সুরজিৎ মুখার্জীর প্রতিক্রিয়ার জবাবে
আমার প্রতিক্রিয়ার জবাবে সুরজিৎবাবুর প্রতিক্রিয়া আবারো আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। তিনি যে প্রতিক্রিয়া লিখেছেন, তা নিয়ে আবার নতুন করে কিছু বলবার নেই। যা বলার তা আমার আগের প্রতিক্রিয়াতেই বলেছি। এ ছাড়া যার প্রবন্ধ নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন সুরজিৎ, তার মূল লেখক মোঃ জানে আলম নিজেও উত্তর দিয়েছেন; উত্তর দিয়েছেন আকাশ মালিক। কাজেই এ নিয়ে অনর্থক বিতর্কের আর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। ধর্ম ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বকে ইতিহাস-ভুগোলের দ্বন্দ্বের সাথে তুলনা করা অতি সরলীকরণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলাম। বলেছিলাম, ধর্ম নিজ্ঞানের রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব, গ্যালিলিও-ব্রুনোর মত বিজ্ঞানীদের উপর অত্যাচার এগুলো ব্যাপার-স্যাপার ইতিহাস-ভুগোলের ক্ষেত্রে কখনো ঘটেনি। তাই এদেরকে একই দাঁড়িপাল্লায় মাপার প্রচেষ্টা ভুল।
সুরজিৎ বাবু বলতে চান, ধর্মের কোন দোষ নেই, সব দোষ হচ্ছে ধর্মের অপব্যবহারকারীর। এব্যাপারটা সহজেই খন্ডন করা যায় ধর্মগ্রন্থে বিদ্ধৃত ‘ভায়োলেন্ট ভার্স’ গুলো উদ্ধৃত করে, যেগুলো যুগে যুগে ব্যবহৃত হয়েছে মানবতার অগ্রগতি রুখতে। এ ধরণের ভার্স একটা আধটা নয় - রয়েছে হাজারে হাজার, এবং প্রিতিটি ধর্মগ্রন্থেই। কিভাবে বিধর্মীদের মারতে হবে, কিভাবে গর্দানে আঘাত করতে হবে, কিভাবে বেগানা বেহায়া নারীকে পাথর মারতে হবে, কিভাবে ডাইনী পোড়াতে হবে, শুদ্ররা বাসা মারালে কিভাবে গংগাজল দিয়ে বাসা ধুতে হবে – এসমস্ত জিনিস ধর্মগ্রন্থে এন্তার পাওয়া যায়। এগুলো নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে অনেক মুক্তমনা লেখকরাই লিখেছেন। আমিও আমার ‘অধার্মিকের ধর্মকথন’-এ এনিয়ে লিখেছিলাম। প্রতিবার একই জিনিস পুনরাবৃত্ত করতে ইচ্ছে হয় না। সুরজিত বাবু নিজেই জানেন ধর্মের ‘অপব্যবহারকারীদের’ ঘৃনার বড় অংশই আসলে ধর্মগ্রন্থ থেকে উৎসারিত। এটি অস্বীকার করার চেষ্টাটা বোকামী। ঘৃণা উদ্রেককারী শ্লোক আর ভার্সগুলোকে অস্বীকার করে কেবল অপব্যবহারকারীদের ঘারে দোষ চাপানো অনেকটা বিষবৃক্ষের গোরায় জল ঢেলে আগায় কাঁচি চালানোর মত দেখায়।
৯/১১ এর সংগঠকদের কর্মকান্ডের জন্য বিজ্ঞানকে দায়ী করার চেষ্টা দেখে কৌতুক অনুভব করলাম। আমার মনে হয় সুরজিতবাবু বিজ্ঞানকে দায়ী করার আগে ৯/১১-এর হোতাদের কাজকর্মগুলো এবং তাদের স্বীয় ধর্মগ্রন্থগুলো – যেগুলো তাদের এহেন মহান কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল সেগুলো যদি একটু অভিনিবেশ সহকারে দেখতেন, তবে আমাদের সবারই উপকার হত।
ক্রিস্টোফার হিচেন্স ধর্ম সম্পর্কে যে অভিযোগগুলো করেছেন, সুরজিৎবাবু তার জবাব না দিয়ে তাকে প্রতাখ্যান করেছেন ‘ক্রিস্টোফার হিচেন্স এর ব্যক্তিগত অভিমত’ বলে। একইভাবে তাহলে সুরজিৎবাবু যা লিখেছেন, বা যে সমস্ত উদ্ধৃতি তার প্রবন্ধে ব্যবহার করেছেন, সেগুলোও বাতিল করা যায় ‘লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত’ হিসেবে বিশেষিত করে।
সুরজিত বাবুর উদ্ধৃত নীলস বোরের উক্তিটির আধুনিক রূপায়ন হচ্ছে স্টিফেন জে গুল্ডের বহুল বিতর্কিত 'স্বতন্ত্র বলয়' তত্ত্ব (Nonoverlapping Magisteria)। দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে এখনো বিতর্ক করছেন। আমাদের পরবর্তী বই- এ বিষয়টি নিয়ে অঙ্কেগুলো লেখা সংকলিত হয়েছে। আমরা অচীরেই ইবুক হিসবে মুক্তমনায় এটি দিয়ে দেব। আমি আশা করি এ লেখাগুলো সুরজিৎ বাবুর আগ্রহ বাড়াবে।
পরিশেষে, আমি সুরজিৎ বাবুকে ধন্যবাদ জানাই মুক্তমনায় লিখবার জন্য এবং এ ব্যাপারে তার মূল্যবান মতামত প্রদানের জন্য।
অভিজিৎ
সোমবার, ১৮ জুন ২০০৮
ডঃ অভিজিৎ রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক। ইমেইল : [email protected]