সমকামিতা (সমপ্রেম) কি প্রকৃতি বিরুদ্ধ? একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনঃস্তাত্বিক আলোচনা (প্রথম পর্ব)

অভিজি রায়

 

 

গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে :

“সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান”

প্রথম প্রকাশ:
ফেব্রুয়ারী, ২০১০

প্রকাশক:
শুদ্ধস্বর
৯১ আজিজ সুপার মার্কেট (৩য় তলা) শাহবাগ, ঢাকা।

ফোন: ০১৭১৬৫২৫৯৩৯ 
ই-মেইল: shuddhashar AT  gmail.com

বিস্তারিত এখানে।

অনেকেই সমকামিতা নিয়ে বেজায় বিব্রত থাকেন। নাম শুনলেই আঁতকে উঠেন। কাঠমোল্লারা তো গালি দিয়ে খালাস- সমকামিরা হচ্ছে খচ্চর স্বভাবের, কুসি রুচিপূর্ন, মানসিক বিকারগ্রস্ত। এমনকি  প্রগতিশীলদের মধ্যেও রয়েছে নানা রকম ওজর আপত্তি।  যারা শিক্ষিত, ‘আধুনিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন, গে লেজবিয়ন ইত্যকার তথাকথিত ‘পশ্চিমা’ শব্দের সাথে কমবেশি পরিচিত হয়েছেন, তারাও খুব কমই ব্যাপারটিকে মন থেকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নিতে পারেন।  তাদের অনেকেই এখনো ব্যাপারটিকে ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ’ মনে করেন, আর নয়ত ভাবেন – পুরো ব্যাপারটি উকট ধরনের ব্যাতিক্রমধর্মী কিছু, এ নিয়ে ‘ভদ্র সমাজে’ যত কম আলোচনা করা যায় ততই মঙ্গল। উপরে উপরে না বললেও ভিতরে ভিতরে ঠিকই মনে করেন  সমকামীরা তো হচ্ছে গা ঘিন ঘিনে বিষ্ঠাকৃমি জাতীয় এঁদো জীব।  মরে যাওয়াই মনে হয় এদের জন্য ভাল।  সমাজ সভ্যতা রক্ষা পায় তাহলে।

আমি এই  প্রবন্ধে বৈজ্ঞানিক দিক (মুলত জীববিজ্ঞান ও জেনেটিক্সের দৃষ্টিভঙ্গি) থেকে বিষয়টি আলোচনা করব। সামাজিক ও মনস্তাত্বিক ধ্যান-ধারণাগুলো আলোচনায় আসবে পরে, প্রবন্ধের  শেষ দিকে। বাংলা সহ  পৃথিবীর তাব সাহিত্যগুলোতে সমকামিতার উল্লেখ এবং পরিশেষে বিভিন্ন খ্যাতনামা সমকামীদের জীবন নিয়েও খানিকটা গভীরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।  তবে সেগুলো আসবে ধীরে ধীরে।

নিঃসন্দেদেহে এ ধরনের প্রবন্ধের কলেবর দীর্ঘ হয়। কিন্তু মুক্তমনার পাঠকদের সুবিধার জন্য আমি প্রবন্ধটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দিব বলে মনস্থ করেছি।   প্রথম দিকের পর্বগুলো মুলত বৈজ্ঞানিক পরিমন্ডলেই সীমাবদ্ধ থাকবে।  আজকের পর্বটি পুরো প্রবন্ধটির ছোটখাট ভুমিকা হিসেবে ধরা যেতে পারে।  একটি দীর্ঘ প্রবন্ধকে ফোরাম বা ওয়েব-সাইটের জন্য ভাগ ভাগ করে ছোট রূপ দেওয়ার চেষ্টা করার কিছুটা অসুবিধাও আছে।  মনে হতে পারে  পর্বটা হঠা করে শেষ হয়ে গেল, কিংবা প্রতিটি কোনা-কাঞ্চি নিয়ে ঠিকমত আলোচনা করা হয়নি।  সেরকম মনে হলে, আমি পাঠকদের বিনীতভাবে ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করব।  বলব, পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন।  আপনাদের প্রত্যাশিত প্রতিটি বিষয় নিয়েই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার ইচ্ছে আছে।

 

