অসম্ভবের বিজ্ঞান
(৩য় পর্ব)

অভিজি রায়

২য় পর্বের পর...

টেলিপোর্টেশন বা সময়পরিভ্রমণের মত ‘অসম্ভবের বিজ্ঞানের’ আলোচনা এ পর্বে না হয় বাদ থাকুক - আপনাদের যদি বলা হয় আগামি ২৫ বা ৩০ কিংবা ৫০ বছরের মধ্যে যে সমস্ত প্রযুক্তিকে চোখের সামনে ঘটতে দেখবেন বলে মনে করছেন তার একটা তালিকা বানাতে, আপনি কি বানাতে পারবেন? তৈরি করতে পারবেন ‘অসম্ভভবের প্রযুক্তির’ সম্ভাব্যতার একটা ‘ঝাকাস তালিকা’? ভবিষ্যদ্রষ্টা হিসেবে কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক আমার পছন্দের তালিকার প্রথম দিকে তা তো আগেই বলেছি। এর অনেকগুলো কারণ আছে। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত "প্রিলিউড টু স্পেস" বইয়ে তিনি মানুষর চাঁদে যাওয়ার অনুমান করেছিলেন। নিল আর্মস্ট্রং আর অলড্রিন মিলে ক্লার্কের কল্পণাকে সার্থকতা দেন ১৯৬৯ সালে। তারও আগে, ক্লার্ক  ১৯৪৫ সালে ‘ওয়্যারলেস  ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন’ পত্রিকার একটি প্রবন্ধে পৃথিবীর চারিদিকে কৃত্রিম উপগ্রহ পরিভ্রমণের কথা উল্লেখ করেছিলেন।  আর্থার সি ক্লার্কের কল্পণাকে সার্থকতা দিয়ে বিজ্ঞানীরা ভূউপগ্রহ প্রেরণ করেন  ১৯৬৪ সালে – ক্লার্কের করা ভবিষ্যদ্বানীর ১৯ বছরের মধ্যেই। শুধু তাই নয়,  উপগ্রহের এই কক্ষপথকে  এখন "ক্লার্ক অর্বিট" বলেও অভিহিত করেন  অনেকে। আবার, ১৯৯০ সালে "দ্য ঘোস্ট ফ্রম দ্য গ্র্যান্ড ব্যাংক্‌স" উপন্যাসে মিলেনিয়াম বাগের কথা উল্লেখ করেছিলেন ক্লার্ক ।  ক্লার্কের সেই ‘Y2K’ বাগ সত্য হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা পিসিগুলোতে হানা দিয়েছিলো ২০০০ সালের শুরুতে। ক্লার্ক তার ১৯৭৯ সালের ‘দ্য ফাউন্টেন্ট অব প্যারাডাইস’ নামক নভেলে ‘স্পেস এলিভেটরের’ কল্পণা করেছিলেন, তিনি এ নিয়ে একটা টেকনিকাল পেপারও লিখেছিলেন –‘Space Elevator: Thought Experiment, or Key to the Universe?’ শিরোনামে। ক্লার্কের এ ভবিষ্যদ্বানীও আজ স্রেফ কল্প-কাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে নেই।  বহুদিন হতে চলল নাসা এই ক্লার্ক কল্পিত স্পেস এলিভেটরের উপর প্রজেক্ট হাতে নিয়ে কাজ করে চলেছে। হয়ত বছর দশেকের মধ্যে ক্লার্কের সে  কল্পনাটিও বাস্তবতা পেয়ে যাবে। মানুষের মস্তিস্কের তথ্যকে কম্পিউটারে ব্যাক-আপ করে রাখার কথা, কিংবা দেহকে হিমায়িত করে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার কথা ক্লার্কের বিভিন্ন উপন্যাসে ঘুরে ফিরে কয়েকবারই এসেছে। কম্পিউটার-ব্রেন ম্যাপিং এবং ‘ক্রায়োজেনিক সংরক্ষণ’  নিয়ে বিজ্ঞানীদের  আধুনিক গবেষণা হয়ত অচীরেই ক্লার্কের এ স্বপ্নগুলোকেও সফল করে তুলবে খুব তাড়াতাড়িই। কম্পিউটার-ব্রেন ম্যাপিং এর মাধ্যমে বেশ  কয়েকজন রোগীকে ইতিমধ্যেই ‘লক-ইন সিনড্রোম’ থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। প্রায় দেরশত মানুষকে তাদের মৃত্যুর পর হিমায়িত করে রাখা হয়েছে। এহেন ‘বিজ্ঞানের পয়গম্বর’ ক্লার্ক যদি আমাদের প্রযুক্তির ভবিষ্য-সম্ভাব্যতা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কোন সুনির্দিষ্ট মতামত দেন, তা যে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি করবে তা বলাই বাহুল্য।    ক্লার্ক কিন্তু সত্য সত্যই আমাদের জন্য এরকম একটা তালিকা বানিয়েছিলেন - Predictions for the 21st Century শিরোনামে। সেটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯৯ সালে। মুক্তমনা সদস্য শিক্ষানবিস লেখাটির  বাংলা  করেছেন, তা পাওয়া যাবে এখানে।  আমি তা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না –

