যুক্তিবাদীর বিজয় - রিজন হ্যাজ ওন দ্যা ডে
এ বছরের তেসরা মার্চ যুক্তিবাদীদের পক্ষে সূচিত হল আরেকটি বিজয়। র্যাশনালিস্ট ইটারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট যুক্তিবাদী স্যানাল এডমারাকুর চ্যালেঞ্জের সামনে ভারতের এক স্বনামখ্যাত তান্ত্রিকের তন্ত্রবিদ্যার গুমোড় ফাঁস হয়ে গেল – লাখ লাখ টিভি দর্শকের সামনে। অনেক দিন ধরেই যুক্তিবাদীরা বলে আসছেন – এই তন্ত্র মন্ত্র, দোয়া দরুদ – সবই আসলে ভং চং – এর পেছনে না আছে কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, না আছে কোন যুক্তি। সাধারণ মানুষের ভয় আর বিশ্বাস পুঁজি করে লোক ঠকানোই আসলে তান্ত্রিকদের একমাত্র ব্যাবসায়িক পুঁজি। তাদের ব্যাবসা টিকে আছে তা পুরোটাই ধাপ্পাবাজি আর ধান্দাবাজির উপরে। ভয়, অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার যে ডাল পালা ছড়িয়ে ভালভাবে টিকে আছে তা বোঝা যায় পত্র-পত্রিকা খুললেই তান্ত্রিক সম্রাট, যোগ সম্রাট, ফকির সাধুদের ঢাউস আকারের বিজ্ঞাপন দেখলে। আমেরিকায় ঠিকানা নামে একটা পত্রিকা বেরোয় প্রতি সপ্তাহে। প্রবাসি বাঙ্গালিদের কাছে কাটতির দিক দিয়ে ‘পয়লা নম্বর’ সাপ্তাহিকী। ত্রিশ-চল্লিশ পৃষ্ঠার বিশাল বপু এ পত্রিকাটিতে যত না খবর থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে কামেল পীর, সাধু সন্ন্যাসী আর তান্ত্রিকদের বিজ্ঞাপন। শিরিন বকুল, পীর সায়িদ সাহেব, ব্রহ্মাচারী হরেন্দ্র দত্তের পাতার পর পাতা মন্ত্রের শক্তির বিজ্ঞাপন। মন্ত্র দিয়ে শত্রুকে বশ করা থেকে শুরু করে ব্যর্থ প্রেম জোড়া লাগানো, লটারী জেতা কিংবা হারানো যৌন শক্তি ফেরৎ পাওয়া কি না করা যায় তাতে। আমি মাঝে মধ্যেই ভাবি, হাজার জাহার মাইল দূর থেকে মন্ত্র পড়ে শত্রুকে বশ করাই যেত, তবে প্রেসিডেন্ট বুশ কেন বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ করে তার দেশের সেনাবাহিনী ফেলে রেখেছেন ইরাকে কে জানে! বুশ সাহেবের যা করতে হবে, তা হল শিরিন বকুল কিংবা কোন কামেল তান্ত্রিককে হোয়াইট হাউজে ডেকে নিয়ে জোরসে মন্ত্র পড়ানো। তা হলেই বশীকরণ মন্ত্রের ঠ্যালায় শত্রুপক্ষ কুপোকাৎ হতে থাকবে সেকেন্ডে সেকেন্ডে। চিন্তা করুণ – কি মজা - সাপও মরল, লাঠিও ভাংলো না। হাজার হাজার আমেরিকান সৈন্যের প্রাণহানি এড়িয়ে বুশ সাহেব তার হারিয়ে যাওয়া জনপ্রিয়তাকে শনৈ শনৈ বাড়িয়ে নিয়ে পারতেন (প্রেসিডেন্ট বুশের পলিসির একনিষ্ঠ সমর্থক সিতাংশু গুহ এবং তার দলবল এ ব্যাপারে এক্ষুনি বুশকে পরামর্শ দিতে পারেন)। আরো একটা ব্যাপার, তান্ত্রিক বাবাজীদের দাবী অনুযায়ী, তন্ত্র-মন্ত্রে যদি লটারীর টিকেটও জিতা যায়, তবে সেই কামেল তান্ত্রিকরা কেন নিজেরাই মন্ত্র পড়ে লটারী জিতে নেননা, তাও একটি প্রশ্ন বটে।
তবে কামেল পীরের ভক্তরা অবশ্য যুক্তিবাদীদের এ ধরণের বখাটে প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিতই করবেন। বলবেন – ‘এ সব প্রশ্ন কখনো করো না, বোবা কালা হয়ে থাকো’। তা বোবা কালা হয়ে থাকা ভালই তাদের জন্য। কারণ জনগন যত বোবা কালা সেজে তাহাকে ততই তাদের সুবিধা। ধান্ধাবাজি আর ধাপ্পাবাজির জম্পেশ খেলা চালিয়ে যাওয়া যায় নিরুপদ্রপে। তারপরো তাদের নিরুপদ্রপ জীবনে অশান্তি হয়ে দেখা দেয় কিছু বখাটে যুক্তিবাদী। তেমনি একজন যুক্তিবাদী স্যানাল এডমারাকু। ইন্ডিয়া টিভির ‘তান্ত্রিক শক্তি বনাম বিজ্ঞান’ নামের একটি প্রোগ্রামে হাজির করা হয়েছিল ভারতের বিখ্যাত তান্ত্রিক পন্ডিত সুরিন্দর শর্মাকে। এই সুরিন্দর শর্মার প্রভাব এবং খ্যাতি ভারতের রাজনৈতিক মহলে খুবই ব্যাপক। নিজেও টিভি শো করে থাকেন। আর যুক্তিবাদীদের পক্ষ থেকে হাজির করা হয়েছিল স্যানালকে। তান্ত্রিক বাবাজী যথারীতি আকাশ পাতাল কাপিয়ে তন্ত্রের কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। স্যানাল মাজখান থেকে বাগড়া দিয়ে বললেন, তন্ত্র মন্ত্রে যদি এতই অসাধ্য সাধন করা যায়, তবে দেখুন তো মন্ত্র পড়ে আমার কোন ক্ষতি করতে পারেন কিনা। বললেন, আমি চ্যালাঞ্জ করছি – আপনি আমার কচুটাও করতে পারবেন না। তান্ত্রিক বাবাজী ভয় দেখিয়ে আর পালটা চ্যালেঞ্জ করে বললেন, তিন মিনিট মন্ত্র পড়েই তিনি স্যানালকে মেরে ফেলতে পারবেন। স্যানাল সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। এর পরই শুরু হল খেলা।