আমি শুরু করছি ভুল ভাবে ব্যবহৃত কিছু মন্তব্য দিয়ে, যা সমকামিতার বিরুদ্ধে প্রায়শই ব্যবহার করা হয় :

 

“সমকমীতা প্রাকৃতিক কোনোভাবেই হতে পারে না মূলত (নারী-পুরুষে) কামটাই প্রাকৃতিক”

 

কিংবা অনেকে এভাবেও বলেন -

 

“নারী আর পুরুষের কামই একমাত্র প্রাকৃতিক যা পৃথিবীর সকল পশু করে। যার মূল লক্ষ্য হলো বংশ বৃদ্ধি” 

 

উক্তিগুলো স্রেফ উদাহরণ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।  অনেকেই সমকামিতাকে  ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ বা ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য উপরোক্ত ধরণের যুক্তির আশ্রয় নেন।  আমি এই উক্তির পেছনের যুক্তিগুলো নিয়েই মূলতঃ আলোচনা করব।

 

আসলে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ , ‘অস্বাভাবিক’, ‘প্রাকৃতিক নয়’  –এই ধরণের শব্দচয়ন করার আগে  এবং তা  ঢালাওভাবে তা প্রয়োগ করার আগে  কিন্তু খোলা মনে পুরো বিষয়টি আলোচনার দাবী রাখে।  এই বাংলাতেই এমন একটা সময় ছিল যখন বাল্যবিবাহ করা ছিল ‘স্বাভাবিক’ (রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম সহ অনেকেই বাল্যবিবাহ করেছিলেন) আর মেয়েদের বাইরে কাজ করা ছিল ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ’।  সয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত মেয়েদের বাইরে কাজ করার বিপক্ষে একটা সময় যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন  এই বলে

 

‘যেমন করেই দেখ প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না। যদি প্রকৃতির সেরকম অভিপ্রায় না হত, তা হলে মেয়েরা বলিষ্ঠ হয়ে জন্মাতো। যদি বল,পুরুষদের অত্যাচারে মেয়েদের এই দুর্বল অবস্থা হয়েছে, সে কোন কাজেরই কথা নয়।‘

 

অর্থা,   রবীন্দ্রনাথের যুক্তি এখন মানতে গেলে কপালে টিপ দিয়ে, হাতে দু-গাছি সোনার বালা পরে গৃহকোণ উজ্জ্বল করে রাখা রাবীন্দ্রিক নারীরাই সত্যিকারের ‘প্রাকৃতিক’, আর  শত সহস্র আমিনা, রহিমারা যারা প্রখর রোদ্দুরে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে ইট ভেঙ্গে, ধান ভেনে সংসার চালাচ্ছে, কিংবা পোষাক শিল্পে নিয়োজিত করে পুরুষদের পাশাপাশি ঘামে শ্রমে নিজেদের উজার করে চলেছে – তারা সবাই আসলে ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ’ কুকর্মে নিয়োজিত – কারণ, ‘প্রকৃতিই বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না’।  বাংলাদেশের অখ্যাত আমিনা, রহিমাদের কথা বাদ দেই,  আমেরিকার নাসা থেকে শুরু করে মাইনিং ফিল্ড পর্যন্ত এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে মেয়েরা পুরুষদের পাশাপাশি আজ কাজ করছেন না।   তাহলে? তাহলে আর কিছুই নয়।  নিজের যুক্তিকে তালগাছে তোলার ক্ষেত্রে ‘প্রকৃতি’ খুব সহজ একটি মাধ্যম, অনেকের কাছেই।  তাই প্রকৃতির দোহাই পাড়তে আমরা ‘শিক্ষিত জনেরা’ বড্ড ভালবাসি।  প্রকৃতির দোহাই পেড়ে আমরা মেয়েদের গৃহবন্দি রাখি, জাতিভেদ বা বর্ণবাদের পক্ষে সাফাই গাই, অর্থনৈতিক সাম্যের বিরোধিতা করি, তেমনি সময় সময় সমকামি, উভকামিদের বানাই অচ্ছু।  কিন্তু যারা যুক্তি নিয়ে একটু আধটু পড়াশোনা করেছেন তারা  জানেন যে, প্রকৃতির দোহাই পাড়লেই তা যুক্তিসিদ্ধ হয় না। বরং প্রকৃতির কাঁধে বন্ধুক রেখে মাছি মারার অপচেষ্টা  জন্ম দেয় এক ধরণের কুযুক্তি বা হেত্বাভাসের (logical fallacy)।  ইংরেজীতে এই ফ্যালাসির পুথিগত নাম হল -   ‘ফ্যালাসি অব ন্যাচারাল ল বা  অ্যপিল টু নেচার ’ ।   এমনি কিছু ‘অ্যপিল টু নেচার’ হেত্বাভাসের উদাহরণ  দেখা যাক -