 

২০০৯ - তৃতীয় বিশ্বের একটি শহর নিজ দেশে প্রস্তুতকৃত পারমাণবিক বোমার দুর্ঘটনামূলক বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। জাতিসংঘে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর বিশ্বব্যাপী নিউক্লীয় অস্ত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।


২০১০ - মহাকাশ শক্তি সংগ্রহ করার মাধ্যমে প্রথম কোয়ান্টাম জেনারেটর নির্মীত হবে। বহনযোগ্য পর্যায়ে চলে আসায় গৃহস্থালি থেকে শুরু করে সর্বত্র এটি ব্যবহৃত হতে শুরু করবে। কয়েক কিলোওয়াট থেকে অসীম পরিমাণ বিদ্যুপাদনে সক্ষম এই জেনারেটর। কেন্দ্রীয় বিদ্যুপাদন স্টেশনগুলো বন্ধ হয়ে যায়; গ্রিড ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায় পাইলন যুগের সমাপ্তি ঘটে। ইলেকট্রনিক মনিটরিংয়ের কারণে সাধারণ অর্থে পৃথিবী থেকে পেশাদার ক্রিমিনাল বিলুপ্ত হয়ে যায়।


২০১১ - বৃহত্তম জীব সনাক্ত করা হয়: মারিয়ানা টেঞ্চে পাওয়া এই অক্টোপাসের দৈর্ঘ্য ৭৫ মিটার।
বিস্ময়কর কাকতাল। এ বছরেরই শেষ দিকে রোবোট প্রোব ইউরোপার (শনির উপগ্রহ) পুরু বরফের আস্তর খনন করে নতুন ধরণের বায়োটার সন্ধান পায়। এর আকার হয় মারিয়ানা টেঞ্চের অক্টোপাসের থেকেও বড়।

২০১২ -অ্যারোস্পেস-বিমান চালু হয়।

২০১৩ - বাকিংহাম প্যালেসের বিশেষ উকণ্ঠা সত্ত্বেও প্রিন্স হ্যারি রয়েল পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে মহাকাশে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে।


২০১৪ - হিল্টন অর্বিটার হোটেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিশাল আকারের নভোখেয়াযানের যে ট্যাংকগুলোকে আগে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার কথা উঠেছিল সেগুলো দিয়েই শুরু হয় এ নির্মাণকাজ।


২০১৫ - কোয়ান্টাম জেনারেটরের একটি অবশ্যম্ভাবী উপজাত হল পারমাণবিক স্তরে পদার্থের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। এর ফলে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আলকেমির প্রাচীন স্বপ্নের তাপর্য বোঝা যায়। এই জেনারেটর জনপ্রিয় হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে তামা ও সীসার দাম স্বর্ণের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যায়।


২০১৬ - বর্তমানে অস্তিত্বশীল সব মুদ্রা বিলুপ্ত হয়। মেগাওয়াট-ঘন্টা হয়ে উঠে বিনিময়ের একমাত্র একক।


২০১৭ - ১৬ই ডিসেম্বর আর্থার সি ক্লার্কের ১০০তম জন্মদিনে তিনি হিল্টন অর্বিটারের প্রথম অতিথিদের একজন হিসেবে মহাকাশে যান।


২০১৮ - উত্তর মেরুর হিমমুকুটে (আইসক্যাপ) একটি বড় আকারের উল্কা আঘাত হানে। কোন জীবনহানি না ঘটলেও সৃষ্ট সুনামিতে গ্রিনল্যান্ড ও কানাডার উপকূলরেখা বরাবর বেশ কিছু অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক দিন ধরে আলোচিত "স্পেসগার্ড প্রকল্প" চালু হয়। এর কাজ মহাকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে আগত ক্ষতিকর উল্কা, গ্রহাণু বা ধূমকেতুকে কক্ষচ্যুত করে অন্যদিকে পাঠিয়ে দেয়া।

