহুল্য, এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বুদ্ধিমত্তা ও মানসিকতা আপামোর জনগণের কাছে সাধারণ মানদন্ড হিসেবে পরিগণিত হয়েছে এবং সমাজে তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হবার মধ্য দিয়ে তাদের স্বার্থ অনুযায়ী সামাজিক কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। মার্ক্সের সনাতন ধারণায় সমগ্র উৎপাদিকা শক্তিকে কেবলমাত্র কায়িক শ্রমদানকারী শ্রমিকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করেছিলেন – যা আজকের দুনিয়ার সাপেক্ষে অনেকটাই বাতিলযোগ্য।
এ ছাড়া মনে রাখতে হবে, শুধু শ্রেনীগত কিংবা অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, আজকের দুনিয়ার জটিল সমাজে আরো নানা ধরণের দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত (যেমন, জাতিগত, লৈঙ্গিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় সঙ্ঘাতের কথা বলা যায়) রয়েছে যা পৃথিবীর গতিপথ নির্ধারণে অনেক সময়ই নিয়ামক ভুমিকা পালন করেছে – মার্ক্স সেগুলো তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি, তার তত্ত্বে তিনি শুধু ‘ক্লাস কনফ্লিক্ট’কেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ মার্ক্স শুরুই করেছিলেন এই বলে:
“The history of all hitherto existing society is the history of class struggle”.
শ্রেনী সঙ্ঘাতের উপস্থিতি রয়েছে, প্রবলভাবেই রয়েছে কিন্তু শুধু শ্রেনীগত দ্বন্দ্ব দিয়ে দুনিয়ার সবকিছুকে ব্যখ্যা করাকে আধুনিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা এখন ‘অতি সরলীকরণ’ কিংবা ‘অসম্পূর্ণ’ বলেই মনে করেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভারতে শ্রেণীবিভাগের তাৎপর্য’ শীর্ষক লেখায় মন্তব্য করেছিলেন,
‘শ্রেণী ছাড়াও আসলে অসাম্যের অনেক উৎস আছে; অসুবিধা আর বৈষম্যের সমস্ত কিছু কেবলমাত্র শ্রেনী দ্বারাই নির্ধারিত হবে – এই ধারণা ত্যাগ করতে হবে’।
এ ছাড়া মার্ক্সের দর্শনের বেশকিছু জায়গায় আছে পরীক্ষণযোগ্যতার অভাব। শ্রেনীহীন সমাজ গড়বার মাধ্যমে স্বপ্ন চিরন্তন আবেগী মানসিকতাকে যতটা তুলে ধরে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণযোগ্যতার মাপকাঠিতে ততটা উত্তীর্ণ হতে পারে কি? বিজ্ঞানের দার্শনিক কার্ল পপার (১৯০২-১৯৯৪) তার ‘ফলসেফায়াবিলিটি’ বা ‘ভুল প্রমাণেয়তা’ তত্ত্বের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, মার্ক্সিজম এক ধরনের ছদ্মবিজ্ঞান (pseudoscience)। পপারের ভাষায় –
‘বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব ততক্ষণই থাকবে যতক্ষণ তত্ত্বগুলোকে কঠিন প্রায়োগিক পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে চালানো হবে। যখন কোন তত্ত্বকে পরীক্ষণের চেয়ে বরং সুরক্ষিত করে রাখার চেষ্টা করা হয়, তখন বুঝতে হবে এর মধ্যে গলদ রয়েছে’।
মার্ক্সের তত্ত্বের বিরুদ্ধে এটি একটি গুরুতর অভিযোগ সবসময়ই। যখন মার্ক্সের অনুরাগীরা দেখলেন পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি মার্ক্সের দেখানো পথে যাচ্ছে না, তখন তাদের দরকার ছিল এই তত্ত্বকে বাতিল করে নতুন তত্ত্বের খোঁজ করা। তা না করে তারা পুরোন তত্ত্বকেই তারা আঁকড়ে ধরে রইলেন, এবং তত্ত্বকে জোড়া তালি দিয়ে একধরণের যথার্থতা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। পপারের মতে এ ধরণের কর্মকান্ড বিজ্ঞানমনস্কতার পরিপন্থি। সত্যি বলতে কি, এ ধরনের মনোভাবই তৈরি করে অন্ধ স্তাবকের এবং একটি তত্ত্বকে ঠেলে দেয় বিজ্ঞান থেকে অপবিজ্ঞানের দিকে (বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন : 'মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান? কিছু আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যা'-প্রবন্ধটির ফলসিফিকেশন অংশ) । কার্ল পপার ছাড়াও মার্ক্সের ‘লেবার থিওরী অব ভ্যালু’র সমালোচনা রয়েছে একাডেমিয়ায়। আধুনিক অর্থনীতিতে তার তত্ত্বকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘মার্জিনাল ইউটিলিটি’ তত্ত্ব দিয়ে। এছাড়া উইলিয়াম স্ট্যানলি জেভোন, কার্ল মেঞ্জার কিংবা বোম ব্যাওয়ার্কের সমালোচনাগুলো পড়া যেতে পারে।