 

১। মিস্টার কলিন্সের কথাকে এত পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। কলিন্স ব্যাটা তো কালো। কালোদের বুদ্ধি সুদ্ধি একটু কমই হয়। কয়টা কালোকে দেখেছ বুদ্ধি সুদ্ধি নিয়ে কথা বলতে? প্রকৃতি তাদের পাঁঠার মত গায়ে গতরে যেটুকু বাড়িয়েছে, বুদ্ধি দিয়েছে সেই অনুপাতে কম। কাজেই তাদের জন্মই হয়েছে শুধু কায়িক শ্রমের জন্য, বূদ্ধিবৃত্তির চর্চার জন্য নয়।

 

২। মারামারি, কাটাকাটি  হানাহানি, অসাম্য প্রকৃতিতেই আছে ঢের। এগুলো জীবজগতের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কাজেই আমাদের সমাজে যে অসাম্য আছে, মানুষের উপর মানুষের যে শোষণ চলে তা খারাপ কিছু নয়, বরং ‘কম্পলিটলি ন্যাচারাল’।

 

৩। প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না। যদি প্রকৃতির সেরকম অভিপ্রায় না হত, তা হলে মেয়েরা বলিষ্ঠ হয়ে জন্মাতো।

 

৪। সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ।  প্রকৃতিতে তুমি কয়টা হোমোসেক্সুয়ালিটির উদাহরণ দেখেছ?

 

এমনি উদাহরণ দেওয়া যায় বহু।

 

উপরের উদাহরণগুলো দেখলে বোঝা যায়, ওতে যত না যুক্তির ছোঁয়া আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি লক্ষনীয় ‘প্রকৃতি’ নামক মহাস্ত্রকে পুঁজি করে পশ্চাদেশ দিয়ে পাহাড় ঠেলার প্রবণতা।  কাজেই বোঝা যাচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ট ষাঁড়দের স্বভাবজাত অ্যপিল টু নেচার-এর শিকার  হচ্ছে সমকামীরা। সমকামিদের প্রতি সুপরিকল্পিত উপায়ে এবং সাংগঠিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঘৃণা। সমকামিতাকে একটা সময় দেখা হয়েছে মনোবিকার, মনোবৈকল্য বা বিকৃতি হিসেবে।  সমকামিদের অচ্ছু বানিয়ে এদের সংস্রব থেকে দূরে থাকার প্রবণতা অনেক দেশেই আছে। শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার তো আছেই, কখনো এদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে আত্মহননের পথে। আর এগুলোতে পুরোমাত্রায় ইন্ধন যুগিয়ে চলেছে ধর্মীয় সংগঠন এবং রক্ষণশীল সমাজ।  সমকামিদের প্রতি হিংসাত্মক মনোবৃত্তির কারণে ইংরেজীতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন একটি শব্দ – হোমোফোবিয়া (Homophobia) । মানবাধিকারের দৃষ্টিকোন থেকে এটি নিতান্ত অন্যায়।  মানবাধিকার এবং সমানাধিকারের প্রেক্ষাপট থেকে এগুলো নিয়ে পরে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করার ইচ্ছে আছে।  তার আগে সমকামিতা বলতে আসলে কি বোঝায় তা আমাদের জানা দরকার।

 

 