২০২০ - কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের সমপর্যায়ে চলে আসে। এখন থেকে পৃথিবীতে দুটি বুদ্ধিমান প্রজাতি বসবাস করছে। জৈব প্রজাতির বিবর্তন অনেক ধীর, কিন্তু অনেক দ্রুত বিবর্তিত হচ্ছে অন্য প্রজাতিটি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিকটবর্তী তারার উদ্দেশ্যে প্রেরিত হচ্ছে বিভিন্ন মহাকাশ অভিযান।


২০২১ - মানুষ মঙ্গলে অবতরণ করে এবং বেশ কিছু অস্বস্তিকর চমকের সন্ধান পায়।


২০২৩ - কম্পিউটারের মাধ্যমে উৎপাদিত ডিএনএ থেকে ডাউনোসরের প্রতিরূপ ক্লোন করা হয়।

 ফ্লোরিডাতে "ট্রায়াসিক জু" গড়ে তোলে ডিজনি। প্রথম দিকে কিছু দুর্ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও একসময় পোষা কুকুরের জায়গা করে নেয় ছোট আকারের র‌্যাপ্টর।


২০২৪ - ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে আসা অবলোহিত সংকেত সনাক্ত করা হয়। এগুলো প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে থাকা কোন সভ্যতা থেকে প্রেরিত। কিন্তু এই সংকেতগুলোর মর্মোদ্ধারের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।


২০২৫ - স্নায়ুবিজ্ঞানের ক্রমান্বয়িক অগ্রগতির মাধ্যমে মানুষের সকল চেতনা ও বোধের জৈবিক প্রক্রিয়া বোঝা সম্ভব হয়। চোখ, কান ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে বাইরে থেকে ইনপুট দেয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। ফলস্বরূপ নির্মীত হয় ধাতব "ব্রেইনক্যাপ"। বিংশ শতাব্দীর "ওয়াকম্যান" ছিল এই ব্রেইনক্যাপের প্রাথমিক পর্যায়ের পূর্বসূরি। খুলির সাথে দৃঢ়ভাবে আটকে থাকা এই হেলমেটটি পরে যে কেউ সম্পূর্ণ অভিনব এক অভিজ্ঞতার জগতে চলে যেতে পারবেন। সেটা বাস্তব না কাল্পনিক বোঝার উপায় থাকবে না। একই সাথে তিনি অন্যের মনের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে পারবেন।

২০৪০ - ন্যানো-প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে "ইউনিভার্সাল রেপ্লিকেটর" নির্মাণ সম্ভব হয়। যেকোন বস্তু, তা সে যত জটিলই হোক কেন, পুনর্নিমাণ করা সম্ভব হবে এর মাধ্যমে। বস্তুটি তৈরীর সকল কাঁচামাল আর তথ্য ম্যাট্রিক্স থাকলেই হল। ধূলি থেকেও হীরা বা সুস্বাদু খাবার তৈরী করা সম্ভব। এর ফলে কৃষি ও শিল্প কারখানার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসে, সেই সাথে ফুরিয়ে যায় মানুষের কাজ করার প্রয়োজনীয়তা। এর ফলে শিল্পকলা, বিনোদন ও শিক্ষার বিস্ফোরণ ঘটে। ইচ্ছাকৃতভাবে পুনরায় হান্টার-গ্যাদারিং সমাজ সৃষ্টি করা হয়। পৃথিবীর বিশাল অঞ্চল (যেখানে আগে কৃষিকাজ হতো) পতিত হয়ে যায়। এই পতিত জমিকে প্রাচীন বুনো অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।


২০৪৫ - সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়, পুনরুপাদনে সক্ষম ও বহনযোগ্য বাড়ি নির্মাণ করা হয়। প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে বাকমিনস্টার ফুলার এমন বাড়ির ধারণা দিয়েছিলেন। খাবার সংশ্লেষের জন্য প্রয়োজনীয় কার্বন পরিবেশের কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে সংগ্রহ করা হয়।