লুইস ফুয়ের, বার্ট্রান্ড রাসেল, গিবন প্রমুখ দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী, এবং ঐতিহাসিকেরা সময় সময় দেখিয়েছেন মার্ক্সের তত্ত্বের সাথে বিজ্ঞানের চেয়ে ধর্মের সাযুজ্যই বেশী। যে ভাবে কমিউনিজম সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল তা ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত ঈশ্বর কর্তৃক পরকালে স্বর্গের স্বপ্নময় আবেদনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ধার্মিকরা যেমন কোরান, বেদ, বাইবেল, হাদিস প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের মধ্যে মহাসত্য খুঁজে পান, এবং মুহম্মদ, যীশু এবং অন্যান্য ধর্মপ্রচারকদের বানীকে শিরোধার্য করে রাখেন, এবং তাদের দেখানো পথেই নিজেদের চালিত করতে চান- ঠিক সেভাবেই কমিউনিস্টরা অনেকটা মার্ক্স, লেলিন, স্ট্যালিন, ট্রটস্কি, মাও এবং তাদের লেখা লাল বইগুলোকে দেখতেন। Das Capital ছিল যেন তাদের কোরাণ কিংবা বেদগ্রন্থ আর Communist manifesto তাদের হাদিস; মার্ক্সবাদ ছিল তাদের ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ - ‘Opium of the proletariats’, যে ব্যবস্থায় পুরোহিতগিরি করেন স্ট্যালিন, মাও, চওসেস্কুর মত ‘পয়গম্বরেরা’ ! ধর্মের অনুসারীরা যেভাবে নিজ নিজ ধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে ঢালাওভাবে বিধর্মীদের উপর অত্যাচার করেছে, ঠিক তেমনি কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা এবং বিপ্লবেরর নামেও লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, গুলাগে প্রেরণ করা হয়েছে অনেক প্রগতিশীল মানুষকে, ‘শ্রেনীশত্রু’ কিংবা ‘পুঁজিবাদের দালালের’ তকমা এঁটে নির্যাতন করা হয়েছে কিংবা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদদের নির্যাতন, নির্বাসন, কারাগারে নিক্ষেপ, শ্রমশিবিরে প্রেরণ, মস্তিস্ক ধোলাই ইত্যাদি সেই মধ্যযূগীয় ধর্মের কৃষ্ণ ইতিহাস ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ‘কাফের নিধন’, কিংবা ‘নির্যবন করো সকল ভুবন’-এর মত ‘বুর্জোয়াদের খতম কর’ ধ্বনি দিয়ে শ্রেনীহীন সমাজ গড়বার প্রেরণা ছিলো কমিউনিজমের অপরিহার্য শ্লোগান। ক্রুসেড, জ্বিহাদ ধর্মযুদ্ধের মতই ছিলো তাদের এই শ্রেনীসংগ্রামের লড়াই। লেলিনের সময় আমাদের ‘র্যাব’ বা ‘রক্ষীবাহিনীর’ মত যে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী CHEKA গঠন করা হয়েছিলো, যার ফলশ্রুতিতে ১৯২৩ সালের মধ্যে বলি হয়ছিলো ৫ লক্ষ লোক। এই হত্যা আর নির্যাতন আরো প্রকট আকার ধারণ করে স্ট্যালিনের জামানায়। ‘কুলাক’ নামে একটি সম্ভ্রান্ত কৃষক শ্রেনীকে ‘শ্রেনী শত্রু’ হিসবে আখ্যায়িত করে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। এক সন্দেহবাতিকগ্রস্ত প্রবল ক্ষমতাশালী স্বৈরশাসকে পরিনত হন স্ট্যালিন। রাস্তা ঘাট শহর বন্দরের নাম স্ট্যালিনের নামে নামাঙ্কিত করা হয়। রাস্তায় রাস্তায় গড়ে তোলা হয় বিশাল বিশাল স্ট্যালিনের মূর্তি। চারিদিকে কেবল ‘পশ্চিমা চর’ আর ‘বুর্জোয়া দালাল’ খুঁজে ফিরতেন স্ট্যালিন। নিজের সামান্য সমালোচনাও সহ্য করতেন না তিনি। যে কোন জায়গায় কারো ব্যর্থতা মানেই তার কাছে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। নির্দয়ভাবে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতেন তিনি একের পর এক। তার এই সীমাহীন নিপিড়ন, নির্যাতন আর অত্যাচারের সময়টুকু (১৯৩৬-১৯৩৯) আজ ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে আছে ‘দ্য গ্রেট টেরর’ (The Great Terror) হিসেবে। একই ধরনের ধর-পাকড়, নির্যতন-নিপীড়ন আর হত্যাকান্ড চলেছিলো চীনে ‘চ্যায়ারম্যান মাও’ এর শাসনামলেও। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে (১৯৫৮) তথাকথিত ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ (Great Leap Forward) –এর সময় মাওয়ের নানা ধরনের অপ্রমাণিত এবং অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারনা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার শিকার হয়ে চীনের কৃষিক্ষেত্রের বারোটা বেজে যায়। ফলে ১৯৫৯ সালে সারা চীনে শতকরা পনের ভাগ ফসল ঘাটতি দেখা দেয়, ১৯৬০ সালে আরো দশ ভাগ ঘাটতি, ১৯৬১ তেও অবস্থা তথৈবচ। সারা চীন জুরে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। চীনের ‘সরকারী হিসেবে’ই দুর্ভিক্ষে মৃত্যু সংখ্যা উল্লেখ করা হয় এক কোটি চল্লিশ লাখ। বেসরকারী হিসেবে দুই কোটি থেকে প্রায় চার কোটির কাছাকাছি বলে বিভিন্ন গবেষোনাপত্রে উল্লেখ করা হয়। সমগ্র মানবেতিহাসেই সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এটি।
ছবিঃ সাংস্কৃতিক বিপ্লব - চ্যায়ারম্যান মাও এর প্রোপাগান্ডা পোস্টার, বাস্তবে এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবে বলি হয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রাণলীও শাওকি, দেং জিয়াও পিয়াং, লীন বিয়াও এবং মাওএর স্ত্রী জিয়াং চিং-এর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রাণ হারায় লক্ষ লক্ষ লোক। এই লখো মানুষের মৃত্যুকে মাওয়ের শাসনামলে মহিমান্বিত করা হয়েছিলো ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর ধুঁয়া তুলে। ‘Mao: The Unknown Story’ নামের সাম্প্রতিক বইয়ে গবেষক জুয়ান চ্যাং এবং জন হ্যালিডে উল্লেখ করেছেন যে, তথাকথিত ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবে’ মৃত্যুর সংখ্যা সম্ভবত ৩০ লক্ষ ছাড়িয়ে