তান্ত্রিক মন্ত্র পড়া শুরু করলেন – “ওম লিঙ্গালিঙ্গালিনালিঙ্গা কিলি কিলি ...’। তিন মিনিট গেল, পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল। মন্ত্র স্যানাল-এর উপর কোন প্রভাবই ফেললো না। তান্ত্রিক বাবাজী আরো দশ মিনিট চাইলেন। তাও বরাদ্দ হল। শুধু মন্ত্রে কাজ হচ্ছে না দেখে তান্ত্রিক বাবা স্যানালের হাত ডলে, কপাল ডলে, গঙ্গাজলের ছিটা দিয়ে আরো কত ভং চং করলেন, এমন কি ‘মন্ত্রপুত’ ধারালো ছুঁরির ছোঁয়াও লাগালেন । স্যানাল ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রসিকতা করতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন – তন্ত্র মন্ত্রে কোন কাজ হয় না। এগুলো স্রেফ কুসংস্কার। ওদিকে প্রগ্রামের নির্দিষ্ট সময় শেষ, কিন্তু তারপরো দর্শকদের চাপে অন্য সব প্রোগ্রামকে হটিয়ে দিয়ে ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে এটি প্রকাশিত হতে লাগল।
পাক্কা দু ঘন্টা পর কোন তন্ত্র মন্ত্রেই যখন কোন কাজ করল না, প্রোগ্রামের উপস্থাপক বললেন- তান্ত্রিক বাবা, আপনি ফেল মেরেছেন। কিন্তু তান্ত্রিক অত সহজে দমবার পাত্র নন। এত বড় তান্ত্রিক - দ্যুলোক, ভুলোক, ত্রিলোক ভেদ করা মন্ত্র যার দখলে, এক মন্ত্রেই রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ কাঁপিয়ে ফেলেন, সেই স্বনাম খ্যাত তান্ত্রিক পন্ডিত সুরিন্দর শর্মা এক সামান্য যুক্তিবাদীকে ঘায়েল করতে পারছেন না – এ বড় লজ্জার ব্যাপার। তান্ত্রিক আবারো মন্ত্র পড়লেন - “ওম লিঙ্গালিঙ্গালিনালিঙ্গা কিলি কিলি ...’। এবারো কিছুই হল না। তান্ত্রিক শেষ পর্যন্ত বললেন, নিশ্চয় কোন বড় কোন দেবতা স্যানালকে রক্ষা করছেন। প্রত্যুত্তরে স্যানাল বললেন – ‘আমি কোন দেবতায় বিশ্বাস করি না, আমি নাস্তিক’। তান্ত্রিক এর পর বললেন, কিছু কিছু মন্ত্র আছে কেবল রাতে কার্যকরী হয়। স্যানাল রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজী হলেন।
রাতে তান্ত্রিক আরো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করলেন। “ওম লিঙ্গালিঙ্গালিনালিঙ্গা কিলি কিলি ...’র সাথে চলতে লাগলো আরো রকমারী ইলি বিলি। একটি কাগজে স্যানালের নাম লিখে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করলেন, তারপর স্যানালকে তা স্পর্শ করতে বললেন। স্যানাল করলেন। কিছু হল না এবারেও। মন্ত্রের সাথে পানির ঝাপটা নিক্ষিপ্ত হল, সাথে সাথে চলল নর্তন কুর্দন। ময়ুরের পেখম দিয়ে গালে মুখে ঘষা মাজাও চলল। আগুনে গম, শিমের বীচি, আরো কত পদের জগাখিচুরি নিক্ষিপ্ত হল। কিন্তু ফলাফল যেই কি সেই। মধ্যরাতের তন্ত্রেও কিছুই হল না স্যানালের। দিব্যি হাস্যোজ্জ্বল এবং সুস্থ রইলেন। আর তান্ত্রিক বাবা লাখো দর্শকের সামনে নিজের পরাজয় স্বীকার করে নিলেন। পাঠকদের জন্য পুরো সার্কাসের ভিডিও দেওয়া হল ইউ টিউবের সৌজন্যে-
(১)
(২)
(৩)
বিখ্যাত যাদুকর এবং মুক্তমনা সদস্য জেমস র্যান্ডি স্যানাল এডমারাকুকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এই বলে – ‘Sanal! My congratulations for this excellent demonstration of rationality over superstition”, ...reason has won the day’। মুক্তমনার পক্ষ থেকেও আমরা স্যানালকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।
সত্যই রিজন হ্যাজ ওন দ্যা ডে! কংগ্র্যাটস টু স্যানাল!
মার্চ ৩১, ২০০৮
ড. অভিজিৎ রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক। ইমেইল : [email protected]