লেখাটির প্রথম পর্ব এখানে
রঙ্গমঞ্চে ‘ফেরেশতা রূপী’ আর্মি ব্যাকড সরকার তথা জলপাই বাহিনী হাজির হওয়ার পর যখন প্রায় সবাই প্রশংসাবাক্যে অস্থির, তখন ফোরামে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে – ‘জলপাই চাই না’ :
ন্যাড়া হয়ে পাঁচ পাঁচটি বার জলপাই তলায় গিয়েছি
পঁচা জলপাই-এর আচারের ঘ্রাণ শুঁকেছি, চেখেছিও ঢের
প্রতিবার চাখতে গিয়ে বিস্বাদে তেতো হয়ে গেছে মুখ
আয়েশ করে খেতে গিয়ে প্রতিবারই জলপাই-এর বীচি
আটকে গিয়েছে গলায়-
কাশতে কাশতে চোখ-মুখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে
তারপর আবারও সবকিছু ভুলে বুক বেঁধেছি
নতুন স্বাদের জলপাই-এর আচারের আশায়।
আবারও শুনছি জলপাই-এর আচার এসেছে বাজারে
নতুন বোতলে -
অন্য জলপাই-এর আচারের থেকে এটা নাকি আলাদা
এতে নাকি আগের পঁচা জলপাই-এর সেই ঝাঁঝ নেই, দুর্নীতি নেই,
খুব আধুনিক 'সুশীল' কায়দায় নাকি বানানো
এর বীচিও নাকি গলায় আটকায় না
এ জলপাই নাকি ক্ষমতার স্বাদ চায় না, চায় না বাজার দখল করতে।
এ জলপাই চায় শুধু নাকি মানুষের ভালবাসা।
এ জলপাই নাকি আমাদের অনেক পূন্যের ফল
এ জলপাই নাকি আমাদের হাতে রাতারাতি স্বর্গ এনে দেবে।
এ জলপাই নাকি ইতিহাসে নাম লেখাবে
এ জলপাই নাকি আলেকজান্ডারের মত দিগ্বিজয় করবে।
এ জলপাই নাকি মর্তলোকেই তৈরি করবে স্বর্গোদ্যান
এ জলপাই নাকি দেবে সাম্য, দেবে অধিকার,
দেবে আমার হারানো জলপাই-এর স্বাদ ফিরিয়ে।
আমি ন্যাড়া, আমার ভয় হয় আবারো জলপাই তলায় যেতে
আমি আর সকলের মত নতুন জলপাই-এর আগমনে উদ্বেলিত হতে পারি না,
শ্রদ্ধায় নতজানু হতে পারি না অনেক কালের চেনা জলপাই গাছটার সামনে,
আমার আসলে ভয় হয় পুনর্বার এই সুশীল বোতলের পুরোন জলপাই চেখে দেখতে।
অনেকেই রুষ্ট হয়েছিলেন তখন আমার এ ধরণের লেখালিখিতে। আমাকে আওয়ামী-বি এন পির দালাল বলতেও ছাড়েন নি। আর ‘চ’ সিরিজের গালাগালি সমন্বিত ইমেইল আসা শুরু করল দু’একজন ‘দেশপ্রেমিক’ পাঠকের কাছ থেকে। পাত্তা দেইনি। এরপর গঙ্গা যমুনার বুক দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। দেশে জিনিসপত্রের দাম গগনচুম্বি হয়েছে, সবকিছুতেই ষড়যন্ত্র খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা হয়েছে, সমালোচনা করার মৌলিক অধিকার খর্ব্ব হয়েছে, মাইনাস-টু ফর্মুলার বাস্তবায়ন হয়েছে, পিছন থেকে প্ররোচনা আর ব্যাকিং দিয়ে নতুন নতুন কতগুলো নাম সর্বস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছে, ‘মোহম্মদ বিড়াল’ নিয়ে সরকারের ল্যাজে-গোবরে অবস্থা হয়েছে, বায়তুল মোকারমের হেড মোল্লার কাছে গিয়ে হাত পা কচলিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার নাটক হয়েছে আরো কত কি! তবে নাটকের প্রথম পর্বটি কিন্তু মনে রাখার মতই। আমাদের পুত-পবিত্র ‘আর্মি ব্যাকড সরকার’ যখন দ্বিগিজয়ী সেনাপতির মত ভেবে নিয়েছিলেন তারা অজেয়, সর্বস্তরের দেশবাসীর ভালবাসায় চিরধন্য, পেখম তুলে ফুরফুরে মেজাজে আকাশে আকাশে ঘুরছিলেন, তখন এক ‘তুচ্ছ’ ঘটনা তাদের মাটিতে নামিয়ে আনল। গত ২০ শে আগাস্ট লোক প্রশাসনের এক ছাত্র মেহেদি ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে খেলা দেখছিলেন কোন এক মহাপ্রতাপশালী হাটু বাহিনীর সদস্যের সামনে। শুনেছি আগেকার দিনে গ্রামের জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে গ্রামের কোন সাধারণ মানুষ ছাতা মাথায় দিয়ে গেলে নাকি মহা ‘অপরাধ’ বলে গন্য করা হত। এখন তো হাটু বাহিনীই সারা দেশের জমিদার। মেহেদি বোধ হয় বোঝেনি তখন সেটা। ছাতা মাথায় সামনে দাঁড়িয়ে খেলা দেখার অপরাধে হাটু বাহিনীর এক সদস্য মেহেদিকে ধমক দেন এবং গালিগালাজ করা শুরু করেন এই বলে – “সর এখান থেকে, আবার তর্ক করস, চেনোস আমারে??” তারপর শুরু হল কিল ঘুষি, মার। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে শুরু হয় ছাত্র বিক্ষোভ। ছড়িয়ে পড়ে তা দেশ জুড়ে। এক আর্মি অফিসারের পেছনে এক যুবকের লাথি মারার ছবি ইন্টারনেটের কল্যানে ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। এ ছবি বিদ্রোহের প্রতীকে পরিণত হল শেষ পর্যন্ত – ‘এভাবেই লাথি মেরে তাড়াতে হবে জলপাইদের’। নিজেদের সপ্তাকাশে তুলে ধরে হিলিয়াম ফোলা বেলুন ভেবেছিলেন নিজেদের, ‘তুচ্ছ’ ঘটনার সুই তাদের প্রত্যাশা আর প্রশংসার বেলুন নিমেষে ফুটো করে দিল। যে গরুগুলো রং-বেরঙ্গের স্বপ্ন দেখতে দেখতে গাছে চড়ে বসেছিল, তাদের ঘার ধরে মাটিতে নামিয়ে এনে ঘাস খাইয়ে ছাড়ল এটি।