গিয়েছিলো। 'The Black Book of Communism' বইয়ের পরিসংখ্যানে উল্লিখিত হয়েছে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে ২ কোটি লোক, সাড়ে ৬ কোটি লোক চীনে, ১০ লাখ লোখ ভিয়েতনামে, ২০ লাখ লোক উত্তর কোরিয়ায়, ২০ লাখ লোক কম্বোডিয়ায়, ১০ লাখ লোক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে, দেড় লাখ লোক পূর্ব ইউরোপে, ১৭ লাখ লোক আফ্রিকায়, ১৫ লাখ লোক আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনামলে নিহত হয়। এছাড়া ক্ষমতার বাইরে থাকা 'সর্বহারা বাহিনী', 'নকশাল' টাইপের দলগুলোর কমিউনিস্ট মুভমেন্টে সাড়া দুনিয়া জুড়ে মারা গেছে অন্ততঃ ১০ হাজার মানুষ। গণহত্যার গবেষক রুমেলের মতে সোভিয়েত রাশিয়া প্রায় ছয় কোটি লোককে কমিউনিজমের নামে হত্যা এবং নির্যাতন করা হয়েছিলো, চীনে ১৯৪৯ সাল থেকে ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবের’ সময় দশ লক্ষ লোক নিহত হয়েছিল। কম্বোডিয়ায় পলপটের সৈন্যবাহিনীর হাতে চার বছরে নিহত হয় প্রায় বিশ লক্ষ লোক। এ সমস্ত গবেষকের সঠিক সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা যেতে পারে সহজেই কিন্তু তারপরও বলা যায়, একটি ‘বৈজ্ঞানিক’ সমাজব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য ঢালাওভাবে এত মানুষের প্রাণহানি কেন ঘটাতে হবে সে প্রশ্ন উত্থাপন মোটেই অসমীচীন নয়। আসলে ‘কমিউনিজম নিজেই একটি ধর্ম’ কিনা ঢালাওভাবে এ বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় এর মধ্যে ধর্মের উপাদান রয়ে গেছে, প্রচ্ছন্নভাবেই। মনবতাবাদী লেখক শফিকুর রহমান তার ‘হিউম্যানিজম’ (১৯৯৭) গ্রন্থে ‘আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়া’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ সংকলিত করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণের পর ১৯৮২ সালে লিখিত তার এ প্রবন্ধটির কিছু কথা এ প্রসঙ্গে আজও প্রাসংগিক –
‘মার্ক্সবাদকে ধর্মবিরোধী মতবাদ বলা হলেও ধর্মের যাবতীয় জঘন্য বৈশিষ্টগুলোকে কম্যুনিস্ট দেশগুলো ঠিকই গ্রহণ করেছে। গোঁড়ামি, অসহিষ্ণুতা ও মত বা বিশ্বাসের জন্য বলপ্রয়োগ ধর্মের জঘন্য, নিকৃষ্ট, নিন্দার্হ, অগনতান্ত্রিক ও অমানবিক দিক আর এই বৈশিষ্ট্যগুলো আজকের হ্রস্বদীর্ঘ ধর্মের চেয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ঢের বেশি রপ্ত করতে পেরেছে। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন খ্রীস্টান ধর্মের প্রতিষ্ঠায় খ্রীস্টানদের যে সব ঘৃণ্য বৈশিষ্ট্যগুলো কাজ করেছিলো বলে মনে করেন, তার সবগুলোই কমিউনিস্টরা আয়ত্ব করেছে।’
আরো কিছু নমুনা পেশ করা যাক। মার্ক্সিজমের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেলিন উপংহার টেনেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ বা ‘ইম্পেরিয়ালিজম’ হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজের উপঢৌকন। পুজিবাদী বিশ্ব যে সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি করে না তা নয়, বহুলাংশেই করে (তা না হলে আজকের বুশ-ব্লেয়ারের মত সাম্রাজ্যবাদী দানব তৈরি হল কিভাবে!) কিন্তু, কথা হচ্ছে, মার্ক্সীয় ধারণায় যেমন মনে করা হয়েছে ‘স্যোশালিস্ট’ দেশ গুলো যেহেতু
ছবিঃ ১৯৬৮ সালে চেকোশ্লাভাকিয়ায় সোভিয়েত বাহিনীর আগ্রাসনপুঁজিবাদ থেকে মুক্ত থাকবে, সে বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ থাকবে না। কিন্তু আমরা দেখেছি সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ছিলো পুঁজিবাদী বিশ্বের মতই সমান আগ্রাসী। পোল্যান্ড (১৯৩৯), হাঙ্গেরী (১৯৫৬), চেকোশ্লাভাকিয়া (১৯৬৮), আফগানিস্তান (১৯৭৯)-এর উপর রাশিয়ার নির্লজ্জ আগ্রাসনের ইতিহাস কারো অজানা নয়, অজানা নয় তীব্বতের প্রতি চীনের মনোভাবও। কাজেই সাম্রাজ্যবাদ কেবল পুঁজিবাদী বিশ্বের একচেটিয়া ভাবলে ভুল হবে।
রাশিয়া একসময় জেনেটিক্সের গবেষণায় শীর্ষস্থানে ছিলো, অথচ স্ট্যালিনের আমলে রাশিয়ায় 'জেনেটিক্স' এর উপর গবেষণার লালবাতি কিভাবে জ্বলে গিয়েছিল আমরা তা সবাই আজ জানি। বাম ঘরণার অনেকেই একটা সময় জেনেটিক্স বা বংশগতিকে পাত্তা না দিয়ে কেবল পরিবেশ নির্ণয়বাদকে আদর্শ হিসেবে করতেন, কারণ তা তাদের 'সাম্যবাদের বাণী' প্রচারে সহায়তা করে। আর এ কারণেই মার্ক্স কিংবা তার পরবতী তাত্ত্বিক কমিউনিস্টরা তাদের অনেক বাণীতেই এটাই জোরের সাথে বলেছিলেন যে মানুষের সকল বৈশিষ্ট্যই পরিবেশের ফল, এর সাথে বংশের কোন যোগ নেই। লেলিন এবং তার সমসামিয়ক নেতারা ভাবতেন, সাহিত্য, বিজ্ঞান সব কিছুই ‘মার্ক্সিজমের ছাকুনি’র মধ্য দিয়ে যেতে হবে, নইলে পরিশুদ্ধ হবে না! এ প্রসঙ্গে লেলিনের ‘মার্ক্সবাদী’ নির্দেশ ছিল –