২০৫০ - "ইউটোপিয়া থেকে পলায়ন"। এই নিরস ও শান্তিপূর্ণ জগতে থেকে বিরক্ত হয়ে উঠে মানুষ। লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্রায়োনিক সাসপেনশনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে অভিযান চালায়, অ্যাডভেঞ্চারের আশায়। অ্যান্টার্কিটাকা এবং চান্দ্র মেরুর চিরকাল অন্ধকারে থাকা অঞ্চলগুলোতে "হাইবারন্যাকুলাম" প্রতিষ্ঠিত হয়।

২০৫৭ - ৪ঠা অক্টোবর, স্পুটনিক ১ এর ১০০ বছর পূর্তি। মহাকাশ যুগের সূচনা উদ্‌যাপিত হয়; শুধু পৃথিবী নয়, চাঁদ, মঙ্গল, ইউরোপা, গ্যানিমেড, টাইটানের পৃষ্ঠে এবং শুক্র, নেপচুন ও প্লুটোর কক্ষপথে থাকা সব মানুষ একসাথে উদ্‌যাপন করে এই অনন্যসাধারণ দিনটি।

২০৬১ - হ্যালির ধূমকেতু ফিরে আসে। প্রথমবারের মত ধূমকেতুর নিউক্লিয়াসে অবতরণ করে মানুষ। প্রভাবশালী ও সক্রিয় জীবনের অস্তিত্ব পাওয়ার পর প্রমাণিত হয় যে, মহাবিশ্বের সর্বত্র সমভাবে জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে। হয়েল বিক্রমাসিংহে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে এই তত্ত্বটি দাড়া করিয়েছিলেন।

২০৯০ - বায়ু থেকে উত্তোলিত কার্বন ডাই অক্সাইডকে প্রতিস্থাপিত করার জন্য আবার বিশাল পরিমাণে জীবাশ্ম-জ্বালানি পোড়ানো শুরু হল। ভৌগলিক উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে পরবর্তী বরফ যুগকে পিছিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা শুরু করলো মানুষ।


২০৯৫ - একটি সত্যিকারের "মহাকাশ ড্রাইভ" নির্মীত হয়। এর মাধ্যমে স্থান-কালের মৌলিক গঠনের বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম প্রচালন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে। এর ফলে রকেটের ব্যবহার কমে যায় এবং মানুষ আলোর কাছাকাছি বেগ অর্জন করতে সক্ষম হয়। নিকটবর্তী তারাগুলোতে রোবট অভিযান প্রেরণে সফলতা আসায় মানুষ সশরীরে সেই তারাগুলোতে যাত্রা শুরু করে।

২১০০ - ইতিহাস শুরু হয় ...

(উসঃ আর্থার সি ক্লার্কের ভবিষ্যবাণী, অনুবাদঃ শিক্ষানবিস)

  

শুধু কল্পবিজ্ঞান লেখকরা নয় - অনেক সংগঠন কিন্তু বাস্তবেই আছে যারা এ ধরণের জিনিস নিয়েই নিরন্তর কাজ করেন। আজকের জ্ঞান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং অবস্থানের সাপেক্ষে তারা মানুষকে একটা ধারনা দিতে চেষ্টা করেন যে, আগামী কয়েক দশকে মানব সভ্যতা কোথায় পৌছুঁতে পারে।  এমনি একটি সংগঠন হল ‘ওয়ার্ল্ড ফিউচার সোসাইটি’। তাদের দেওয়া ভবিষ্যদ্বানীগুলো অনেকটা এরকম।  আগামী পঁচিশ বছরে আমাদের সমাজ এবং  প্রযুক্তি কোথায় চলে যেতে পারে, তা জানবার জন্য ‘ওয়ার্ল্ড ফিউচার সোসাইটি’র করা নীচের ভিডিওটা দেখা যেতে পারে-

 

আসুননা, আমরাও আমাদের চিন্তা থেকে এরকম একটা তালিকা করার চেষ্টা করি।  তালিকাটা কি অনেকটা আমার করা নীচের লিস্টির মত দেখাবে?