এ ঘটনার রেশ ধরে ক’দিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে বৃহস্পতিবার মাঝরাতে আটক করল যৌথবাহিনী। এরা হলেন জীব বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক হারুন অর রশীদ। পারিবারিক সূত্র থেকে জানা গেল অধ্যাপক আনোয়ার ও অধ্যাপক হারুন দু'জনকেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের টাওয়ার ভবনের বাসা থেকে রাত সাড়ে ১২টার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সহ আরো তিনজনকে আটক করল দেশদরদী সেনবাহিনী –রাতের আঁধারে। আমি আমার একটি লেখায় সেসময় মন্তব্য করেছিলাম, সেনাবাহিনীর এই ভুমিকা আমাদের একাত্তরে পাক বাহিনীর দোসর রাজাকার আলবদরদের কর্মকান্ডকে স্মরণ করিয়ে দেয় ।
ভুল বলেছিলাম সে সময়। জলপাই বাহিনীর কর্মকান্ড পাকবাহিনীর চেয়েও নিকৃষ্ট তা প্রমাণিত হল গতকাল আদালতের রায়ে। ‘স্বাধীন হওয়া বিচার বিভাগ’ তার এক অসাধারণ এক রায়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষকের কারাদন্ড ঘোষণা করেছে। সাজাপ্রাপ্ত এই চারজন শিক্ষক হলেন ব্যবস্থাপনা বিভাগের মলয় কুমার ভৌমিক এবং গণযোগাযোগ বিভাগের সেলিম রোজা নিউটন, দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস এবং আব্দুল্লাহ আল মামুন। আদালত তাদের প্রত্যেককে দুবছর করে সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেছে ।
রায়টি এ অর্থে ‘অসাধারণ’ যে, এই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষকে ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ বা অপরাধ মূলক ক্রিয়াকর্মে অভিযুক্ত থাকার অপরাধে শাস্তি দেওয়া হল। এমনকি পাকিস্তানী আমলেও শিক্ষকদের এমনভাবে “সরকারী ভাবে” ক্রিমিনাল বানানো হয়নি। তাদের হয়ত বাসা থেকে নিয়ে যেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, নিগৃহীতও হয়ত করা হয়েছে – কিন্তু এমন প্রহসনমূলকভাবে চার্জশিট এবং রায় দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে অপরাধী বানানো হয়নি। এমনকি বিগত জামাত-বিএনপি সরকারের আমলেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার কল্পিত আভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুন্তাসির মামুনকে। কিন্তু তারা পর্যন্ত শাস্তি দিতে সাহস করে নি। কিছুদিন পরেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল ডঃ মামুনকে। যে কাজটি খালেদা-নিজামীরা করতে পারেন নি, সে কাজটিই করে দেখালেন আমাদের ‘জনপ্রিয়’ এবং ‘নিরপেক্ষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অগাষ্ট মাসের ছাত্রবিক্ষোভে ইন্ধন যোগানোর (সরি, মৌন মিছিল করার অভিযোগে) সরকারিভাবে চারজন শিক্ষককে ক্রিমিনাল বানিয়ে ছাড়লেন তারা। আরো একটি ক্ষেত্রে অসাধারণ এই রায়। বিচার বিভাগ যে কতটা ‘স্বাধীন’ হয়েছে তা বোঝাতেই বোধ হয় রায় ঘোষণার আগে পূর্ববর্তী তারিখ রায় ঘোষণা স্থগিত রেখে নাকি ঢাকা গিয়েছিলেন বিচারক। তারপর এল এই রায়। কারণ সহজেই অনুমেয় – লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ী।
বিচার কার্য 'সুচারু'ভাবে সমাধা করার পর এখন আবার শোনা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচর্যের সাথে নাকি গতকাল আর্মি চিফের মোলাকাৎ হয়েছে। অনেক জন গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় নিয়ে তাদের কথা হয়েছে। মুলতঃ তাদের সামনে নাকি দুটো অপশন হাজির করা হয়েছে -
এক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সবাই একযোগে তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করবেন। করোজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন, নয়ত
দুই। আইন 'তার নিজস্ব গতিতে' চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জেল-জরিমানা করা হবে।
শিক্ষকদের নাকি এর মধ্যে একটি অপশন বেছে নিতে হবে। সত্যই সবকিছু ধীরে ধীরে নষ্টদের অধিকারে চলে যাচ্ছে।