‘Literature must become party literature... Down with non partisan literatures! Literature must become the general cause of the proletariat, “a small and a small screw” in the social democratic mechanism, one and individual – a mechanism set in motion by the entire conscious vanguard of the whole working class. Literature must become the integral part of the organized, methodical and unified labors of the Social Democratic Party.’ (Novaia Jizn, Movember, 1905)
এ নির্দেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছে পূর্বতন রাশিয়ার কমিউনিস্ট জামানায়। ধর্মান্ধ এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের মত কমিউনিস্ট রাস্ট্রে সাহিত্য রচনার গৎ বাঁধা ছক বাৎলে দেওয়া হয়েছিলো, এর অন্যথা হলে তাদের ‘কমিউনিস্ট ধর্মানুভুতিতে’ আঘাত লাগত। ‘মুহম্মদ বিড়াল’ নিয়ে নির্দোষ কৌতুকেও যেমন ইসলামের অনুসারীদের পিত্তি জ্বলে যায়, তেমনি স্ট্যালিনকে নিয়ে ব্যংগ-বিদ্রুপে কমিউনিস্ট অনুসারীদের গায়ে লাল লাল ফোস্কা পড়তো। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্যাঙ্গাত্মক রচনার জন্য স্ট্যালিনীয় জামানায় সিন্যভস্কি-দানিয়েলের বিচারের প্রহসনে। জেলখানায় সাত বছর বন্দি রাখা হয়েছিলো সিন্যভস্কিকে, দানিয়েলের কপালে জুটেছিলো পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড। সলঝনিৎসনের উপন্যাস ‘ফার্স্ট সার্কেল’ (First Circle)-এ দেখানো হয়েছিলো কিভাবে উপন্যাসের নায়ক শেষ পর্যন্ত স্ট্যালিনের শ্রমশিবিরে নিজেকে খুঁজে পায়। সলঝনিৎসনকে সে সময় দেশ ত্যাগ করতে কিংবা নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। আঁদ্রে শাখারভকে গোর্কিতে নির্বাসন দেওয়া হয়। পশ্চিমা বিশ্বে তো প্রতিবাদ হয়েছিলোই এমনকি পূর্ব ইউরোপের খোদ কমিউনিস্ট ব্লকেও সে সময় এ নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা হয়। যেমন, নরওয়েজিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির Friheten পত্রিকায় খ্যাতনামা কমিউনিস্ট মার্টিন নাগ বলেন,
‘সোভিয়েত রাষ্ট্রের সাহিত্য-শিল্প বোঝার ক্ষমতা নেই। ব্যাঙ্গাত্মক রচনা তারা বোঝে না। শিল্প সাহিত্যের শত্রু স্ট্যালিন এ অবস্থা তৈরি করেছে। সোভিয়েত শিল্প-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের নিকট রাষ্ট্রের দেওয়া স্ট্যাম্প থাকে, তারা শুধু বিভিন্ন স্থানে সে স্ট্যাম্প দিয়ে সিল মারেন। ভবিষ্যতে মুক্ত সোভিয়েত সাহিত্যে সিন্যভস্কির ব্যাঙ্গাত্মক রচনা সম্পুর্ণ আকারে প্রকাশিত হবে।’
মার্টিন নাগের ভবিষ্যদ্বানী ফলে গিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে। অথচ সে সময় মার্টিন নাগ সমালোচিত হয়েছিলেন ‘কমিউনিজম বিরোধী’ এবং ‘পশ্চিমা দালাল’ অভিধায়।
ছবিঃ স্ট্যালিন তার শাসনামলে লাইসেঙ্কো নামক এক ঠগ বিজ্ঞানীকে প্রমোট করেন বংশগতিবিদ্যাকে ঠেকাতে যা জেনেটিক্সে রাশিয়ার লালবাতি জ্বালিয়ে দেয়।পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ায় স্ট্যালিন মার্ক্সসীয় মতবাদের সংগে সংগতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে বংশাণুবিদ্যাকে বিকৃত করতেও পিছপা হননি । এই উদ্দেশ্যে তিনি লাইসেঙ্কো নামক এক ঠগ বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করেন। যখন ভাভিলভ প্রমুখ বিজ্ঞানীরা লাইসেঙ্কোর তত্ত্বের ভুল ধরিয়ে দেন তখন স্ট্যালিন তাদেরকে গুলগে পাঠিয়ে দেন। তারপর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্ট্যালিনএর প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে আরো প্রাণ হারান কার্পেচেঙ্কো, সালমোন লেভিট, ম্যাক্স লেভিন, ইস্রায়েল আগলের মত বিজ্ঞানী। শুধু লাইসেঙ্কো নয়, স্ট্যালিন জামানায় লেপিশিঙ্কায়া নামের আরেক ঠগ বিজ্ঞানীকে প্রমোট করা হয়েছিল – সেই 'পুঁজিবাদী' জেনেটিক্স’ সরাতে। বিজ্ঞানকে অবশ্যই শ্রমজীবী বা প্রলেতারিয়েতের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে, তা নইলে চলবে না – এটাই বিজ্ঞান সম্পর্কে কমিউনিস্টদের ‘বৈজ্ঞানিক থিওরী’।
আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রদান করার পর, ব্যাপারটা 'মার্ক্সিজমের সাথে সংগতিপূর্ণ' মনে না করায় ‘সোভিয়েত এন্সাইক্লোপিডিয়া’ প্রকাশ করা হয় রিলেটিভিটিকে 'নস্যাৎ' করে। রাশিয়ার একজন বিখ্যাত মার্ক্সবাদী দার্শনিক তার তখনকার লেখায় বলেছিলেন –
‘‘Einstein’s theory of relativity cannot be considered accepted since it was not accepted by the proletariats’.