 

১।  ইন্টারনেট হয়ে উঠবে যোগাযোগের অনেকটাই মূল এবং জনপ্রিয় মাধ্যম।  ওয়েবসাইট গুলো হয়ে উঠবে  সচলায়তনের মত অনেক বেশী ইন্টার-এক্টিভ।  নিউজপেপারের ‘স্ট্যাটিক পেজ’ গুলো ব্লগের মত ডায়নামিক হয়ে উঠবে, যার ছোঁয়া এখনই বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে।   হয়ত ভবিষ্যতে এর সাথে যুক্ত হবে ভিডিও কনফেরেন্সিংও।  থাকবে নিউজপেপারের কলামিস্টের সাথে সরাসরি ভার্চুয়াল যোগাযোগের ব্যবস্থা।  অনেকের জীবন হয়ে উঠবে একেবারেই ‘ভার্চুয়াল’ময়। তাদের ‘সাইবার বন্ধু’র সংখ্যা  সত্যিকার চেনা জানা বন্ধুদের  সংখ্যাকে অতিক্রম করে যাবে।

 

তবে ইন্টারনেট জনপ্রিয় হবার সাথে সাথে আইডেন্টিটি চুরি সহ অন্যান্য আন্তর্জালিক অপরাধও পাল্লা দিয়ে আরো বাড়বে।

 

২।  টিভি এবং সিনেমা হলগুলো হয়ে উঠবে থ্রিডি (জার্ণি টু দ্য সেন্টার অব দি আর্থের ত্রিডি ভার্শন দেখেছেন নাকি মুভি হলে?)।

 

৩। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৮০ ভাগ এলাকায় বিদ্যু পৌঁছে যাবে। 

 

তেলের উপর অব্যাহত চাপ কমানোর চেষ্টা থেকে নবায়নযোগ্য শক্তির উপর গবেষণা বাড়বে। খনিজ তেলের  বিকল্প হিসেবে  অন্য কোন শক্তি যানবাহনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করার চিন্তা অব্যাহত থাকবে। হাইব্রিড গাড়ির ব্যবহার বাড়বে, যতদিন পর্যন্ত না চূড়ান্ত বিকল্প কিছু খুঁজে পাওয়া যায়।

 

৪। ‘চেতনা সম্পন্ন যন্ত্র’ (self-aware machine) ছোট স্কেলে হলেও হয়ত বাজারে চলে আসবে, আগামী শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে। রবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং কম্পিউটার নিয়ে অব্যাহত গবেষণা অদূর ভবিষ্যতে উন্মোচন করবে আর্থার সি ক্লার্কের সেই Hal 9000 তৈরির দুয়ার। 

 

৪।  গুগলের মত সার্চ ইঞ্জিনগুলো আগামী ২৫ বছরের মধ্যে হয়ে উঠবে অনেক বেশী মানব সদৃশ (Human like)। এ সমস্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর (AI-based) সার্চ ইঞ্জিনগুলো অনেকটা মানুষের মতই প্রশ্ন শুনে এবং এর উত্তর দিয়ে  সাহায্য করবে।

                        

৫।  ‘জেনেটিক থেরাপী’ চিকিসাক্ষেত্রে বিপ্লব নিয়ে আসবে।  যে বংশগত বিভিন্ন রোগ ঔযধ প্রয়োগে এতদিন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না, (মানুষের জিনোমের উপর চিকিসকদের জ্ঞান বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে)  সেগুলো জেনেটিক কোড বদলে দিয়ে নিরাময় করা সম্ভব হবে। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস কিংবা ক্যান্সার চিকিসায় নতুন দিগন্ত সূচিত হবে, এবং এগুলোর চিকিসা হয়ে উঠবে অনেক নিরাপদ।

 

কিন্তু এ ধরনের জিনগত চিকিসা চালুর  কারণে মানুষের ভয় এবং উকন্ঠাও পাল্লা দিয়ে বাড়বে। কারণ অনেকেই নিজের ডিএনএর বিন্যাস পালটে দিয়ে চেহারা এবং দেহের গঠণ অনেক আকর্ষনীয় করে তুলতে চাইবে, কেউ বা অর্জন করে চাইবে  লাইটনিং বোল্টের মত ক্ষিপ্রতা, কিংবা পেতে চাইবে আইনস্টাইনের মত বুদ্ধিমত্তার।  কোন্ টি করা নৈতিক আর কোনটি অনৈতিক – এ নিয়ে আদর্শিক দ্বন্দ্ব বাড়বে। রাষ্ট্র হয়ত চেষ্টা করবে একটা নিয়মে গবেষক এবং চিকিসকদের বেধে রাখতে।

 

৬। সিন্থেটিক রক্ত এবং  গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে তৈরী বিভিন্ন অংগ-প্রত্যংগ ক্রমশঃ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে চিকিসাক্ষেত্রে এবং প্রযুক্ত হবে মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচানোর ক্ষেত্রে।

 