সমকামিতার ইংরেজী প্রতিশব্দ হোমোসেক্সুয়ালিটি তৈরি হয়েছে গ্রীক ‘হোমো’ এবং ল্যাটিন ‘সেক্সাস’ শব্দের সমন্বয়ে। ল্যাটিন ভাষায়ও ‘হোমো’ শব্দটির অস্তিত্ব রয়েছে। তবে ‘ল্যাটিন হোমো’ আর ‘গ্রীক হোমো’ কিন্তু সমার্থক নয়।  ল্যাটিনে হোমো অর্থ মানুষ। ওই যে আমরা নিজেদের  হোমোস্যাপিয়েন্স ডাকি – তা এসেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে।  কিন্তু গ্রিক ভাষায় ‘হোমো’ বলতে বোঝায় ‘সমধর্মী’ বা ‘একই ধরণের’।  আর সেক্সাস শব্দটির অর্থ হচ্ছে যৌনতা।  কাজেই একই ধরনের অর্থা, সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার (যৌন)প্রবৃত্তিকে বলে  হোমোসেক্সুয়ালিটি।  আর যারা সমলিঙ্গের প্রতি এ ধরনের আকর্ষণ বোধ করেন, তাদের বলা হয় হোমোসেক্সুয়াল।  সমকামিতার ইতিহাস প্রাচীন হলেও ইংরেজীতে শব্দটির ব্যাবহার কিন্তু খুব প্রাচীন নয়। একশ বছরের কিছু বেশি হল শব্দটি চালু হয়েছে। শুধু ইংরেজী কেন, ইউরোপের বিভিন্ন ভাষাতেও সমকামিতা এবং সমকামিতার বিভিন্নরূপকে বোঝাতে কোন উপযুক্ত শব্দ প্রচলিত ছিল না।  বাংলায় ‘সমকামিতা’ শব্দটি এসেছে বিশেষণ পদ -‘সমকামী’ থেকে।  আবার সমকামী শব্দের উস নিহিত রয়েছে সংস্কৃত ‘সমকামিন’ শব্দটির মধ্যে। যে ব্যক্তি সমলৈঙ্গিক ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে তাকে ‘সমকামিন’ বলা হত।  সম এবং কাম শব্দের সাথে ইন প্রত্যয় যোগ করে ‘সমকামিন’ (সম + কাম + ইন্) শব্দটি সৃষ্টি করা হয়েছে।  আমার ধারণা সমকামিতা নামের বাংলা শব্দটির ব্যাবহারও খুব একটা প্রাচীন নয়। প্রাচীনকালে সমকামীদের বোঝাতে  ‘ঔপরিস্টক’ শব্দটি ব্যবহৃত হত। যেমন, বাসায়নের কামসূত্রের ষষ্ঠ অধিকরণের নবম অধ্যায়ে সমকামীকে চিহ্নিত করতে ‘ঔপরিস্টক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও পরবর্তীকালে এ শব্দের বহুল ব্যবহার আর লক্ষ্য করা যায় নি, বরং ‘সমকাম’ এবং ‘সমকামী’ শব্দগুলোই কালের পরিক্রমায় বাংলাভাষায় স্থান করে নিয়েছে।  কেউ কেউ সমকামিতাকে আরেকটু ‘শালীন’ রূপ দিতে ‘সমপ্রেম’ শব্দটির প্রচলন ঘটাতে চান , অনেকটা ইংরেজীতে আজকের দিনে ব্যবহৃত ‘গে’ বা ‘লেসবিয়ন’ শব্দের মত।

 