এই নির্বোধ মন-মানসিকতার প্রতিবাদ করায় পদার্থিবিদ জর্জ গ্যামোকে পালাতে হয়েছিলো রাশিয়া ছেরে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আঁদ্রে শাখারভ এবং সলঝনিৎসনের কপালেও জুটেছিল স্ট্যালিনীয় জামানার অত্যাচার আর নির্যাতন । পাস্তারনাক ‘ডক্টর জিভাগো’ রচনা করে ১৯৫৭ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন; স্ট্যালিন চাপ প্রয়োগ করে এই মহান কবিকে দিয়ে স্ট্যালিনের স্তুতি করাতে চেয়েছিলেন। পাস্তারনাক অবশ্য রাজী হননি। স্ট্যালিন বিরোধী ব্যঙ্গ সাহিত্য লেখার ‘অপরাধে’ সিন্যভস্কি এবং দানিয়েলের মত চিন্তাশীল লেখকদেরকে প্রহসনমূলক বিচারে কারাদন্ড দেওয়া হয় - এ তো আগেই বলেছি।
লিভ কিতকো এবং পেরেটস মারাকিশকে অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়। ব্রুনো, জাসিনস্কি, আইভান কাতায়েভ, মিখাইল কোলস্তভ, সার্গি ত্রেতায়াকভ, ওসিপ ম্যানদেলস্তম, মেয়েরহোলদ প্রমুখ চিন্তাবিদদেরকে কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প কিংবা কঠিন শ্রম শিবিরে নিয়ে মারা হয়। মিখাইল লেভিদভ, আইজ্যাক নুসিনভ প্রমুখকে গায়েব করে ফেলা হয়।
ছবিঃ স্ট্যালিনের শাসনামলে বহু মানুষকে কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প কিংবা কঠিন শ্রম শিবিরে নিয়ে হত্যা করা হয়।হত্যা করা হয় পোস্তিশেভ, ব্লুচার, কোসিওর, গামারনিক, ইয়াকির, তুখাচেভস্কি প্রমুখ নেতাদের। নির্বাসন দেয়া হয় নিকোলাস বার্দায়েভ, মেসিং, মন্তসেভ, ওলিমনস্কি, স্তেকলভ, স্কভর্তসভ, প্রমুখ ব্যক্তিকে। অলিক গিঞ্জবুর্গকে তিনবার কারারুদ্ধ করা হয়। পিয়তর সাদায়েভকে পাগল হিসবে ঘোষণা করা হয়। গলোমশতক, জোশেনকো, আকমাতোভা, ভ্যালরী তারতিস, ইলিয়াইলভ, এভগেনি পেত্রভ, নাতালি লাস্কোভা, আলেকজান্দার গিনযবুক, ইউরি গালান্সকভ, ভ্যালিন্তিন খ্রোমভ – সকলকেই শাস্তি দেয়া হয়। এই দৃষ্টান্তগুলো আসলে বহুল প্রচারিত ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ শ্লোগানের বিরুদ্ধেই যায় বলে মনে হয়।
‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ কথা বলা হলেও সত্যিকার বিজ্ঞানের সাথে সমাজতন্ত্রের মাত্রাগত পার্থক্যটুকু এ প্রসঙ্গে পরিস্কার না করলে অন্যায় হবে। যে কোন ‘ইজম’ আসলে বৈজ্ঞানিক সার্বজনীনতার অন্তরায়। একজন পদার্থবিদ কখনোই নিজেকে ‘নিউটোনিস্ট’ কিংবা ‘আইনস্টাইনিস্ট’ হিসেবে পরিচিত করেন না। কারণ নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র কিংবা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানেরই অংশ। কাজেই আলাদা করে কারো ‘আইনস্টাইনিজম’ চর্চা করার কিছু নেই। একই কথা জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও খাটে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ কিংবা মেন্ডেলের বংশগতির তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে এগুলো জীববিজ্ঞানেরই অংশ। সে হিসেবে প্রতিটি জীববিজ্ঞানীই কিন্তু বিবর্তনবাদী। ল্যামার্কের মতবাদ ভুল প্রমাণিত হওয়ার ফলে সেটা জীববিজ্ঞানের অংশ হতে পারেনি, সেটা অপাংক্তেয় হয়ে আছে ‘ল্যামার্কিজম’ অভিধায় অভিসিক্ত হয়ে। কাজেই সোজা কথায় যে কোন ধরণের ‘ইজম’ বৈজ্ঞানিক ধারণার পরিপন্থি। অথচ মার্ক্সিজম বা কমিউনিজমে সব কিছু ছাপিয়ে ‘ইজম’টাই যেন বড় হয়ে উঠে। একে তো সকল পদার্থবিজ্ঞানীই যেমন ‘আইনস্টাইনিস্ট’, সেরকম সকল অর্থনীতিবিদদের সবাই যে ‘মার্ক্সিস্ট’ তা কিন্তু বলা যাবে না। বহু বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ আছেন যারা মার্ক্সিজমকে ভ্রান্ত মনে করেন। কাজেই এটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসেবে সার্বজনীনতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারেনি কখনোই। আবার একই মার্ক্সিস্টদের মধ্যেও আমরা দেখি শতভাগ। কেউ লেলিনিস্ট, কেউ স্ট্যালিনিস্ট, কেউ ট্রটস্কিস্ট, কেউবা মাওইস্ট। সবাই যে যার মত নিজেদের আবার ‘সত্যিকার মার্ক্সিস্ট’ মনে করেন। বাংলাদেশে ভাসানী, ন্যাপ, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, সর্বহারা পার্টি, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি – এরকম