৭। ভবিষ্যতের বইগুলো সেলফোনে শোনা যাবে, কিংবা এর টেক্সট সেলফোনে ডাউনলোড করা যাবে।

 

৮।  যানজট সমাধানের জন্য ‘ফ্লাইং কার’গুলো শেষ পর্যন্ত বাজারে আসবে। জামে পড়লেই সেগুলো আকাশ পথে উড়াল দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছুবে। এতে সময় এবং শক্তি দুই-ই বাঁচবে।   তবে তাদের চলাচলের জন্য রাষ্ট্র এবং সরকারকে দিতে হবে নতুন নীতিমালা।

 

৯। সনাতন স্কুল-কলেজের শিক্ষার জনপ্রিয়তায় ঘাটতি শুরু হবে। অন্যদিকে অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতিগুলো আরো আকর্ষনীয় হয়ে উঠবে। স্কুল লাইব্রেরি গুলোও হয়ত হয়ে যাবে ভার্চুয়াল।  Avatar জাতীয় কোন ভার্চুয়াল শিক্ষক ছাত্রদের গাইড করবেন নিপুন দক্ষতায়!

 

১০।  মানববিধ্বংসী অস্ত্র নিউক বোমা, জৈবঅস্ত্র ইত্যাদি টেরোরিস্টদের হাতে সহজলভ্য হয়ে উঠতে পারে। খুব বেশি কষ্ট করে সংগ্রহ না করে হয়ত নিজেরাই তা বানিয়ে নিয়ে পারবে, সে সমস্ত টেকনোলজি চলে যেতে পারে টেরোরিস্টদের হাতে।   জিনোমিক্স, ন্যানোটেকনোলজি এবং মাইক্রোসায়েন্সের উন্নতির পাশাপাশি এদের অপব্যাবহারও বাড়বে, বাড়বে বায়ো-ভায়োলেন্সের আশংকাও। অবশ্য  রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাও হয়ে উঠবে পাল্লা দিয়ে আধুনিক।

 

তালিকাটা তো আরো বাড়ানো যায় নিঃসন্দেহে ...।

 

এই পর্বটা সচলায়তন নামের একটি বাংলা ব্লগে দেওয়ার পর সেখানকার পাঠকদের কাছ থেকে অনেক আকর্ষনীয় কিছু ভবিষ্যদ্বানী পাওয়া গেছে।  কেউ বলেছেন, ভবিষ্যতের পৃথিবিতে বুদ্ধিমান সিস্টেম এর ব্যাপক উন্নতি এবং প্রচলন হবে। ফলে ব্যাপক হারে মানুষ বেকার হবে, কেউ বলেছেন, ভবিষ্যতে প্রকৃতিজাত খাবার হয়ে যাবে দুর্লভ এবং দুর্মূল্য। তখন শরীরের প্রয়োজনমেটাতে মানুষ কেবল  বিভিন্ন স্বাদের ক্যাপসুল খাবে। কেউবা আবার বলেছেন, চা খাওয়ার কথা মনে মনে ভাবলেই ট্রে-সমেত চা নাচতে নাচতে চলে আসবে। কেউ বলেছেন, মোবাইলের মাধ্যমেই ভবিষ্যতে  সব ব্যাঙ্কিং হবে ক্যাশলেস ট্রান্সাকশনের মাধ্যমে। কেউবা  আবার অতি আশাবাদী হয়ে বলেছেন, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সব দেশ সামরিক বাহিনী বিলুপ্তির প্রক্রিয়া শুরু করবে, আর আগামী ২০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে সব ধরণের মারণাস্ত্র উপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।  আশা করতে দোষ কি - আশা নিয়ে ঘর করি, আশায় পকেট ভরি ...

 

আপনারাও এতে অংশ নিন না! আপনি যে যে প্রযুক্তিগুলোকে অদূরভবিষ্যতে চোখের সামনে কিংবা কল্পণায় ঘটতে দেখতে চান – তার একটা তালিকা করে ফেলুন চটপট।  হয়ত আপনিও হতে পারেন ভবিষ্যতের জুলভার্ণ কিংবা আর্থার সি ক্লার্ক!  কে জানে!

অক্টোবর ২৮,

চতুর্থ পর্ব পড়ুন...

 


. অভিজি রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজ' গ্রন্থের লেখক সাম্প্রতিক প্রকাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ – ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’। সম্প্রতি 'বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়?' শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত।  ইমেইল : [email protected]