এখন কথা  হচ্ছে সমকামিতা কি  জন্মগত নাকি  আচরণগত?  এটি বুজতে হলে আমাদের যৌনপ্রবৃত্তিকে বুঝতে হবে। আজকের দিনের মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন যৌন-প্রবৃত্তির ক্যানভাস আসলে সুবিশাল।  এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ (বিষমকামিতা) যেমন দৃষ্ট হয়, তেমনিভাবেই দেখা যায় সম লিঙ্গের মানুষের মধ্যে প্রেম এবং যৌনাকর্ষণ।  বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি এরা কোন যৌন-আকর্ষণ বোধ করে না, বরং নিজ লিঙ্গের মানুষের প্রতি এরা আকর্ষন বোধ করে।  এদের যৌনরুচি এবং যৌন আচরণ  এগুতে থাকে ভিন্ন ধারায় ।  ব্যাপারটি অস্বাভাবিক নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের বাইরে অথচ স্বাভাবিক এবং সমান্তরাল ধারায় অবস্থানের কারণে এধরনের যৌনতাকে অনেক সময় সমান্তরাল যৌনতা (parallel sex) নামেও অভিহিত করা হয়।  সমান্তরাল যৌনতার ক্ষেত্র কিন্তু খুবই বিস্তৃত।  এতে সমকামিতা যেমন আছে তেমনি আছে উভকামিতা, কিংবা দুটোই, এমনকি কখনো রূপান্তরকামিতাও।  আমি আমার প্রবন্ধ মূলতঃ ‘সমকামিতা’ বিষয়েই সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করব, যদিও অন্যান্য যৌন-প্রবৃত্তিগুলো (যেমন রূপান্তরকামিতা)ও বিভিন্ন সময় আলোচনায় উঠে আসবে।   আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা বলেন, সমকামিতা নিঃসন্দেহে যেমন আচরণগত হত পারে, তেমনি  হতে পারে জন্মগত বা প্রবৃত্তিগত।  যাদের সমকামী যৌনপ্রবৃত্তি জন্মগত, তাদের যৌন-প্রবৃত্তিকে পরিবর্তন করা যায় না, তা সে থেরাপি দিয়েই হোক, আর ঔষধ দিয়েই হোক।  মানুষের মস্তিস্কে হাইপোথ্যালমাস নামে একটি অংগ রয়েছে, যা মানুষের যৌন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে।  সিমন লিভের শরীরবৃত্তীয় গবেষণা থেকে জানা গেছে এই হাইপোথ্যালমাসের  interstitial nucleus of the anterior hypothalamus, বা সংক্ষেপে  INAH3 অংশটি সমাকামিদের ক্ষেত্রে আকারে অনেক ভিন্ন হয় ১৮।  আরেকটি ইঙ্গিত পাওয়া গেছে ডিন হ্যামারের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে।  ডিন হ্যামার তার গবেষণায়  আমাদের ক্রোমোজমের যে অংশটি (Xq28) সমকামিতা ত্বরান্বিত করে তা শনাক্ত  করতে সমর্থ হয়েছেন ১৮।  এছারাও আরো বিভিন্ন গবেষণায় মনস্তাত্বিক নানা অবস্থার সাথে পিটুইটরি, থাইরয়েড, প্যারা-থাইরয়েড, থাইমাস, এড্রিনাল সহ বিভিন্ন গ্রন্থির সম্পর্ক  আবিস্কৃত হয়।  যদিও ‘গে জিন’ বলে কিছু এখনো আবিস্কৃত হয়নি, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফলের অভিমুখ কিন্তু সেই দিকেই (আমি এদের গবেষণা নিয়ে পরে আরো আলোচনা করব)। এই ধরণের গবেষণা সঠিক হয়ে থাকলে বলতেই হয় সমকামী মনোবৃত্তি হয়ত অনেকের মাঝেই জন্মগত না জেনেটিক, আরো পরিস্কার করে বললে, ‘বায়োলজিকালি হার্ড-ওয়্যার্ড’।   জন্মগত সমকামিরা ‘বায়োলজিকালি হার্ড-ওয়্যার্ড’ হলেও আচরণগত সমকামিরা তা নয়। এরা আসলে বিষমকামী।  এরা কোন ব্যক্তিকে বিষমলিঙ্গের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে তাদের সাথে যৌন-সংসর্গে লিপ্ত হয়।  যেমন, জেলখানায় দীর্ঘদিন আটকে থাকা বন্দীরা যৌনসঙ্গীর অভাবে সমলিঙ্গের কয়েদীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেত পারে।  কিন্তু, জেলখানা থেকে বেরিয়ে এলেই দেখা যায়, এদের আচরণের পরিবর্তন ঘটে।  বাংলাদেশের ক্যাডেট কলেজের ছেলেপিলেদের সম্পর্কেও এ ধরনের ধারণা প্রচলিত আছে।  এই ধরণের যৌন প্রবৃত্তির বাইরেও আছে উভকামিতা, কিংবা আছে উভকামিতার সমকামিতা। আলফ্রেড কিন্সে এই ধরনের বিভিন্ন যৌনতাকে পরিমাপ করার জন্য ‘যৌনতা বিষয়ক স্কেল’ উদ্ভাবন করেন। এই স্কেলের এক প্রান্তে আছে পরিপূর্ণ বিষমকাম, অন্যপ্রান্তে পরিপূর্ণ সমকাম। দুই মেরুর মাঝামাঝি রিয়েছে বিভিন্ন পর্যায়- প্রধাণতঃ বিষমকাম, তবে প্রায়ই সমকাম; সমান সমান বিষমকাম এবং সমকাম; প্রধানত সমকাম তবে প্রায়ই বিষম কাম; প্রধাণত সমকাম, তবে মাঝে মধ্যে বিষমকাম ইত্যাদি। কিন্সের এ স্কেল নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও এটি অন্ততঃ বোঝা যায় যে, আমাদের যৌন-প্রবৃত্তির ক্যানভাস আসলে খুবই বিস্তৃত, এবং যৌন প্রবৃত্তি একইভাবে সকলের মাঝে ক্রিয়াশীল হয় না।