নানা নামের বৈধ, অবৈধ কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব রয়েছে। এদের অনেকেই একসময় সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে ঘোট পাকিয়ে শ্রেণীশত্রু মেরেছেন, কখনো ড. হুমায়ুন কবিরের মত বরেণ্য বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করেছেন, কখনো বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে। এমনকি একাত্তরে কোন কোন গ্রুপ পৃথক সায়ত্বসাসিত ‘সরকার’ গঠণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্তও হয়েছিলেন বলে সাক্ষ্য পাওয়া যায়। তারা এগুলো যখন করছিলেন, তারা মার্ক্সীয় দৃষ্টিভংগীর মাধ্যমেই এগুলো জায়েজ করতেন। পরে যখন তাদের এই সমস্ত গণবিরোধী কর্মকান্ড দিনের আলোয় উঠে এসেছে, তখন তারা সাফাই গেয়েছেন এই বলে – ‘ মার্ক্সের তত্ত্বে কোন ভুল নেই - এটা স্রেফ পার্টির লাইনগত ভুল’! কিন্তু ইতিমধ্যেই এই লাইনগত ভুলের বলি হয়ে গেছে শত সহস্র নিরপরাধ প্রাণ। ‘খতমের লাইনের’ কারণে নিঃশেষ হয়েছে অগণিত ‘শ্রেনী শত্রু’। অবশ্য সব কমিউনিস্টই যে এই ‘খতমের লাইন’কে সব সময় সঠিক মনে করতেন তা নয়, সিপিবির মত কিছু ‘মডারেট কমিউনিস্ট’ দলের কর্মীদের দেখেছি খতমের লাইনে না গিয়ে বরং গণতান্ত্রিক পথেই আন্দোলন করতেন। এখানেও ধর্মবাদীদের সাথে মিল লক্ষ্যনীয়। চরম্পন্থি ইসলামের অনুসারীরা বিন লাদেনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে ‘জিহাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে কোরান হাদিসের আলোকে অনেকেই বৈধতা দেন, আবার অনেক ‘মডারেট মুসলিমেরা’ এ ধরণের চরমপন্থি কার্যকলাপকে দেখেন ঘৃণার চোখে – বলেন, এদের কর্মকান্ডের সাথে ‘শান্তিপূর্ণ ইসলামের’ কোনই সম্পর্ক নেই। ধর্মবাদীদের মতই কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যে চরমপন্থি, নরমপন্থি, মডারেটপন্থি, মধ্যপন্থি সব ধরণের অনুসারীই আছেন। এজন্যই ড. ফজলুর রহমান তার ‘ইসলাম’ (১৯৬৬) গ্রন্থে বহু আগেই বলেছিলেন, ‘ইসলাম স্বভাবে কমিউনিজমের মতই’। কথাটা ঘুরিয়ে যদি বলা হয় - ‘কমিউনিজম স্বভাবে ইসলামের মতই’ - তাহলেও তা সমানভাবেই প্রযোজ্য। আবার এর পাশাপাশি আমরা পেয়েছি ‘ধর্মেও আছি জিরাফেও আছি’ গোত্রের ঈদ, পুজো, মিলাদে অংশ নেওয়া এবং এগুলোতে বিশ্বাস করা মার্ক্সবাদী। জ্যোতিষীদের রত্নপাথর হাতে পরা, ভুত-ভবান-শয়তান, রাশিফল, উদৃষ্টে বিশ্বাসী মার্ক্সবাদীরাও সংখ্যায় বিরল নয়। এদের অনেকেই গণেশের দুধ খাওয়া নিয়ে সারা ভারতে গণহিস্টেরিয়ার সময় বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার পক্ষে না থেকে বরং গনেশের অলৌকিকতার সাফাই গেয়েছেন। এদেরই একাংশ মুসলিমদের ভোটব্যাংক অক্ষুন্ন রাখতে তসলিমা নাসরীনের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। এগুলো সবই আবার তারা করেছেন মার্ক্সবাদের দোহাই দিয়ে – ‘দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে’ সমাজ বিশ্লেষণ করে। কাজেই, এদের তত্ত্ব এবং কর্মকান্ড আসলেই কতটুকু ‘বৈজ্ঞানিক’ তা সঠিক বিশ্লেষণের দাবী রাখে। আলেকজান্দার সলঝনেৎসিনের মার্ক্সবাদ এবং সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে কয়েকটি লাইন খুবই প্রণিধানযোগ্য –
‘Marxism, a primitive superficial economic theory, is not only inaccurate, not only unscientific, has not only failed to predict a single event in terms of figures, quantities, time-scales or locations (something that modern economic theory with complex mathematical model using computers today do with laughable ease in the course of social forecasting although never with the help of Marxism) -is absolutely astounds one by economic and mechanistic crudity of its attempts to explain the most subtle of creatures, the human beings, and that even more complex synthesis of millions of people of the society. Only the cupidity of some, the blindness of others, and a craving of faith on the part of still others can serve to explain this grim humor of the twentieth century.’
ছবিঃ আলেকজান্দার সলঝনেৎসিনএই সেই সলঝেনিৎসিন - সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার যে তথাকথিত ‘অবৈজ্ঞানিক’ শ্রেনী সাম্যের মহত্ব তাঁর চেয়ে ভাল কেউ জানে না। সুদীর্ঘ বিশটি বছর তিনি অতিবাহিত করেছিলেন স্টালিনের বানানো ‘গুলাগে’- দেড় থেকে দুই কোটি মানুষের সমাধি ক্ষেত্র। জ়েল, শ্রম শিবির, নির্বাসন, নির্যাতন কোন কিছুই তাঁর জীবনে বাদ পড়েনি। ১৯৭০ সালে তিনি নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন, কিন্তু তাকে নোবেল পুরস্কার গ্রহন করতে দেয়া হয়নি বরং তাকে দেশ থেকে নির্বাসিত হয়। এর পর দীর্ঘদিন তিনি রাশিয়ায় ফিরতে পারেননি। ফিরতে পেরেছিলেন ‘কমিউনিস্ট জামানার’ পতনের পর ১৯৯৪ সালে। সলঝেনিৎসিনকে নিয়ে সুবিনয় মুস্তফীর একটি চমৎকার পোস্ট আছে একটি বাংলা ব্লগে। (সলঝেনিৎসিন মারা গেছেন গত তেসরা আগাস্ট। আজকের প্রবন্ধটি সলঝেনিৎসিনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত)।
এত কিছুর পরও, মার্ক্সবাদের তাৎপর্য এখনো অনেকের কাছেই প্রাসংগিক। সনাতন মার্ক্সবাদের পরবর্তী মার্ক্সবাদীরা, যেমন - গ্রামস্কি, এলথুজার কিংবা দেরিদা যে সমস্ত পোস্ট মডার্নিস্ট ব্যাখ্যা হাজির করেছেন সেগূলো আমাদের জানা প্রয়োজন। এ ছাড়া ভুলে গেলে চলবে না যে, সমগ্র তৃতীয় বিশ্ব সহ লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত মানুষ মুক্তিসংগ্রামে সামিল, তাদের অনেকের কাছেই মার্ক্সবাদ এখনো আলোকবর্তিকা। সম্প্রতি নেপালে মাওবাদীরা যেভাবে দীর্ঘদিনের রাজতন্ত্রকে উতখাৎ করেছে তা অনেক মার্ক্সিস্টকেই উদ্দীপ্ত করেছে। যুগে যুগে সেই উদ্দীপনা এবং সতত শোষণ মুক্তির আকাঙ্খাকে আমাদের কারো পক্ষেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। সাম্যবাদ আর শোষন মুক্তির স্বপ্ন মানুষের মজ্জাগত। তাই মার্ক্সের বহু আগে গ্রীক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের লেখায় আমরা সাম্যবাদের উল্লেখ দেখি। সাম্যবাদের উল্লেখ আর মানব মিলন আর শোষনমুক্তির স্বপ্ন আছে যীশুখ্রীষ্ট, চার্বাক, বুদ্ধ, সেইন্ট সিমন, চৈতন্য আর বিবেকানন্দের অনেক বানীতেই। সেই একই স্বপ্ন আছে মার্ক্সবাদেও। সেই চিরন্তন মুক্তির স্পৃহা, আকাঙ্খা, আর তা বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ‘কমরেড’রা অবশ্যই আমাদের নমস্য। কিন্তু এটাও তো ঠিক ‘শোষন মুক্তি’র স্বপ্ন আর ‘মহান বিপ্লবের’ মাহাত্ম্যকে পুঁজি করে এই কমরেডরাই যখন ক্ষমতায় গেছে তারা নিজেরাই বনে গেছে একেকজন ‘প্রতিবিপ্লবী’। তাদের রচিত ব্যবস্থায় তথাকথিত ‘সর্বহারাদের শাসন’ বলবৎ হয়নি, বরং বলবৎ হয়েছে এক পার্টির একনায়কতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে ‘পার্টি স্টেটে’। পার্টির লিডাররাই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে সর্বেসর্বা। তাদের মতের বিপরীতে গেলেই করেছেন খুন, হত্যা আর নির্যাতন। জর্জ বার্ণারড শ সেজন্যই বোধহয় বলেছেন –
‘Revolutions have never lightened the burden of tyranny; they have shifted it to another shoulder.’
নিরঙ্কুশ ক্ষমতা যে শেষ পর্যন্ত নিরঙ্কুশ দুর্নীতির জন্ম দেয়, তা পুঁজিবাদী, সাম্যবাদী - সব সমাজের জন্যই বোধ হয় খাটে। সেজন্যই এত আদর্শ আর শোষণ মুক্তির কথা বলবার পরও কমিউনিস্ট বিশ্ব থেকেই যুগে যুগে পয়দা হয় স্ট্যালিন, পলপট কিংবা চওসেস্কুর মত নির্দয় স্বৈরশাসকের কিংবা দুর্নীতিবাজের।
তবে আমাদের মত আদার ব্যাপারীদের জন্য তাহলে তাত্ত্বিক সমাধানটা কি? বাংলাদেশের মানুষ কি তবে ‘এশিয়া এনার্জি’র মত রক্তপিপাসু মুনাফালোভী বহুজাতিক কোম্পানির ক্রীড়নক হয়ে রইবে? ইলা মিত্রের মত মহীয়সী নারী এক সময় সংগ্রাম করেছেন তেভাগা আন্দোলনে। আমরা জানি ময়মন সিংহের হাজং বিদ্রোহের কথা, তেলেঙ্গনা বিপ্লবের কথা, কাক-দ্বীপ-সোনাপুর-ভাংগরের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস। ব্রিটিশ ভারতবর্ষে সন্ন্যাস বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০), বারানসী বিদ্রোহ (১৭৮১), ওহাবী বিদ্রোহ (১৮২৪-১৮৭০), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭), সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৬-১৮৫৮), নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬১), মোপলা বিদ্রোহ (১৮৭৩-১৯২১), পাবনার কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭০ ও ১৮৮০), দাক্ষিনাত্যের কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭৫), মাদ্রাজের রূম্পা বিদ্রোহ (১৮৭৮-৮৯), উরিষ্যার খোন্দ বিদ্রোহ (১৮৬২-৯৪), বীরসা ভগবানের নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৫-১৯০০) প্রভৃতি ঔপনিবেশিকতাবিরোধি বিদ্রোহে বরাবরই সাধারণ মুক্তিকামী মানুষেরা আশার আলো খুঁজে পেয়েছে শ্রেনী সংগ্রামের মধ্যে। প্রতিটি বিদ্রোহই ছিল সামন্ততন্ত্র বিরোধী, ঔপনিবেসিকতা বিরোধী, এবং সর্বোপরি ব্রিটিশ শাসন বিরোধী। ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এ সমস্ত বিদ্রোহ। ব্রিটিশ শাসকেরা এবং তাদের তল্পিবাহক পুলিশেরা নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে এ বিদ্রোহগুলো দমন করার প্রয়াস পায়। তারপরও কৃষক, আদিবাসী এবং জনগণ আবারো বিদ্রোহ করেছে, আবারো পরাস্ত হয়েছে, তারপর আবারো নিজেদের সংগঠিত করে ফুঁসে উঠেছে পুনর্বার। সাঁওতাল বিদ্রোহের মহান নেতা কানুকে ইংরেজ ঔপনিবেসিকরা ফাঁসি দেয় ১৮৫৬ সালের ২৩ এ ফেব্রুয়ারী। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কানু নির্ভিক চিত্তে ঘোষণা করেছিলেন –