 

যৌন প্রবৃত্তি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রাসঙ্গিকভাবেই সেক্স বা যৌনতার  উদ্ভব নিয়ে কিছু না কিছু বলতে হয়। রিচার্ড ডকিন্সের ‘ বিবর্তনীয় স্বার্থপর জিন’ (selfish gene)  তত্ত্ব সঠিক হয়ে থাকলে বলতেই হবে যৌনতার উদ্ভব নিঃসন্দেহে প্রকৃতির একটি মন্দ অভিলাস (bad idea) ।  কারণ দেখা গেছে অযৌন জনন (asexual) প্রক্রিয়ায় জিন সঞ্চালনের মাধ্যমে যদি বংশ বিস্তার করা হয় (প্রকৃতিতে এখনো অনেক এককোষী জীব, কিছু পতংগ, কিছু সরিসৃপ এবং কিছু উদ্ভিদ- যেমন ব্ল্যাক বেরি  অযৌন জনন প্রক্রিয়ায় বংশবৃদ্ধি করে থাকে) তবে বাহকের পুরো জিনটুকু অবিকৃত অবস্থায় ভবিষ্যত প্রজন্মে সঞ্চালিত করা যায়।  কিন্তু সে বাহক যদি যৌন জননের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করে থাকে, তবে  তার জিনের অর্ধেকটুকুমাত্র ভবিষ্যত প্রজন্মে সঞ্চালিত হয়।  কাজেই দেখা যাচ্ছে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে বংশবিস্তার করলে এটি বাহকের জিনকে ভবিষ্যত প্রজন্মে স্থানান্তরিত করবার সম্ভাবনাকে সরাসরি অর্ধেকে নামিয়ে আনে।  এই অপচয়ী প্রক্রিয়ার আসলে কোন অর্থই হয় না। কারণ,  প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন প্রক্রিয়ার মুল নির্যাসটিই হল – প্রকৃতি তাদেরই টিকে থাকার ক্ষেত্রে তাদেরকেই বাড়তি সুবিধা দেয় যারা অত্যন্ত ফলপ্রসু ভাবে নিজ জিনের বেশি সংখ্যক অনুলিপি  ভবিষ্যত প্রজন্মে সঞ্চালিত করতে পারে । সে হিসাবে কিন্তু  অযৌন জননধারীরা (আমরা এখন থেকে এদের ‘অযৌনপ্রজ’ নামে ডাকব) বহু ধাপ এগিয়ে আছে যৌনধারীদের (এদের ডাকব ‘যৌনপ্রজ’ নামে) থেকে।

 

কারণ অযৌনপ্রজদের  যৌনপ্রজদের মত সময় নষ্ট করে সঙ্গী খুজে জোড় বাঁধতে হয় না।  সংগম করে করে শক্তি বিনষ্ট করতে হয় না।  নিজের বা সঙ্গির বন্ধ্যাত্ব নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। বুড়ো বয়সে ভায়াগ্রা সেবন করতে হয় না। কিংবা সন্তানের আশায় হুজুর সাঈদাবাদীর কাছে ধর্ণা দিতে হয় না।   যথাসময়ে এমনিতেই তাদের বাচ্চা পয়দা হয়ে যায়।  কিভাবে? আমরা এখন যে ক্লোনিং –এর কথা জেনেছি, এদের প্রক্রিয়াটা অনেকটা সেরকম। এক ধরনের ‘প্রাকৃতিক ক্লোনিং’ এর মাধ্যমে এদের দেহের  অভ্যন্তরে নিষেক ঘটে চলে অবিরত।  ফলে কোন রকম শুক্রানুর সংযোগ ছাড়াই দেহের ডিপ্লয়েড ডিম্বানুর নিষেক ঘটে চলে।  জীববিজ্ঞানে  এর একটি গালভরা নাম আছে – পার্থেনোজেনেসিস (Parthenogenesis)।

 