“আমি আবার আসব, আবার সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব’।
কানুরা যে বার বার ফিরে আসে ব্রিটিশদের তাতে কোনই সন্দেহ ছিল না। কখনো এরা আসে তীতুমীর, কখনো গিরিজন, কখনো ক্ষুদিরাম, কখনো যতীন মুখার্জি, কখনো বা আসে সূর্যসেন কখনো বা তারকেশ্বরের রূপ ধরে। চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর ধৃত মাস্টারদা সূর্যসেন ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারী কানুর মতই ঠিক একইভাবে বিপ্লবী সংগীত গেয়ে হাসিমুখে উঠে গিয়েছিলেন ফাঁসির মঞ্চে – পুর্ণতা দিয়েছহিলেন কানুর বলে যাওয়া কথা – ‘আমি আবার আসবো, আবার সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব’ নামের অমর মহাকাব্যের।
এভাবেই বিদ্রোহী ভারতবর্ষ প্রতিটি যুগে, প্রতিটি শতাব্দীতে স্বপ্ন দেখেছে শোষণ মুক্তির, সোচ্চার হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে, নিশান উড়িয়েছে স্বাধীনতার।
ছবিঃ ফুলবাড়ি আর কানসাটের জায়গায় মার্ক্সিজম আজও প্রাসঙ্গিক।এমনকি অতি সাম্প্রতিক সময়েও আমরা দেখেছি ফুলবাড়ি বা কানসাটে প্রান্তিক মানুষেরা কিভাবে ফুঁসে উঠেছিলো। মার্ক্সবাদ সবময়ই তাদের কাছে এক ধরনের আলোকবর্তিকা।
যে সমস্ত সমাজব্যবস্থায় শ্রেনী বৈষম্য এবং শ্রেনী নিপিড়ন বিদ্যমান সে সমস্ত ব্যবস্থায় মার্ক্সের শিক্ষা এবং তত্ত্ব যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। আমার প্রবন্ধের উপসংহার আসলে সেই অবস্থান থেকেই। আমি মনে করি ‘বৈজ্ঞানিক’ নয় বরং আধুনিক মানবতাবাদী দৃষ্টিকোন থেকেই আজকের দিনে মার্ক্সিজমের গুরুত্ব এবং আরোপযোগ্যতা বিবেচনা করা উচিৎ। কারণ সমাজতন্ত্রের অবস্থান এশিয়া এনার্জর মত রক্তপিপাসু মুনাফালোভী বহুজাতিক কোম্পানির হীন উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে এখনো প্রচন্ড ভাবেই মানবিক – অন্ততঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তো বটেই। এটাকে অস্বীকার করা বোকামী।
ছবিঃ দেরিদা মার্ক্সিজমকে 'সায়েণ্টিফিক সিস্টেম' থেকে আলাদা করে ‘মরাল সিস্টেমে’ এর প্রয়োগ চান।
পোস্ট মডার্নিস্ট মার্ক্সিস্ট দেরিদা তার Specters of Marx (1994) বইয়ে বলেন, তিনি মার্ক্সের তত্ত্ব নয়, মার্ক্সিজমের এই মুক্তিকামী ‘স্পিরিট’টিকে তিনি সমর্থন করেন। তিনি মার্ক্সিজমকে বিজ্ঞান নয়, বরং ‘লিঙ্ক অব এফিনিটি, সাফারিং এন্ড হোপ’ হিসবে এখন দেখতে চান। অনেকটা স্টিফেন জে গুল্ড যেমন দর্শনে ‘স্বতন্ত্র বলয়’ প্রবর্তন করে ধর্মকে বিজ্ঞান থেকে আলাদা রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, ঠিক তেমনি, দেরিদা মার্ক্সিজমকে ‘সায়েণ্টিফিক সিস্টেম’ থেকে আলাদা করে ‘মরাল সিস্টেমে’ এর প্রয়োগ চান। তিনি মনে করেন আজকের দিনের প্রেক্ষাপটে তার এই প্রস্তাবনা মার্ক্সিস্টদের মেনে নেওয়া উচিৎ। মার্ক্সবাদ সম্পর্কে আমার দার্শনিক অবস্থানও অনেকটা দেরিদার মতই। মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞান হবার তার দরকারও নেই। কিন্তু মার্ক্সবাদ থাকুক হাজারো নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ে মুক্তির আলোকবর্তিকা হয়ে।
আমি শঙ্কর রায়কে তার সুলিখিত লেখাটির জন্য আবারো ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সেপ্টেম্বর ০৩, ২০০৮
* ডিসক্লেমার - আমার 'মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?' প্রবন্ধটি 'Is Marxism Scientific?' - এই শিরোনামের বাংলা হিসবে পড়তে অনুরোধ করছি। শুরুতে এর বাংলা করেছিলাম - 'মার্ক্সবাদ কি বৈজ্ঞানিক?'। কিন্তু বাংলায় বৈজ্ঞানিক শব্দটা অনেক সময় 'বিজ্ঞানী' অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই বদলে শিরোনাম করেছি - 'মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?', কিন্তু প্রবন্ধে মূল সুরটি 'সায়েন্টিফিক' হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
এছাড়া দেখুন - মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান? কিছু আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যা
ড. অভিজিৎ রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক। সাম্প্রতিক প্রকাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ – ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’। সম্প্রতি 'বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়?' শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত। ইমেইল : [email protected]