কাজেই পার্থেনোজেনেসিস নামধারী অযৌনপ্রজরা সত্যিকার অর্থেই অপারাজেয়, অন্ততঃ যৌনপ্রজদের তুলনায়। এদের কোন পুরুষ সঙ্গীর দরকার নেই। সবাই এক এক জন মাতা মরিয়ম – সয়ম্ভু যীশু উপাদনে পারঙ্গম। যৌনপ্রজরা যে সময়টা ব্যয় করে সংগি খুঁজে তোষামোদ, আদর সোহাগের পশরা খুলে ধুঁকতে ধুঁকতে জিন সঞ্চালন করে, সে সময়ের মধ্যে অযৌনপ্রজরা গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা পয়দা করে ফেলতে পারে – এবং বাইরের কারো সাহায্য ছাড়াই।  ফলে ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে’ এরা বাড়তে থাকে গুনোত্তর হারে।  নীচে এরকম একটি অযৌনপ্রজ প্রজাতি “হুইপটেল গিরগিটি”র ছবি দেওয়া হল।

 


চিত্রঃ হুইপ্টেল গিরগিটি – অযৌনপ্রজ প্রজাতির হার্টথ্রব। এদের বংশবিস্তারের জন্য কোন পুরুষ সঙ্গির প্রয়োজন নেই।

 

মজার ব্যাপার হল এই  হুইপটেল গিরগিটিকূলের সবাই মহিলা, আর তা হবে নাই বা কেন! তাদের ত কোন পুরুষ শয্যাসংগীর দরকার নেই। পুরুষেরা তাদের জন্য ‘বাহুল্যমাত্র’।  কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে সেক্স- সদৃশ একধরনের ব্যাপার ঘটে।  দেখা গেছে এক গিরগিটি আরেক গিরগিটিকে যদি জড়িয়ে ধরে রাখে তাহলে তাদের ডিম পাড়ার হার বেড়ে যায় ।  প্রকৃতির সমকামী প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ! আমাদের কাছে যত অস্বাভাবিক বা প্রকৃতিবিরুদ্ধই মনে হোক না কেন,  হুইপটেল গিরগিটি বা এ ধরনের সরিসৃপদের কাছে কিন্তু এটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা, এবং এরা এভাবেই প্রকৃতিতে টিকে আছে, এবং টিকে আছে খুব ভালভাবেই। ২০০৬ সালে সরিসৃপকুলের আরেক প্রজাতি কমোডো ড্রাগন (Komodo Dragon) কোন পুরুষসঙ্গী ছাড়াই লন্ডনের চিড়িয়াখানায় বাচ্চা পয়দা করে রীতিমত আলোড়ন ফেলে দেয় ৯, ১০


চিত্রঃ কমোডো ড্রাগন কোন পুরুষসঙ্গী ছাড়াই লন্ডনের চিড়িয়াখানায় বাচ্চা প্রসব করে রীতিমত আলোড়ন ফেলে দেয়।

 

বিজ্ঞানীরা ২০০১ সালে নেব্রাস্কার ডুরলি চিরিয়াখানার হাতুরীমুখো হাঙ্গরেরও (Hammerhead shark) প্রজনন লক্ষ্য করেছেন কোন পুরুষসঙ্গির সাহায্য ছারাই১১। এগুলো সবই পার্থেনোজেনেসিস-এর খুবই স্বাভাবিক উদাহরণ। পার্থেনোজেনেসিসের আরো ভাল উদাহরণ খুঁজতে চাইলে বাংলাদেশের খোদ ঢাকা শহরের ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় চলে যেতে পারেন। শুনেছি, আঁশ পোকা নামে এক বদখদ পোকায় নাকি ছেয়ে গেছে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার গাছপালাক্যান্টনমেন্টের বাসিন্দারা রীতিমত আস্থির। প্রথম আলোতে এ নিয়ে রিপোর্ট পর্যন্ত হয়েছিল। বংশবৃদ্ধির জন্য এ পোকার কোন পুরুষ লাগে না, মাদী পোকাটি একাই হাজারে হাজার ডিম পেড়ে পঙ্গপালের মত বংশবৃদ্ধি করে আর আশেপাশের গাছপালাগুলোকে ছিবড়া বানিয়ে ফেলে।

২য় পর্ব পড়ুন...

 


ড. অভিজি রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক ইমেইল : [email protected]